সাতসতেরো

‘জাগো বাহে কোনঠে সবায়’

‘জাগো বাহে কোনঠে সবায়’ সংলাপটি সৈয়দ শামসুল হকের নুরলদীনের সারা জীবন নাটকের। সংলাপটি বহুল উচ্চারিত।  পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়, নুরুলদীনের সারা জীবন, এখানে এখন, গণনায়ক প্রভৃতি তার উল্লেখযোগ্য কাব্যনাট্য।  প্রথম দুটি কাব্যনাট্য বাংলা সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য সংযোজন। সর্বাধিক প্রদর্শনী হওয়া দুটি নাটক ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ ও ‘নুরলদীনের সারা জীবন’।  

সাহিত্যে-সংস্কৃতির প্রায় সব ক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন সফল।  কবিতা, উপন্যাস, নাটক, ছোটগল্প, চলচ্চিত্র, গান, অনুবাদ সবখানেই প্রতিভার স্ফুরণ ঘটেছে তার। আর এ জন্যই তিনি ‘সব্যসাচী’। 

জনপ্রিয় লেখক ও কবি সৈয়দ শামসুল হকের ৮৭তম জন্মদিন আজ। ১৯৩৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর কুড়িগ্রামে তার জন্ম। বাবা সৈয়দ সিদ্দিক হুসাইন ও মা হালিমা খাতুন। এই দম্পতির আট সন্তানের প্রথম সন্তান তিনি। সৈয়দ হক এক ছেলে ও এক মেয়ের বাবা। তার স্ত্রী ডা. আনোয়ারা সৈয়দ হক। 

সৈয়দ শামসুল হক স্কুলজীবন কাটে কুড়িগ্রামে। এরপর সোজা মুম্বাইতে গিয়ে কিছুদিন চলচ্চিত্র প্রযোজনা সংস্থায় কাজ করেন। পরবর্তীতে জগন্নাথ কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হন। সেখানে পড়ালেখা শেষ না করেই পুরোদমে লেখালেখি শুরু করেন।  প্রকাশিত হয় তার প্রথম উপন্যাস 'দেয়ালের দেশ'।

তিনি প্রায় সাত বছর কাটিয়েছেন লন্ডনে বিবিসি বাংলা বিভাগের সাথে।  বিবিসি বাংলা থেকে সংবাদ পরিবেশন করেছেন ১৯৭১ সালে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে।

তার লেখকজীবন প্রায় বাষট্টি বছরের। লেখালেখির জীবনে প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি অসাধারণ সৃষ্টিশীলতার সাক্ষর রাখেন।  তিনি স্বাধীনতা পদক, একুশে পদক ও বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। মাত্র ২৯ বছর বয়সে তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেছিলেন।  বাংলা একাডেমি পুরস্কার পাওয়া সাহিত্যিকদের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে কম বয়সে এ পুরস্কার লাভ করেন। 

তার কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে- একদা এক রাজ্যে (১৯৬১), বিরতিহীন উৎসব (১৯৬৯), বৈশাখে রচিত পঙ্ক্তিমালা (১৯৭০), প্রতিধ্বনিগণ (১৯৭৩), অপর পুরুষ (১৯৭৮), পরাণের গহীন ভিতর (১৯৮০), নিজস্ব বিষয় (১৯৮২), রজ্জুপথে চলেছি (১৯৮৮), বেজান শহরের জন্য কোরাস (১৯৮৯), এক আশ্চর্য সংগমের স্মৃতি (১৯৮৯), অগ্নি ও জলের কবিতা (১৯৮৯), কাননে কাননে তোমারই সন্ধানে (১৯৯০), আমি জন্মগ্রহণ করিনি (১৯৯০), তোরাপের ভাই (১৯৯০), শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৯০), রাজনৈতিক কবিতা (১৯৯১), নাভিমূলে ভস্মাধার, কবিতা সংগ্রহ, প্রেমের কবিতা, ধ্বংস্তূপে কবি ও নগর (২০০৯)।

সৈয়দ শামসুল হকের গল্পগ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে- তাস (১৯৫৪), শীত বিকেল (১৯৫৯), রক্তগোলাপ (১৯৬৪), আনন্দের মৃত্যু (১৯৬৭), প্রাচীন বংশের নিঃস্ব সন্তান (১৯৮২), সৈয়দ শামসুল হকের প্রেমের গল্প (১৯৯০), জলেশ্বরীর গল্পগুলো (১৯৯০), শ্রেষ্ঠ গল্প (১৯৯০)।

উপন্যাসগুলোর মধ্যে রয়েছে- এক মহিলার ছবি (১৯৫৯), অনুপম দিন (১৯৬২), সীমানা ছাড়িয়ে (১৯৬৪), নীল দংশন (১৯৮১), স্মৃতিমেধ (১৯৮৬), মৃগয়ায় কালক্ষেপ (১৯৮৬), স্তব্ধতার অনুবাদ (১৯৮৭), এক যুবকের ছায়াপথ (১৯৮৭), স্বপ্ন সংক্রান্ত (১৯৮৯), বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ (১ম খণ্ড ১৯৮৯, ২য় খণ্ড ১৯৯০), বারো দিনের শিশু (১৯৮৯), বনবালা কিছু টাকা ধার নিয়েছিল (১৯৮৯), ত্রাহি (১৯৮৯), তুমি সেই তরবারী (১৯৮৯), কয়েকটি মানুষের সোনালী যৌবন (১৯৮৯), শ্রেষ্ঠ উপন্যাস (১৯৯০), নিষিদ্ধ লোবান (১৯৯০), খেলা রাম খেলে যা (১৯৯১), মেঘ ও মেশিন (১৯৯১), ইহা মানুষ (১৯৯১), মহাশূন্যে পরাণ মাষ্টার, দ্বিতীয় দিনের কাহিনী, বালিকার চন্দ্রযান, আয়না বিবির পালা, কালঘর্ম, দূরত্ব, না যেয়ো না, অন্য এক আলিঙ্গন, এক মুঠো জন্মভূমি, বুকঝিম ভালোবাসা, অচেনা, আলোর জন্য, রাজার সুন্দরী ইত্যাদি।

তিনি ১৯৫৯ সালে ‘মাটির পাহাড়’ চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য লিখেন। এরপর ‘তোমার আমার’, ‘শীত বিকেল’, ‘সুতরাং’, ‘রাজা এল শহরে’, ‘কাগজের নৌকা’, ‘কাঁচ কাটা হীরে’, ‘পুরস্কার’, ‘ক খ গ ঘ ঙ’, ‘বড় ভাল লোক ছিল’,সহ আরও বেশ কিছু চলচ্চিত্রের কাহিনী, চিত্রনাট্য ও সংলাপ লিখেন। ‘বড় ভাল লোক ছিল’ ও ‘পুরস্কার’ এ দুটি চলচ্চিত্রের জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন।

তিনি অনেক কালজয়ী গানের রচয়িতা।  ‘এমন মজা হয় না গায়ে সোনার গয়না’, ‘এই যে আকাশ এই যে বাতাস’, ‘তুমি আসবে বলে কাছে ডাকবে বলে’, ‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস’, ‘তোরা দেখ দেখ দেখরে চাহিয়া’- এসব গান তারই লেখা।

২০১৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর তিনি ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। 

সৈয়দ শামসুল হকের জন্মদিন উপলক্ষ্যে বাংলা একাডেমির আয়োজনে অনলাইনে এক আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে আজ। এতে প্রধান অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কেএম খালিদ। সভাপতিত্ব করবেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা।