সাতসতেরো

তার গান শুনে নেহেরুও কেঁদে ফেলেছিলেন

মোহাম্মদ রফি। কিংবদন্তী এই সংগীতশিল্পী প্রায় চল্লিশ বছর সময়কাল ধরে ছাব্বিশ হাজারেরও বেশি চলচ্চিত্রের গানে কণ্ঠ দিয়ে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে নাম লিখিয়েছেন।

কোনো একটা গান নয়, তার সব গানই শ্রেষ্ঠ। তাকে বলা হয় চিরসবুজ গানের শিল্পী। অনায়াসে উঁচু সপ্তকে সুর খেলাতে পারতেন মহম্মদ রফি। আজও এসব গান লা জবাব। শ্রোতারা সেই সব গান আজও শোনেন।

কাওয়ালি, আধ্যাত্মিক, দেশাত্ববোধক, ক্লাসিক্যাল, লোকগীতি সব গানেই রফি সুপারহিট। রফির রোমান্টিক গান যেমন-ইয়ে মেরা প্রেমপত্র, রাহা গার্দিশোমে হারদম, খিলোনা জানকার, আপ আয়ে বাহার আয়ি, কেয়াসে কেয়া হো গ্যায়া, দিলকে ঝড়োকেমে তুঝকো বিঠাকার, ইয়াদ না যায়ে বিতে দিনোকি, বাহারো ফুল বরসায়ো, ছু লেনে দো নাজুক, না ঝটকো জুলফসে পানি, খিলোনা জানকার তুম, দিন ঢল যায়ে হায়, টুটে হুয়ে খাবোনে, কাভি খুদপে, হাম তুম সে জুদা হোকে, তেরি পেয়ারি পেয়ারি সুরতকো, আনেসে উসকে আয়ে বাহার, চান্দ মেরা দিল, পুকারতা চলা হু ম্যায়, চওদভিঁকা চান্দ, মেরে মেহবুব তুঝে, ইয়ে রেশমি জুলফে।

গান্ধিজীর প্রয়াণের পরপরই তার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে রফির গাওয়া একটা গান বাজারে এলো ‘সুনো সুনো অ্যায় দুনিয়াওয়ালো, বাপুকি অমর কাহানি’- সে গান শুনে জওহর লাল নেহেরু কেঁদে ফেলেছিলেন।

এই প্লে-ব্যাক গায়কের জন্মদিন আজ। ১৯২৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর ভারতের পাঞ্জাবের অমৃতসরে তার জন্ম । মহম্মদ রফির ছদ্মনাম ফেকো । অমৃতসরের কাছে যে গ্রামটিতে জন্ম রফির, সেখানে এক ফকির আসতেন, তার কণ্ঠের আশ্চর্য জাদুতে গানের প্রতি অনুপ্রাণিত হন রফি। তার মৃত্যু ১৯৮০ সালের ৩১ জুলাই। মাত্র ছাপ্পান্ন বছরের জীবন নিয়ে জয় করে গেছেন সংগীত পিপাসুদের মন।

মাত্র ১২ বছর বয়সেই তিনি জয় করেছিলেন বিখ্যাত নায়ক-গায়ক সায়গল এর মন। 

সে গল্পটি এ রকম- লাহোরের স্টেজ প্রোগ্রাম। গান গাইবেন সায়গল। সায়গল মানেই সুপারহিট। লোকে লোকারণ্য। হিন্দি ছবির নায়ক-গায়ককে কাছ থেকে দেখতে ও গান শুনতে।  এসেছেন বড় ভাইয়ের হাত ধরে রফিও। অনুষ্ঠান শুরু হতেই বিদ্যুৎ বিভ্রাট! মাইক অচল। অনুষ্ঠান পণ্ড হওয়ার উপক্রম। হাজার অনুরোধেও সায়গল গাইছেন না। তাই লোকজনকে বসিয়ে রাখার জন্য ডাক পড়ল উপস্থিত স্থানীয় শিল্পীদের। সুযোগ পেয়ে ছুটে গেলেন এক কিশোর। কয়েকটি গান গেয়ে দিলেন নির্ভয়ে। সায়গল সস্নেহে কাছে ডেকে জানতে চাইলেন নাম । ছেলেটি বলল, মহম্মদ রফি।

লাহোরের মানুষের কাছে রফি সেদিন থেকেই তারকা। সায়গলের আসরে বাজিমাৎ করার পর থেকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। প্লেব্যাক গায়ক হওয়ার সুযোগ এসে যায় মাত্র ১৭ বছর বয়সে। মুম্বাইতে তার প্রথম ছবি‘ গাও কী গোরি’ (১৯৪২)। তারপর বলিউডের সেরা পুরুষ প্লেব্যাক গায়ক হতে আর বেশি সময় লাগেনি।

বৈজু বাওরা ছবির ‘ও দুনিয়াকে রাখোয়ালে’ গানটি  রাতারাতি মহাতারকা বানিয়ে দেয় রফিকে। আর এই গানটির জনপ্রিয়তার ফলে দুটো ঘটনা ঘটল। প্রথমত, দেখা গেল- যে প্রায় সব ছবিতে ‘দুনিয়াকে রাখোয়ালে’র মতো চড়া সুরের একটা গান রাখাটা নিয়মে দাঁড়াল। দ্বিতীয়ত, নওশাদ-রফি জুটিটা স্থায়ী রূপ নিলো।

রফি জনপ্রিয় হয়ে ওঠার আরেকটি কারণ সংগীত পরিচালক নওশাদ আলী। নওশাদ রফি ছাড়া আর কিছু বুঝতেন না। এজন্য সমালোচনাও কম ছিলো না। এ সমালোচনা নওশাদজীর রফি নির্ভরতা চুল পরিমাণ কমাতে পারেনি। রফির মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাদের জুটিটি অটুট ছিল।

রফির সেরা সময়ে নায়করাও শর্ত জুড়ে দিতেন, তাদের ছবিতে রফিকে রাখতেই হবে। সমসাময়িক এমন নায়ক খুঁজে বের করা কঠিন, যার রফির গানে ঠোঁট মেলানোর সৌভাগ্য হয়নি। গায়ক-নায়ক-পরিচালক কিশোর কুমারকে পর্যন্ত রফির গান গাওয়ার অভিনয় করতে হয়েছে। 

মহম্মদ রফিকে সঙ্গীত পরিচালক নওশাদ আলী বলতেন ভারতের আধুনিক তানসেন। মান্না দে বলেছিলেন,‘ রফির মতো গায়ক ভারতবর্ষ আর পায়নি।’