শিল্প ও সাহিত্য

ছোটগল্প || পুরনো ছবিতে মুক্তিযুদ্ধের রহস্য

পিএস-টু পোর্টের একটা কম্পিউটার মাউস দরকার ছিল আমার। পুরনো মডেল বলে সচরাচর পাওয়া যায় না- এই যা। টিউশন থেকে ফিরতি পথে আলগোছে পা ফেলে পুরনো ইলেকট্রনিকের দোকানে চোখ বুলাচ্ছিলাম। একটা দোকানে চোখ আটকে গেল। তবে কোনো যন্ত্রাংশ দেখে নয়, ওসবের পেছনে দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড় করা দুটি ছবি দেখে। বড় ও বাঁধানো। একটা সাত বীরশ্রেষ্ঠ, আরেকটা শহীদ বুদ্ধিজীবীদের ছবি। পাশে কাপড়ের ওপর কাঠের ছিলা দিয়ে তৈরি রাধা-কৃষ্ণের পটচিত্র।

দোকানের সামনে দাঁড়াই। বাঁধানো ছবি দুটি দেখি। ছবির ওপরের পলিথিন হলদেটে হয়ে গেছে। দীর্ঘদিন কোনো দেয়ালে ঝুলে ছিল বোঝা যায়। আমি ভেবে পাই না, এতো দিনের ঝোলানো ছবি- তত দিনে ঘরের অত্যাবশ্যকীয় অঙ্গে পরিণত হওয়ার কথা- কী করে ভাঙারি দোকানে বিক্রি করে দেয়! তার ওপর বীরশ্রেষ্ঠ ও শহীদ বুদ্ধিজীবীর ব্যবহৃত ছবি!

স্কুলের হেড স্যারের কক্ষে এই ছবি টাঙানো থাকতো। অবোধ শ্রদ্ধায় কতদিন এই ছবি কেনার জন্য আমি গ্রামের মেলায় ঘুরেছি। হঠাৎ ফুটপাতে পুরনো পাওয়া যাবে, ভাবি নি। দোকানের অন্য মালপত্রের দিকে তাকিয়ে মূল্য বোঝার চেষ্টা করি। কিন্তু মালের বৈচিত্র্য দেখে স্থির হতে পারছিলাম না। তবে সবকিছু গোছগাছে লোকটার রুচি আছে। ফলে ছবির দাম ঠিক করা একটু কঠিন হয়ে গেল।

‘ছবিগুলো কি বিক্রির জন্য?’ আমি লোকটার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করি, তবে শুরুর কথা হিসেবে এটা হয়তো নিজের দুর্বলতা প্রকাশ। ‘হ, বেচার লিগা।’ ফিক করে হেসে ওঠেন লোকটা। তার কথায় কোনো রস-কষ নেই। তবু তিনি সেই অনাপ্রাপ্ত সুধাকে ধরতে চেষ্টা করেন। একটা ন্যাকড়া দিয়ে ছবির ওপর মুছতে মুছতে আমার দিকে এগিয়ে দেন। তার মালপত্রের মতো তিনিও কম বিস্ময়ের নয়। পাড়বিহীন লুঙ্গি পরা। গায়ে বেপারি শার্ট। মাথায় একখণ্ড কাপড় পাগড়ি মতো বাঁধা। সবই সাদা, তবে ময়লা জমে মেটে রং ধরেছে। প্রথম দেখায় মাজারের খাদেম মনে হবে। লোকটা নিশ্চয়ই বিহারি- আমি মনে মনে ভাবি। ‘দাম কত?’ ছবি দুটো উল্টে-পাল্টে দেখতে দেখতে বলি। ‘দাম আর কত ওইবো!’ লোকটা বিস্ময় প্রকাশ করেন। এমনভাবে বলেন, যেন মূল্য না নিতে পারলেই বাঁচেন। এসব নিশ্চয়ই তার মূল্য বৃদ্ধির কৌশল- আমার মনে হয়। ‘আপনের কাছ থেকে বেছি নিমু না। দুইটা আড়াইছো কইরা মাত্র পাঁচছো টাকা দিবেন।’ হাত কঁচলে তিনি বলেন। বিহারি ও পুরান ঢাকার কুট্টিদের মিশেলে লোকটা ‘শ’ কে ‘ছ’ উচ্চারণ করেন।

বসা অবস্থায় লোকটা আমার ঠিক জানু সমান। তাই কথা বলার সময় থুতনি উঁচিয়ে আমার মুখ বরাবর তুলে ধরতে হয়। সামনের একটা দাঁত নেই। সেখান দিয়ে পান খাওয়া লাল জিব উঁকি দেয়। দাম শুনে আমি হতবাক হয়ে যাই। আমি ভেবেছিলাম  মূল্য আরো কম হবে। এমনিতেই নতুন পোস্টার কিনে বাঁধাই করতে বড়জোর তিনশ থেকে সাড়ে তিনশ টাকা পড়বে।

আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখি। পলি ছেঁড়া বা ফ্রেম ঘুণ ধরা কিনা খুঁজি, যা কিনা এই ছবিটাই মূল্যহীন করে দেবে। তা দেখিয়ে হয়তো মূল্য কমানো যাবে, কিংবা নির্দ্বিধায় রেখে যাওয়া যাবে অন্তত। পেয়েও যাই শেষ পর্যন্ত। ‘না, রেখে দিন, নেবো না। হার্ড বোর্ডে পানি লেগে জায়গা নরম হয়ে গেছে। ফুলেও গেছে।’ ক্ষতটুকু দেখিয়ে আমি বলি। ‘এই জিনিসের এতো দাম!’ স্বগোক্তির মতো বললাম। ‘যদি নেন তয় কমায়ে রাখুম।’ আপোস প্রস্তাবের মতো মোলায়েম স্বরে বলেন তিনি। ‘না, না, থাক।’ টাকা নিয়ে আমি হঠাৎ যেন সচেতন হয়ে উঠি। দ্রুত বাসার দিকে পা বাড়াই। ‘চারছো টাকা রাখুমনে।’- পেছন থেকে তিনি একবার চেঁচিয়ে বলেন।

হাঁটতে হাঁটতে আমি বুঝতে চেষ্টা করি, একটা দেশের নাগরিক কখন জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের ছবি, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ঘরের দেয়াল থেকে ভাঙারির কাছে বিক্রি করে দেয়? ভাবতে ভাবতে ছবির সাবেক মালিকের প্রতি করুণা অনুভব করি, কোথাও হয়তো আমরা অক্ষমতাও আড়াল হয়।  আমার মনে হলো দোকানিকে গিয়ে জিজ্ঞেস করি- এই ছবি তিনি কোথায় পেয়েছেন? চুরি করে এনেছেন কিনা? তাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি হয়তো বলবেন, ‘এক অফিসারের বাসা থেকে এনেছি।’ কিন্তু তিনি বাসার ঠিকানা বলতে পারবেন না। ‘এটা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের ছবি। এটা তারা বিক্রি করলেন!’ ‘মানুষের মধ্যে কি আর সেই দেশপ্রেম আছে যে, ছবি বিক্রি করবে না? দুইটা পয়সা পাইছে, বিক্রি করে। পয়সার জন্য মানুষ সব কিছু বেইচা দিতে পারে।’ দোকানি হেসে বলবেন। ‘এটা তো মুক্তিযুদ্ধের ছবি। এরা জাতির প্রতীক।’ আমি আবেগী হয়ে বলবো। লোকটা বলবেন, ‘এই পঞ্চাশ বছরে মুক্তিযুদ্ধ আপনেরে কী দিছে? চাকরি নাই, মানুষের জান-মালের নিরাপত্তা নাই, সবখানে দুর্নীতি। খালি কয় গাড়ি পুলিশ ঘুইরা বেড়ায়। এইডা আপনে গো চাওয়া ছিল নাকি?’ আমি কোনো উত্তর দিতে পারবো না। কিংবা কী দেব উত্তর? এমন অনেক কথাই নিজের সঙ্গে যুঝি।

হাঁটতে হাঁটতে রাস্তা বদল করলাম। তারপর ছোট্ট একটা পার্কের গেটে এসে দাঁড়ালাম। এই পার্কের ভেতর দিয়ে সোজা হেঁটে যাব। ওপাশে একটা গেট। তার ওপাশের রাস্তা ধরে মিনিট পাঁচেক হাঁটলে আরো একটা রাস্তার প্রান্ত। এর অপর প্রান্তে আমার বাসা। সব মিলিয়ে আট-দশ মিনিটের পথ। ইতোমধ্যে সন্ধ্যার আঁধারি জমে আসছে। পার্কে ঢোকার পকেট গেটে মাথা ঢুকিয়েছি, সেই মুহূর্তে, প্রিয় পাঠক বিশ্বাস করুন, ঠিক সেই মুহূর্তে মাথায় চিন্তাটা এলো।

২. গেটের ভেতর থেকে মাথাটা ফিরিয়ে আনলাম। ক্রমেই চিন্তাটা আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। ‘চাঁদে পাওয়া’ কবির মতো। মনে হলো- এক্ষুণি গিয়ে ছবিটা নিয়ে আসি, আর জেনে নেই ছবিটা তিনি কীভাবে পেয়েছেন। সেই সঙ্গে কথা বলে গল্পের সংলাপটাও পুরো করে নিয়ে আসি। কিন্তু ফিরে গেলে কি দাম একটু বাড়িয়েই বলবেন? মনে হলো একবার। কতই আর নেবেন- নিজেকে অভয় দেই। বলে-কয়ে আড়াইশ-তিনশ টাকায় আনা যাবে নিশ্চয়ই। তাতে কি! গল্পের একটা কনটেক্স পাওয়া তো কম কথা নয়।

অন্য একটা রাস্তায় তার দোকানে আবার উপস্থিত হই। লোকটা তখন কি নিয়ে যেন মগ্ন। তাকে ভালো করে দেখলাম। তার দুই হাতে কয়েকটা ব্রেসলেট। তামার-দস্তার ও রাবারের। একটা বাতের চেইনও আছে তাতে। ডান হাতের আঙুলে পাথর বসানো তিনটি আংটি। পথরগুলো বড় বড়। লাল-সবুজ ও পিংক রঙের। তার চারপাশে ছড়িয়ে রাখা জিনিসগুলো আবার দেখলাম। এর মধ্যে কি একটা অদ্ভুত জিনিস- লোহার, জং ধরা। ছোট হেরিকেন সমান। দেখ মনে হয়, কফি দানা ভাঙার মেশিন। ওটা হাতে তুলে নিলাম। আমার কাছে মনে হলো মাংসের কিমা তৈরির মেশিন। ‘মামা এইটা কী?’ কাঠের বাট লাগানো হাতল ধরে ঘুরাতে ঘুরাতে আমি বললাম। ‘ওইটা বাছায় ছেমাই তৈরির মেছিন ছাব।’ তার বেঠপ ব্রেসলেটগুলো তখন ওঠা-নামা করছিল। এন্টিক জিনিস হিসেবে জিনিসটা আমার পছন্দ হলো, ‘এটা কোথায় পেয়েছেন?’ ‘বাছা সাফ করতে যাইয়া পাইছি।’ কণ্ঠে আন্তরিকতা ঝড়াতে চান তিনি। ‘ও’ নিস্তরঙ্গভাবে শব্দ করে আগের জায়গায় নামিয়ে রাখি। ছবির প্রসঙ্গটা আবার প্রথম থেকে শুরু করি।  ‘ওই ছবি দুইটা দেখি।’ তিনি আবার ছবি দুটি মুছতে থাকেন। এবার একটু বেশি যত্ন নেন। এটা নিশ্চয় দাম বাড়ানোর মতলব- মনে মনে ভাবি। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ছবির পুরনো ত্রুটি খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করি আমি। প্রথম ছবিতে পাই না। পরেরটায় পেয়ে যাই।  ‘এটার দাম কত?’ ক্ষত জায়গায় আঙুল বুলাতে বুলাতে বলি।

তিনি আমার দিকে গুরুত্ব সহকারে তাকান। ‘এর ছঙ্গে আরেকটা ছিল। ওই যে মাজেদ ভাই’- তিনি পাশের দোকানদারকে নির্দেশ করেন- ‘তিনি নিছেন দুইছো টাকা দিয়া। আপনেরে ছেই মতো বইলা দিছিলাম। যাক, আপনে আর পঞ্চাশ টাকা কইরা কম দিয়েন। দুইটা তিনছ টাকা দিয়েন।’ পাশের দোকান থেকে সাউন্ড বক্সে ক্যান-ক্যানে শব্দে গান বাজছিল। আমি একটু গলা চড়িয়ে বলি, ‘দাম চাইয়া লাভ নাই। কত রাখবেন তাই বলতে হবে। আমি তো ভাবছিলাম আশি টাকা করে দুইটা একশ ষাট টাকা দিবো। আপনি মোটের ওপর আরো দশ টাকা কম রাখবেন।’ তাকে সুযোগ না দিয়ে আমার মূল্যটা চালান করে দেই। লোকটা মাথা নাড়ান। তার বাবড়ি চুল কাঁধে দোল খায়। গলায় ঝোলানো তামার দীর্ঘ চেইন আর কালো সুতায় বাঁধা তিনটা তাবিজ জামার ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে বুকের ওপর ছড়িয়ে পড়ে। জামার আস্তিন গুটানো একটা হাত দিয়ে সেগুলো ভেতরে চালান করে দিতে দিতে বলেন, ‘এত কমে কি আর পারা যায় ছাব! আপনে আর পঞ্চাশ টাকা দিয়েন- আড়াইছো টাকাই পাক্কা।’

এটা আমার চিন্তার ভেতরেই। তবুও মূল্যটা পুরোপুরি জমে যাওয়ার আগে আমি রাধাকৃষ্ণের পটটা চেয়ে নেই। ‘আর বিশ টাকা দিমানি। ১৮০ টাকা। হলে দেন।’ একটা সুযোগ দেয়ার মতো আমি বলি। ‘এই সিরিজের তো আরো দুইটা ছবি আছে। একটা সেক্টর কমান্ডারদের, অন্যটা বাকি বুদ্ধিজীবীদের। ওই দুইটা ছাড়া তো এই দুইটা অসম্পূর্ণ।’ এই ছবির ত্রুটি দেখিয়ে বাকি দুটি সন্ধান চেয়ে আমি বলি। ‘এইগুলা তো পাওন যায় না। এই দুইটাই পাইছি ছাব।’ নিজেকে দোষ মুক্ত করে বলেন, ‘আমরা যা পাই তাই বেছি। বাকিগুলার খবর আমরা জানুম ক্যামনে। তয় অন্য দুইডা পাইলে আপনের জন্যে রাইখা দিমুনে।’ ‘তাই বলে এত দাম হয় নাকি!’ নিজের কথায় স্থির থাকি আমি। ‘দাম তো ছাব কিছুরই নাইকা। মানুছেরই দাম নাই। আপনে ছিক্ষিত্ মানুষ, দেইখা চিনছেন।’ তিনি কিছুটা আবেগ আর প্রশংসা ঢেলে দেন। আমি সর্বোচ্চ দুইশ টাকা দিতে রাজি হই। ‘এইটা হইলো মুক্তিযোদ্ধার ছবি।’ তিনি বীরশ্রেষ্ঠর ছবি দেখিয়ে বলেন, ‘এইটা একশ ত্রিশ টাকা দিয়েন, আর ওইটা নব্বই টাকা। ছব মিলাই দুইছো বিশ টাকা।’ ‘এইটার দাম যদি বেশি হয়, তাইলে এইটা বিক্রি করলো কেন?’ আমি অজুহাত হিসেবে বলি। ‘ছাথে ওইটাও নিয়া যান।’ তিনি রাধাকৃষ্ণের পট দেখিয়ে বলেন। ‘আরেক ছো টাকা বেছি দিয়েন।’  ‘এটা তো ধর্মীয় জিনিস’ আমি শ্লেষ হেসে বলি ‘এর তো দাম নাই।’ ‘দেন, যার জিনিছ, যার দরকার পরবো, তার কাছে এ্যর দাম আছে।’ তিনি পটটা চেয়ে নিয়ে আবার মোছেন। তারপর একবার সালাম করেন। এ শ্রদ্ধা কি তার সর্বধর্মীবোধ, নাকি বাণিজ্যলক্ষ্মী বোঝা গেল না। তারপর আগের স্থানে পটটি দাঁড় করিয়ে দেন।

এর মধ্যে জানতে পারি তার নাম সালাম শেখ। বললেন- বাঙালি। সিটি করপোরেশনের হয়ে বাসা-বাড়ি থেকে ময়লা নেয়ার কাজ করেন। ‘আপনে গো দোয়ায় আমার পাঁচটা গাড়ি আছে। আছেপাছের তিন-চার রোডে ময়লার কাম আমিই করি।’ বলতে বলতে মাটিতে হাত ছুইয়ে এবার সালাম করে বিনয় দেখান তিনি।  থাকেন ঢাকা উদ্যানের পাশের একটা বস্তিতে। হঠাৎ করে তিনি আমার সম্বন্ধে উৎসাহী হয়ে ওঠেন, ‘আমি তো আপনেরে চিনি। প্রায়-প্রায়ই আমারথন জিনিস কিনতে আসেন। আপনার ছাথে মুলামুলি আছে নাকি! দেন, টাকা দেন।’

আমার ঠিক মনে পড়ে না, কোনো দিন তার দোকানে এসেছিলাম কি না। হঠাৎ আমার নাকের ডগা সিরসির করে ওঠে। আমি আস্তে আস্তে চুলকাতে থাকি। আমার হাঁচি পায়। হাঁচি দেই ভেতরে ভেতরে, দৃশ্যত বেড়ালের হিঁচকি দেয়ার মতো। ‘ওই যে ঢাকা উদ্যানের ঢালে টুকাইগো নাটুকের ঘর আছে না, তার থেকে আইগিলে যে গুতুমির মোড়, ছেই মোড়ে যে সিডির দোকানডা, মোটা মত একটা ছেলে বসে’ এটুকু বলে তিনি থামেন, বৃষ্টির জন্য আকাশে দিকে মুখ তোলা কৃষকের মতো আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন। আমি দু-একবার টোকাই নাট্যসংঘে গিয়েছি। তারপরের কিছুই আমার জানা নেই। তবু কণ্ঠে পরিচিতভাব এনে অজ্ঞাত এক নাম বলি, ‘সোহেলের দোকান?’ ‘অর নাম মাসুম।’ একটু স্বর নামিয়ে বলেন, ‘প্রতিবন্ধী। হাঁটে না। অয় আমার ছেলে। ওকে বললেই আমার বাসায় নিয়া যাইবো। আপনে আইলে খুশি হমু।’ বলতে বলতে সালাম শেখ আন্তরিকতা ঢেলে দেন। কিন্তু কেন- সেই মিমাংসা আমার কাছে নেই। আমি তার দিকে ডান হাত বাড়িয়ে দেই। তিনি দুই হাত বাড়িয়ে দেন। হাতটা ফিরিয়ে নিয়ে চুমু খান। তারপর কপালে ও বুকে ছোঁয়ান। তিনি ছবি দুটো একটা পেপারে মুড়ে পাটের সুতা দিয়ে বেঁধে দেন। টাকাটা দিয়ে আমি হাঁটতে শুরু করি, আর ভাবি- এনিয়ে একটা ভালো গল্প হতে পারে। তা ছাড়া মাত্র দুশো টাকায় বাঁধাই করা দু’টি ছবি পাওয়া কম কথা নয়। হাঁটতে হাঁটতে আমার মনে হয়। 

উচ্ছ্বাসটা দ্রুতই মিইয়ে এলো আমার। আশানুরূপ কোনো সংলাপই পেলাম না তার কাছে? শুধু দৃশ্যের বর্ণনায় গল্পটা দাঁড় করাবো কী করে? লোকটা একটা যোচ্চর, দুই পয়সা লাভের জন্য ইনিয়ে-বিনিয়ে শুধু অভিনয় করলো, মিথ্যে বললো! আর আমার মধ্যে যে মানসিক দোলাচল, গল্প তৈরি করার জন্য ঘটনার লোভ, নিতান্তই সংবাদকর্মীর মতো, এসব সামনে এনে একটা মনোস্তাত্ত্বিক গল্পের পরিপ্রেক্ষিত তৈরি করা যেতে পারে। তা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের গল্প তৈরি হবে কী করে? কিংবা তাতেও কি গল্পটা সফল হবে? মনে হয় না। তাহলে কি আবার লোকটার কাছে ফিরে যাবো? মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা বলবো? তখন মাথায় একটা চিন্তা আসে। আরেকটু না হয় টেবিলে বসেই তৈরি করা যাবে।

৩. টেবিলে বসে ঠিক করি:  আমি আগামীকালও ওই দোকানে যাবো- এই মুক্তিযুদ্ধ সিরিজের বাকি ছবির খোঁজে। হয়তো ছবি দুটো পাওয়া যাবে। বেশি দাম পাওয়ার আশায় তিনি হয়তো বাসায় রেখে এসেছিলেন ওগুলো। সিরিজ পূরণের জন্য ওই ছবি দুটি আমার খুবই দরকার। আমি কিনতে চাইবো। ঝোপ বুঝে লোকটা দ্বিগুণ দাম চাইবেন। আমি তাকে আজকের ঘটনার বর্ণনা দেব। কিন্তু তিনি মনে করতে পারবেন না! কিংবা আমার সন্দেহ সত্য হবে, তার ভাষা থেকে উন্মোচন হবে লোকটা একজন বিহারি। আমাকে তিনি ধোকা দিয়েছেন গতকাল। দামে হবে না বনিবনা। তখন আমি ছবি দুটো কিনতে পারবো না টাকার অভাবে। মনক্ষুণ্ন হয়ে বাসায় ফিরে আসবো।

মনে হবে- মুক্তিযুদ্ধের উত্তর প্রজন্ম হিসেবে এ আমার ব্যর্থতা। দেখাতে পারলাম না আমার দেশপ্রেম। ছদ্মবিহারির কাছ থেকে ছবি দুটি আনতে পারলাম না। মনে হবে- লোকটা একটা সীমার, একজন অসৎ। আমার আবেগের প্রতি তার কোনোই দরদ নাই। আমাকে ফিরিয়ে দিতে এতটুকুও বাধলো না তার! মনে হবে- আমার চেয়ে অল্প টাকা বেশি পেলেই ছবি দুটো তিনি বিক্রি করে দেবেন। মনে হবে- লোকটা বাঙালির ওপর প্রতিশোধ নিলেন।

এ পর্যন্ত ভাবার পর মনে হলো- কোথায় যেন খামতি রয়ে গেছে। পাঠ চমকে দিচ্ছে না, আন্দোলিত করছে না। তাহলে গল্পে একটু ফ্যান্টাসি মিশিয়ে দিতে হবে। 

আমি আবার ভাবতে শুরু করি দৃশ্যকল্প: আমি আগামীকাল আবার সেখানে যাবো। কিন্তু পাবো না তাকে। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও পাবো না। কয়েকবার ফুটপাতের এ-মাথা থেকে ও-মাথা হাঁটবো। অন্য একজন দোকানি ডেকে বলবেন, ‘ছাব, কিছু খুঁজছেন?’ আমি মাজেদের দোকান খুঁজে বের করবো। তার পাশের ছবি বিক্রেতা সালাম শেখের কথা বলবো। তিনি প্রথম বুঝতে পারবেন না। বিহ্বল তাকাবেন। বলবেন, ‘এ নামে কেউ নেই এখানে।’ আমি তাকে বিস্তারিত বলবো। তিনি বলবেন, ‘এ নামে কেউ এখানে ছিলই না।’  আমি তার দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাবো। তিনি বলবেন- গত ত্রিশ বছর এখানে দোকানদারি করেন। এখানে কে আসে কে যায় সব তার জানা। আমি সালাম শেখের কথা মতো যাবো ঢাকা উদ্যান। প্রথমবারের মতো টোকাই নাট্যসংঘ ঘর পেরিয়ে যাবো। গুতুমির মোড়ে গিয়ে দাঁড়াবো। দেখবো- সেখানে কোনো সিডির দোকান নেই। ছোট্ট একটা মাংসের দোকান। মাংসের খণ্ড, ফুসফুস, সিনা ঝুলছে। দিনের বেলায়ও দুটি একশ পাওয়ারের বাল্ব জ্বলছে। সে আলোয় মাংস চিকচিক করছে। একটা স্থুল মতো লোক মাংস কাটছেন। 

আমি তাকে জিজ্ঞেস করবো- তার নাম কি মাসুম? বলবেন- হ্যাঁ, তার নাম মাসুদ।  আমি বলবো- তার বাবার নাম কি সালাম? এবার তিনি বলবেন- না, তার বাবার নাম কালাম। আমার ভেতর তাকে পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে।  আমি বলবো- তার বাবা বালক স্কুলের সামনে পুরানা মাল বিক্রি করেন কিনা। তিনি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাবেন। তিনি বলবেন- হ্যাঁ। তার বাবার সেখানে দোকান ছিল। তিনি স্কুলের সময় ঘরে তৈরি আচার আর বিকেলে মিষ্টি পান বিক্রি করতেন। আমি আশ্বস্ত হতে চাই। তখনই তিনি বলবেন- কিন্তু তিনি তো ছয় বছর আগে মারা গেছেন। তিনি সন্দেহ নিয়ে বলবেন- কিন্তু তাকে কেন? 

আমি তার কাছে থেকে ছবি কেনা ও আজকের ঘটনা বলবো। তিনি আশ্চর্য হবেন এবং পেরেশানির জন্য আফসোস করবেন। আমার ঘাম বের হবে। শেষ ভরসা হিসেবে জিজ্ঞেস করবো- আপনি প্রতিবন্ধী কিনা? তিনি নিজের স্বাস্থ্য সম্পর্কে চেতন হয়ে উঠবেন, ক্ষেপে যাবেন, গালি দেবেন। ঘৃণা ভরে বলবেন- বাড়ি গিয়া ছবি দেখেন গা, কি ছবি কিনছেন!

সবকিছু মিথ্যে হয়ে যেতে পারে না। আমার ছবির কথা মনে হবে। আমি হন্তদন্ত হয়ে বাড়ি ফিরবো। ছবিটা খুঁজবো। ছবিটা ঠিক সেখানেই থাকবে, পেপারে মোড়ানো। কিন্তু প্রথমে চোখে পড়বে না। পরে পড়বে। আমি খুশি হবো। সুতার বাঁধন কাটবো, পেপারটা সরাবো। 

একি! কোনো ছবি নেই। স্রেফ একটা ফ্রেম। মোটা পলিথিন দিয়ে বাঁধানো। তাতে আমার চেহারা দেখা যাবে। ঝাপসা ও কালসিটে। বাঁধানো ফ্রেমটা পানিতে ভেজা, পচপচ করছে। ফ্রেম ঘুণে ঝুরঝুরে হয়ে আছে। দেখে হতভম্ব হবো। আমি কি স্বপ্ন দেখছি? তাহলে ফ্রেমের ভেতর মুক্তিযুদ্ধের ছবিটা কোথায়- প্রশ্ন করবো আমি। চেয়ার টেনে বসে পরবো। আশ্চর্য, চেয়ার টানারও শব্দ হলো না! ছবির চিন্তায় হয়তো আমি তা খেয়ালই করিনি। তারপরও মনে হবে, গল্পটা তবুও কি তৈরি হলো?