সাতসতেরো

খেটে খাওয়া-মেহনতী মানুষের প্রিয় কমরেড

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রাণপুরুষ কমরেড মণি সিংহের ৩১তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ।  জীবনভর লড়াই ছিলো যার খেটে খাওয়া-মেহনতী মানুষের মুক্তির জন্য। তিনি ছিলেন খেটে খাওয়া-মেহনতী মানুষের প্রিয় কমরেড।

১৯৯০ সালের ৩১ ডিসেম্বর তার দীর্ঘ বিপ্লবী জীবনের অবসান ঘটে।  দেশের স্বাধীনতা অর্জন, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে তার অবদান অবিস্মরণীয়। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনেও যুক্ত ছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধকালীন অস্থায়ী সরকারে তিনি উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেন। তাকে বলা হয় গণমানুষের নেতা। সারা জীবনই তিনি গণমানুষের জন্য সংগ্রাম পরিচালনা করে গেছেন। 

এই বিপ্লবী নেতা জাতীয় জীবনে অসাধারণ অবদানের জন্য তিনি ২০০৪ সালে স্বাধীনতা পুরস্কারে (মরনোত্তর) ভূষিত হন।

কমরেড মণি সিংহ’র জন্ম ১৯০১ সালের ২৮ জুলাই কলকাতায়। বাবা কালী কুমার সিংহ’র মৃত্যু হলে, মা সরলা দেবী সাত বছরের মণিকে নিয়ে নেত্রকোনার সুসং দুর্গাপুরে চলে আসেন। এখানে সরলা দেবী তার ভাইদের জমিদারির অংশীদার হয়ে বসবাস শুরু করেন।

তার বিপ্লবী জীবন শুরু হয় সেই স্কুলের বয়স থেকেই। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত হন। সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ‘অনুশীলন’ দলে যোগ দিয়ে বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে স্থান করে নেন। ১৯২১ সালে অসহযোগ আন্দোলন ও খেলাফত আন্দোলনের বিপুল গণজাগরণ তরুণ মণি সিংহের মনে গভীর রেখাপাত করে।

তিনি শ্রমিক আন্দোলন ও ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামে কৃষকদের সংগঠিত করতে নিজেকে মনোনিবেশ করেন। পরে ১৯১৭তে রুশ বিপ্লবের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হন। ১৯২৫ সালে মার্কসবাদ-লেনিনবাদকে আদর্শে দীক্ষিত হন। ১৯২৮ সাল থেকে হয়ে যান কমিউনিস্ট পার্টির সার্বক্ষণিক কর্মী।

১৯৩০ সালের ৯ মে গ্রেপ্তার হন। ১৯৩৫ সালে জেল থেকে মুক্তি দিলেও নিজ গ্রাম সুসং দুর্গাপুরে তাকে অন্তরীণ করে রাখা হয়। এ সময় কৃষক-খেতমজুরদের পক্ষ নিলে নিজ মামাদের জমিদার পরিবারের সঙ্গে বিরোধে জড়ান। পাটের ন্যায্য মূল্য দাবি করে কৃষকদের পক্ষ নেওয়ায় তার দেড় বছরের জেল হয়।

১৯৩৭ সালে জেল থেকে বেরিয়ে এসে দুর্গাপুরের মুসলমান কৃষক ও গাড়ো হাজংদের পক্ষে ‘টংক প্রথা’র বিরুদ্ধে আন্দোলনে অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হন। ১৯৪১ সালে আবার গ্রেপ্তার হন। ১৫ দিন আটক রাখা হয়। ছাড়া পেয়ে আত্মগোপনে চলে যান।

১৯৪৪ সালে সারা বাংলার কৃষাণ সভার প্রেসিডিয়াম সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৪৫ সালে তিনি নেত্রকোনায় নিখিল ভারত কৃষাণ সভার ঐতিহাসিক সম্মেলনের অভ্যর্থনা কমিটির চেয়ারম্যান হন। ১৯৪৭ সালের আগে ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রাম করতে গিয়ে তিনি অসংখ্যবার জেল-জুলুম-নির্যাতন ভোগ করেন।

১৯৫১ সালে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৫ সালেও একই পদে পুনরায় নির্বাচিত হন। ১৯৬৮ সালে জেলে থেকেও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬৯ সালের ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের চাপে অন্যান্য রাজবন্দীর সঙ্গে জেল থেকে বেরিয়ে আসেন। এ বছরের জুলাইতে আবার গ্রেপ্তার হন। পরবর্তীকালে অসহযোগ আন্দোলনের সময় অনেক নেতাকে মুক্তি দিলেও, ইয়াহিয়া সরকার তাকে মুক্তি দেয়নি।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে বন্দীরা রাজশাহীর জেল ভেঙ্গে তাকে মুক্ত করেন। তিনি ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি, ছাত্র ইউনিয়নের গেরিলা বাহিনী গড়ে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। মুজিবনগর সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে তাকে নির্বাচিত করা হয়। 

স্বাধীনতার পর ’৭৩ সালে অনুষ্ঠিত সিপিবির দ্বিতীয় কংগ্রেস এবং ’৮০ সালে অনুষ্ঠিত তৃতীয় কংগ্রেসে মণি সিংহ কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন।

১৮৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর ’৭৭ সালে ৭৭ বছরের মণি সিংহ আবার গ্রেপ্তার হন। জিয়ার শাসনামলে তাকে ছয় মাস কারাগারে অন্তরীণ থাকতে হয়। ৮৪ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি সক্রিয়ভাবে পার্টির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৪ সালে ২৩ ফেব্রুয়ারি তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। ১৯৯০ সালের শেষদিনে তিনি মারা যান।