রাইজিংবিডি স্পেশাল

স্বর্ণের দাম কেন বাড়ে-কমে

দেশে কিছুদিন পরপরই স্বর্ণের দাম বাড়ে, আবার কখনো কমে। পেছনের এক বছরে এ দাম বাড়ানো-কমানো হয়েছে ১১ বার। এর নেপথ্যে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম ওঠা-নামা ছাড়াও বেশকিছু কারণ রয়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।

তারা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে স্বর্ণের দাম ওঠা-নামা ছাড়াও ডলারের দাম কম-বেশি, চাহিদা বিপরীতে যোগান কম-বেশি থাকলে, উৎসব আমেজের আগে-পরে দাম বাড়ানো-কমানো হয়। এছাড়া পণ‌্যটি আলোচনায় রাখতেও অনেক সময় এটি করা হয়। দাম নির্ধারণের বিষয়ে সব সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি (বাজুস)।

রাজধানীর বায়তুল মোকাররমের স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা  জানান, দাম বাড়া বা কমা প্রথমত আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর নির্ভর করে। যদি আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমে বা বাড়ে তাহলে দেশে ব্যবসায়ীরা তা কয়েকদিন পর্যবেক্ষণ করেন। এক পর্যায়ে বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি বৈঠকের মাধ্যমে দাম নতুন করে নির্ধারণের সিদ্ধান্ত নেয়। এছাড়া ডলারের দামের সঙ্গেও স্বর্ণের দাম ওঠা-নামা করে। বিশ্ব বাজারে ডলারের দাম অনেক সময় বাড়তি থাকলে স্বর্ণের দাম নিম্নমুখী হয়।  আবার এমনও দেখা যায়, ডলার নিম্নমুখী হলে স্বর্ণের দাম হয় ঊর্ধ্বমুখী। এমনকি দেশে বিয়েসহ বিভিন্ন উৎসবের আগে চাহিদা বেড়ে যায়, তখন দাম বাড়ে।

দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে জুয়েলারি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত দীপ জুয়েলার্সের মঞ্জুর রহমান। তিনি রাইজিংবিডিকে বলেন, বেশকিছু কারণে দাম বাড়ে বা কমে।  আন্তর্জাতিক বাজারে স্বর্ণের দাম নিম্নমুখী থাকায় সম্প্রতি দেশে দাম কমানো হয়েছে।  তবে দেশে স্বর্ণ পরিশোধনের কারখানা হচ্ছে।  এটি পুরোপুরি চালু হলে দাম আরও কমবে। 

পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০২১ সালের শুরু থেকে এ পর্যন্ত স্বর্ণের দাম ১১ বার বাড়ানো-কমানো হয়েছে। এর মধ্যে ৫ বার কমানো এবং ৬ বার বাড়ানো হয়েছে। বাজুসের নির্ধারণ করা দাম অনুযায়ী, চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি ২২ ক্যারেট মানের প্রতি ভরি স্বর্ণের দাম ছিল ৭৪ হাজার ৬৫০ টাকা (প্রতিগ্রাম ৬ হাজার ৪০০ টাকা)। এর মধ্যে আরও ১০ বার দাম পরিবর্তন করে গত সপ্তাহে তা নির্ধারণ করা হয়েছে। সর্বশেষ দাম অনুযায়ী, ২২ ক্যারেট মানের প্রতি ভরি স্বর্ণ ৭৩ হাজার ১৩৩ টাকা (প্রতি গ্রাম ৬ হাজার ২৭০ টাকা) বিক্রি হচ্ছে। বছরব্যাপী হ্রাস-বৃদ্ধির পর প্রতি ভরিতে স্বর্ণের দাম কমেছে মাত্র ১ হাজার ৫১৭ টাকা (প্রতি গ্রামে দাম কমেছে ১৩০ টাকা)।

এ বিষয়ে জানতে বাজুসের সাধারণ সম্পাদক ও ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক দিলীপ কুমার আগারওয়ালার মুঠোফোনে কল ও ক্ষুদে বার্তার মাধ্যমে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও পাওয়া যায়নি। 

এদিকে, বাজুসের সাবেক সভাপতি এনামুল হক খান রাইজিংবিডিকে বলেন, সম্প্রতি বাজুসের নতুন কমিটি হয়েছে।  কমিটির নীতিগত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, স্বর্ণের  দামের বিষয়ে গণমাধ্যমে বক্তব্য দিতে ব্যবসায়ীদের নিষেধ করা হয়েছে।  তাই তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

স্বর্ণ বেচাকেনার অনেক পুরনো মার্কেট রাজধানীর তাঁতিবাজার। এখানে কেনাবেচা, বন্ধক, গহনার নানা ধরনের ডিজাইনের কাজ হয়।  অলঙ্কারের কারুকাজের বড় যোগানও দেয় এই মার্কেটের ব্যবসায়ীরা। আলাপকালে তাঁতিবাজারের ব্যবসায়ীরা জানান, স্বর্ণের  দাম হ্রাস-বৃদ্ধির সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততা নেই।  তবে এ কাজটি বাজুস করে থাকলেও ব্যবসায়ীদের একটি সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করে। মূলত তাদের ইচ্ছের ওপরই দাম বাড়ে বা কমে। অতীতে কখনও কখনও আন্তর্জাতিক বাজারে স্বর্ণের দাম বাড়তি থাকলেও দেশে কমানোর ঘটনা ঘটেছে। বিপরীত দিকে, আন্তর্জাতিক বাজারে কম থাকলেও দেশে বাড়ানো হয়েছিল।

তাঁতিবাজারে শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ীদের একজন শরীফ জুয়েলার্সের আনোয়ার শরীফ। তিনি রাইজিংবিডিকে বলেন, স্বর্ণের দাম কেন বাড়ে বা কমে তা তাঁতিবাজারের ব্যবসায়ীরা জানেন না।  কয়েকটি গ্রুপের হাতে দেশের স্বর্ণের বাজার।  তারা যদি মনে করেন দাম বাড়ানো বা কমানো দরকার, তাহলে তাই হয়।  কখনও কখনও পণ্যটি আলোচনায় রাখতেও দাম এটি করা হয়। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়েছে অথচ দেশে কমানো হয়েছে, এমন ঘটনা অতীতে ঘটেছে। 

তিনি বলেন, আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশে বছরে বার বার স্বর্ণের দাম বাড়ানো বা কমানোর নজির নেই। এছাড়া আমাদের দেশের তুলনায় কম দামে সেখানে স্বর্ণ পাওয়া যায়।  কিন্তু পার্শ্ববর্তী দেশের তুলনায় আমাদের দেশে বেশি দামে বেচাকেনা হচ্ছে।

তাঁতিবাজারের দীর্ঘ ৪৫ বছর ধরে ব্যবসা করেন গণেশ ঘোষ।  তিনি রাইজিংবিডিকে বলেন, দেশের স্বর্ণ বাজারের ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ অলঙ্কার তাঁতিবাজারের কারিগরদের তৈরি।  স্বর্ণের দাম যে হারে বেড়েছে, সেভাবে এখানকার কারিগরদের বেতনভাতা বাড়েনি। নানা উপকরণের খরচ বাড়ার কারণে ব্যবসায়ীদের ব্যয় বেড়েছে। ফলে এখানকার ব্যবসায়ীরা ভালো নেই।

উল্লেখ্য, বাজুস নির্ধারণ করা স্বর্ণের নতুন দাম গত বুধবার (১৫ ডিসেম্বর) থেকে কার্যকর হয়েছে। বর্তমানে ২২ ক্যারেট প্রতি ভরি স্বর্ণের দাম ৭৩ হাজার ১৩৩ টাকা। এ ছাড়া ২১ ক্যারেট ৬৯ হাজার ৯৮৪ টাকা, ১৮ ক্যারেট ৬১ হাজার ২৩৬ টাকা এবং সনাতন পদ্ধতির সোনার অলঙ্কার প্রতি ভরি ৫০ হাজার ৯১৩ টাকা বিক্রি হচ্ছে।