শিল্প ও সাহিত্য

প্রবন্ধের সৌন্দর্য: সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

কত রকমের বিচারপদ্ধতি তৈরি হয়েছে সাহিত্য আর সাহিত্যিককে মাপামাপির জন্য! সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ কাঁচকলা দেখিয়েছেন সবগুলিকে। সব ধরনের বিতর্ক আর তুলাদণ্ডকে এককথায় নস্যাৎ করা যায়। ‘তা হল- লেখার এভোকেটিভ ক্ষমতা। এই ক্ষমতা যাঁর আছে, তিনি নগর গ্রাম হাট মাঠ নদী গাছ একাল-সেকাল আদিমতা-উগ্রতা- সবকিছু উজ্জ্বল প্রাণের আলোয় ঝলমলিয়ে দিতে পারেন। তখন উগ্র আঁতেলেকচুয়ালকেও হতভম্ব হয়ে দাড়ি চুলকোতে হয়। সব কাগুজে শিল্পতত্ত্ব মাঠে মারা পড়ে।’

গল্প-উপন্যাসে সারাজীবন এই প্রতিভার ঝলক দেখিয়ে গেছেন সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ। কিন্তু প্রবন্ধ যে অসংখ্য তথ্যবহুল হয়েও অপূর্ব সাহিত্যগুণসম্পন্ন হয়ে ওঠে, তার প্রমাণও একই লেখকের ‘প্রবন্ধ সংগ্রহ’।

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের প্রবন্ধের সাথে এই আলোচকের পরিচিতি ঘটে সালমান রুশদির ‘স্যাটানিক ভার্সেস’ নিয়ে তীক্ষ্ম আলোচনাপাঠের মাধ্যমে। ইতিহাসের অনেক অজানা তথ্য সামনে এনে আরবি-ফারসি-ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে দখলসম্পন্ন সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ ইসলামকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে আক্রমণ করার পেছনের কার্যকারণ সম্পর্ক উদঘাটনের মাধ্যমে স্যাটানিক ভার্সেসকে নোংরা ও উদ্দেশ্যমূলক সাহিত্যকর্মের উদাহরণ হিসেবে প্রতিপন্ন করেছিলেন। যেমনটি করেছিলেন গৌরী আইউবও।

বাংলাভাষার লেখক সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ সাহিত্যবোধে ও গল্প-উপন্যাস রচনার গুণে সালমান রুশদির থেকে কোনো অংশে ন্যূন নন। বরং রচনার উৎকর্ষ বাংলা কথাসাহিত্যে চিরস্থায়ী আসনের সম্ভাবনা তৈরি করে দিয়েছে সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের জন্য। ইংরেজি সাহিত্যে রুশদির পক্ষে সেই স্থান পাওয়া কোনোদিনই সম্ভব হবে বলে মনে হয় না।

সেই প্রবন্ধটি পাঠের বেশ কয়েক বছর পর তাঁর ‘প্রবন্ধ সংগ্রহ’র সন্ধান পাওয়া গেল ঢাকার কবি প্রকাশনীতে। একটার পর একটা প্রবন্ধ-পাঠ খুলে দেয় জীবনের নতুন নতুন দিগন্তের ছবি। শাস্ত্র-শরিয়তের সাথে চিরকালই দ্বন্দ্বে লিপ্ত হতে হয়েছে সাহিত্য-শিল্পকে। কখনো সম্মুখ যুদ্ধে কখনো গেরিলা যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়েছে শিল্প-সাহিত্যই। সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ সেইসব ইতিহাস এত গভীরতার সঙ্গে তাঁর প্রবন্ধে এনেছেন যে, প্রথম মুগ্ধপাঠের সঙ্গে একটি অনুভূতিই শুধু কাজ করছিলÑ প্রবন্ধ এত সুন্দর হতে পারে!

বর্তমানের একটি বিষয় তিনি প্রবন্ধে ধারণ করার সময় যতখানি সম্ভব ইতিহাস-ভূগোলে পরিভ্রমণের চেষ্টা করেছেন তিনি। তাই তাঁর প্রবন্ধ তথ্যে তথ্যে ঠাসা। কিন্তু সেই ঠেসে দেওয়ার শিল্পটিও তাঁর এতটাই সুন্দর যে প্রবন্ধকে তথ্য-ভারাক্রান্ত পাণ্ডিত্য মনে হয় না কোনো সময়েই। বোধহয় সৃজনশীল স্রষ্টা বলেই এমন প্রবন্ধের জন্মদান সম্ভব হয়েছে তাঁর পক্ষে, যা প্রথাগত বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক বা প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক গবেষকদের পক্ষে লিখে ওঠা কখনোই সম্ভব নয়। অন্তত এখন পর্যন্ত আমাদের ভাষায় তেমন উদাহরণ পাওয়া যায়নি।

‘প্রবন্ধ সংগ্রহ’ গ্রন্থে মুসলিম চিত্রকলার আদিপর্ব, রামমোহন, আরববাদ নিয়ে বিভিন্ন প্রবন্ধে তিনি প্রাসঙ্গিকভাবেই টেনে এনেছেন ইসলাম, খ্রিস্টধর্ম এবং ইহুদি ধর্মের নানা বিষয় এবং আলোচনা। তাই রচনাগুলি পরিণত হয়েছে ঐসব ধর্মের ইতিহাস, ধর্মতত্ত্ব ও ধর্মাচরণের পারস্পরিক মিল-অমিলের মনোজ্ঞ পর্যালোচনাতে। পবিত্র কোরআনে চিত্রকলা সম্পর্কে সুস্পষ্ট কোনো উল্লেখ নেই। একটি আয়াতে বলা হয়েছে ‘হে বিশ্বাসীবৃন্দ! মদ, জুয়া, মূর্তি এবং তীর নিক্ষেপ (জুয়ার উদ্দেশ্যে) শয়তানেরই হাতের কাজ। তাই এগুলি পরিত্যাগ করো’। [৫:৭:৯০] উল্লেখ না থাকলেও তাফসিরকারী আলেমগণ চিত্রকলাকেও এই নিষেধের মধ্যে নিয়ে এসেছেন।

মক্কা বিজয়ের পর রাসুল কাবাঘর থেকে সকল মূর্তি সরিয়ে ফেলেছিলেন, ভেঙে ফেলেছিলেন। তখন কাবার ভেতরের দেয়ালগুলোতে অনেক ছবি অঙ্কিত ছিল। রাসুল সেগুলো মুছে ফেলতে আদেশ দিয়েছিলেন। তবে একটি ছবি বাদ দিয়ে। নবী হজরত ঈসাকে কোলে নিয়ে মা মরিয়মের দাঁড়িয়ে থাকা ছবি। রাসুল সেই ছবিতে হাত রেখে বলেছিলেন- ‘আমার হাতের তলায় যে ছবিটি আছে সেটি ছাড়া সব ছবি ঘষে মুছে ফেলো’। সেই ছবিটি থেকে যায়। ৬৮৩ খ্রিস্টাব্দে আবদুল্লাহ ইবনে জুবাইরকে বন্দি করার জন্য ইয়াজিদের সৈন্যদল মক্কা অবরোধ করে এবং শহরে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। তখন কাবার দেয়ালের সেই ছবিটি পুড়ে নষ্ট হয়ে যায়। আরব ঐতিহাসিক আরজাকি এই তথ্য লিখেছেন তার গ্রন্থে। [পৃষ্ঠা ১১]

লেখক আরো জানাচ্ছেন যে, হজরত আয়েশা নয় বছর বয়সে রাসুলের স্ত্রী হিসেবে ঘর করতে আসার সময় তাঁর খেলনাগুলোও সঙ্গে এনেছিলেন। সেখানে সোলায়মানের ঘোড়া নামের খেলনাটিও ছিল। রাসুল এ ব্যাপারে সহিষ্ণুতার পরিচয় দিয়েছিলেন। তবে মানুষ বা অন্য কোনো প্রাণীর ছবি আঁকা সার্বিকভাবে নিষিদ্ধই ছিল। তাতে খুব বেশি অসুবিধা হয়নি আরবদের। তারা শিল্পের সমঝদার তেমন ছিলেন না। কারণ গোত্রীয় সমাজে ছবি বা মূর্তি তৈরি করা হতো ধর্ম, তুকতাক, ইন্দ্রজালের অংশ হিসেবে। তার অতিরিক্ত কোনো নান্দনিক অর্থ উপলব্ধি করা অসম্ভব ছিল তাদের পক্ষে। তাই ইসলামের নিয়েধাজ্ঞা মেনে নিতে তাদের কোনো আপত্তি দেখা যায়নি। তবে মুসলিম চিত্রকররা তখন মনোযোগ দিয়েছিলেন লিপিচিত্রে। চরম উৎকর্ষ এনেছিলেন এই শিল্পে। লিপিচিত্র বা ক্যালিগ্রাফি এখনো সারা পৃথিবীতে অ্যারাবিস্ক নামেই আখ্যায়িত হয়ে থাকে।

পরিস্থিতি পাল্টে গেল রাসুলের মৃত্যুর মাত্র একশো বছরের মধ্যেই। লেখক বলছেন- ‘সপ্তম শতকে আরব মুসলিমরা রোমান ও পারসিক সাম্রাজ্যে গিয়ে হানা দেয়, তখন থেকেই তারা বিদেশি ও বিধর্মী সভ্যতাসংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হতে থাকে প্রগাঢ়ভাবে। তারপরই আমরা লক্ষ করি, নতুন মুসলিম সমাজের মানসিকতায় এক প্রবল দ্বন্দ্ব। গ্রহণ ও বর্জনের দ্বন্দ্ব। দেয়া-নেয়ার দ্বন্দ্ব। রক্ষণশীলতা ও উদারতা, স্থিতিশীলতা ও গতিশীলতার পারস্পরিক সংঘর্ষ। একদিকে শরিয়ত, অন্যদিকে আর্ট। ক্ষমতা মানুষকে খেয়ালি করে তোলে। শাসকরা খেয়ালবশে কখনো শরিয়তের দিকে, কখনো আর্টের দিকে ঝুঁকেছেন। কিন্তু সামগ্রিকভাবে লক্ষ করলে দেখব, একজন আরব মুসলিম সমরনেতা যখন রোমান কিংবা বাইজান্টাইন কিংবা পারসিক সাম্রাজ্য জয় করছেন, চোখ ঝলসে গেছে সেখানকার স্থাপত্য-ভাস্কর্য-চিত্রকলার বিশাল দীপ্তি ও সৌন্দর্যে। অন-আরববিশ্বেই  তৎকালে বিশ্বসভ্যতা ও বিশ্বসংস্কৃতির কেন্দ্রগুলো অবস্থিত ছিল। তিনিও স্বাভাবিকভাবেই সেই সভ্যতা-সংস্কৃতির শরিক হতে চেয়েছেন। [পৃষ্ঠা- ১৯] এরপরে একের পর এক মুসলিম খলিফা, শাসক, অমাত্য, সেনাপতিদের বাগানে-প্রাসাদে এবং নগরতোরণে চিত্র ও ভাস্কর্য স্থাপনের উদাহরণ দিয়ে গেছেন সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ।

পরবর্তী সময়ে লেখক আরেকটি শিল্পের ব্যাপার আলোচনায় এনেছেন। তা হচ্ছে পুতুলের ছায়ানাচ। তুরস্কে এটি পরিচিত ও জনপ্রিয় ছিল ‘কারাগোয়ে’ নামে। ক্রুসেডখ্যাত কুর্দি উপজাতির সন্তান সুলতান সালাদিন বিশেষ পছন্দ করতেন কারাগেয়ে বা ছায়ানাচ। তবে তুরস্ক মুসলিমদের দখলে আসার পরে এই ছায়ানাচ নিয়ে দ্বিধায় পড়েছিলেন আলেমরা। শেষে তারা নিষিদ্ধের তালিকা থেকে বাদ দিলেন ছায়ানাচকে। এই ছায়ানাচ দেখেই তেরো শতকের প্রখ্যাত মুসলিম দার্শনিক ও শাস্ত্রকার ইবনে আল-আরাবি একটি গভীর দার্শনিক সিদ্ধান্তে পৌঁছান, যা একাধারে প্লেটোনিক তত্ত্ব, পিথাগোরাসিয় তত্ত্ব এবং সুফিবাদের আশ্চর্য সমন্বয়। সেই সিদ্ধান্ত হলো দর্শক পর্দায় নেপথ্যে সঞ্চালিত ও সূত্রবদ্ধ পুতুলের ছায়াটিই দেখছে, দেখছে না বাস্তব পুতুলগুলোকে। এ থেকে কেন দর্শকের মনে হবে না যে, ঐশ্বরিক বাস্তবতাও অমনি নেপথ্যে থেকে মায়াবৎ লীলা প্রকাশ করছে এবং সুতোটি ধরা আছে ঈশ্বরের হাতে যিনি দৃশ্যমান নন। আল-আরাবির মতে, কারাগোয়ে দর্শকের মনকে বিশ্ব-বাস্তবতা ও বিশ্বমায়ার সম্পর্ক বিচারে আগ্রহী করবে এবং অবশেষে তাকে পরম স্রষ্টার কাছে আত্মসমর্পণে বাধ্য করবে। অতএব কারাগোয়ে শাস্ত্রবিরোধী নয়। [পৃষ্ঠা- ১৫]

প্রায় চল্লিশ পৃষ্ঠার এই বিশাল প্রবন্ধে মর্মকথা হিসাবে সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ যা বলতে চেয়েছেন তা হচ্ছে, শাস্ত্রভীতি শিল্পকে পরাভূত করতে পারেনি কোনোদিনই। তিনি লেখেন- ‘ইসলামি সমাজের একাংশ যেন চেয়েছিলেন, চিত্রকলাও ইসলামের বাহন হোক। তাই সুলতানি খুশখেয়ালে অঙ্কিত সেকুলার চিত্রাবলীর পাশাপাশি ধর্মীয় কনটেন্ট নিয়ে ধর্মীয় চিত্রকলার চর্চাও পরিলক্ষিত হয়’। [পৃষ্ঠা- ৩১]

‘যিশুখ্রিস্ট’ প্রবন্ধটি শুধু যিশু বা খ্রিস্টান ধর্মেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, এসেছে আব্রাহামিক তিনটি ধর্মেরই তুল্যমূল্য আলোচনা। আমরা জানি যিশুর মানুষী অস্তিত্ব নিয়ে বিতর্কের আজো কোনো কিনারা হয়নি। বিতর্ক উঠেছে অবশ্য খুব বেশিদিন আগে নয়। উনিশ শতকে আধুনিক পুরাতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির সময় থেকে ধর্মীয় গণ্ডির বাইরে দাঁড়িয়ে যিশুর মানুষী অস্তিত্ব সম্পর্কে গবেষণা শুরু হয়। পুরাতাত্ত্বিক উৎখনন, সমকালীন রোমান দলিল-দস্তাবেজ হাতড়ানো, আদমশুমারির তালিকাÑ কোনো কিছুতেই যিশুর মানুষী অস্তিত্বের হদিশ পাওয়া যায়নি। ১৮০৮ সালে সম্রাট নেপোলিয়নের সাথে জার্মান পণ্ডিত উইল্যান্ডের সাক্ষাৎ ঘটে। নেপোলিয়ন পণ্ডিতকে প্রশ্ন করেছিলেন যিশু কি ঐতিহাসিক ব্যক্তি? 

উত্তর মেলেনি। মেলার কথাও নয়। যিশুর সমসাময়িক ঐতিহাসিক দলিলপত্রে তাঁর অস্তিত্বের কোনো প্রমাণ নেই। সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ মনে করিয়ে দিচ্ছেন- ‘যিশুর জীবনের কাহিনী একান্তভাবে ম্যাথু, মার্ক, ল্যুক এবং জনের গসপেল চতুষ্টয় এবং পরবর্তী কিছু ক্রিস্টিয় নথি ছাড়া মেলে না। সেগুলিও প্রচণ্ড পরস্পরবিরোধী। এঁদের মধ্যে একমাত্র জন যিশুর মৃত্যুকাল পর্যন্ত উপস্থিত ছিলেন বলে দাবি করেছেন। গসপেলগুলি মুখে মুখে প্রচলিত ছিল। প্রথম শতকেই অবশ্য লিখিত হয়। তবে বাইবেলের যে সর্বজনগৃহীত ভার্সন আমরা এখন পাই, সেটি গ্রন্থিত হয়েছিল ইংলন্ডের রাজা জেমস-এর নির্দেশে। তাতেও পণ্ডিতরা প্রচুর ত্রুটি খুঁজে পেয়েছেন।’ [পৃষ্ঠা- ১৪৬]

‘ইতিহাস’ শব্দের মূলে আছে গ্রিক ক্রিয়াপদ Historein, যার অর্থ তদন্ত করা। কিন্তু তদন্তে কিছুই মেলেনি। তাই আধুনিক ইতিহাস অনুসন্ধানী পদ্ধতি মেনে নিলে বলতে হয়, যিশুর ঐতিহাসিক অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হবার মতো কোনো উপাদান এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি।

লেখক একথাও উল্লেখ করতে ভোলেন না যে, যিশুর নামে খ্রিস্টিয় বর্ষ গণনা করা হলেও সেই খ্রিস্টাব্দ চালু হয় খ্রিস্টিয় ছয়শো শতাব্দীতে। একজন গ্রিক সাধু, দিওনিসিস একসিগিউজ এই সাল গণনা শুরু করেন। তিনিই হিসাব করে দেখাতে চেষ্টা করেন যে, সেকালে প্রচলিত রোমান অলিম্পিক ক্যালেন্ডারের ৭৫৪ তম বর্ষে যিশুর জন্ম। তবে চারটি গসপেলের হিসাব ধরলে এই সালের যথেষ্ট গড়মিল পাওয়া যায়। ম্যাথুর বর্ণনামতে যিশুর জন্ম রাজা হেরোদের রাজত্বের শেষ বছরে। হেরোদের মৃত্যু ঘটে খ্রিস্টপূর্ব ৪ সনে। কিন্তু ল্যুকের গসপেল অনুযায়ী যিশুর জন্ম খ্রস্টিপূর্ব ৭ সনে। তবে বিশ্বাসীর কাছে এই অস্তিত্ব-অনস্তিত্বের প্রশ্নটি নিতান্তই গৌণ। খ্রিস্টানদের মতো মুসলমানরাও বিশ্বাস করেন যে যিশুর অস্তিত্ব ছিল, এবং তিনি কুমারী মাতা মরিয়মের গর্ভে জন্ম নিয়েছিলেন। মুসলিমদের কাছেও যিশু শ্রদ্ধার পাত্র, কারণ তাদের কাছে তিনি নবী হজরত ঈসা, যার স্বীকৃতি কোরআনে দেওয়া হয়েছে। অতএব যিশুর মানুষী অস্তিত্ব নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলার অবকাশ নেই মুসলমানের। খ্রিস্টানদের সাথে মুসলিমদের বিশ্বাসের পার্থক্য যিশুর মৃত্যু নিয়ে। 

খ্রিস্টানরা বলে তিনি ঈশ্বরের পুত্র, মুসলিমরা তা স্বীকার করতে নারাজ। খ্রিস্টিয় বিশ্বাসে যিশুকে ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যার স্বীকারোক্তি আছে। মুসলমানরা বলেন, আল্লাহ তাঁকে সশরীরে তুলে নিয়ে গেছেন চতুর্থ আসমানে। কেয়ামতের পূর্বে তাঁকে আবার পৃথিবীতে পাঠানো হবে। তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে মহানবীর উম্মত হবেন, এবং পৃথিবীতে ন্যায়ের সাম্রাজ্য স্থাপন করবেন। মুসলমানরা এই দাবিও করেন যে, যিশুর আদি বাইবেলকে বিকৃত করা হয়েছে। 

বলা হচ্ছিল বিশ্বাসীদের কথা। ঐতিহাসিক অস্তিত্বের চাইতে তাদের কাছে আধ্যাত্মিক অস্তিত্ব অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বলা চলে, একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ। ইতিহাসবিদরা বলছেন, রোমান শোষণতন্ত্র এবং তাদের সহায়তাকারী ইহুদিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের জন্য যিশু চরিত্রের ঐতিহাসিক প্রয়োজন ছিল এবং সেই বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তারসুতের পণ্ডিত পল। তিনি যিশুর মুখের বাণী হিসাবে প্রকাশ করেছেন সেই চিরকালীন বিদ্রোহীর কণ্ঠস্বর, যা যুগের বেদনায় ক্ষুব্ধ, নীতিহীনতায় বিচলিত, মানবিক আবেগে দীপ্ত- ‘... ভণ্ড, অন্ধ, নির্বোধেরা! ন্যায়বিচার, করুণা, সংহতি তোমাদের পাশ কাটিয়ে যায়। তোমরা থালাবাটির বাইরেটা ধুয়ে পরিষ্কার করো, অথচ ভেতরে থেকে যায় লোভ আর আত্মপ্ররোচনার ময়লা। তোমরা চুনকাম করো কবর। বাইরে তোমাদের ঋজুতা, ভেতরে ভণ্ডামি আর নষ্টামির বঙ্কিমতা। কালভুজঙ্গের দল! বারবণিতারাও তোমাদের চোখের সামনে দিয়ে ঈশ্বরের রাজ্যে প্রবেশ করবে।’

ঐতিহাসিক হোন বা না হোন, যে যিশুর জীবনকে আমরা পাই গসপেল থেকে, উপকথা থেকে, তিনি একজন বিপ্লবী। একজন মানুষকে, একজন সন্তকে। লেখকের ভাষায়Ñ এক মহান বিপ্লবী নেতা, রোমান সাম্রাজ্যবাদ ও ধর্মীয় অনাচারশাসিত জনগণের আশা ও স্বপ্নের অবলম্বন। তাঁর ‘ঈশ্বরের রাজ্য’ বা ‘স্বর্গরাজ্য’ প্রকৃতপক্ষে নীতিবোধসম্পন্ন, অনাচারহীন, শোষণমুক্ত, স্বাধীন মানুষের সমাজ। তিনি কবিতায় ছন্দিত বাক্যে, রূপকে, প্রতীকে, উপমায় তাঁর কথা বলতেন এবং বিশ্বের সব শ্রেষ্ঠ বিপ্লবীর মতো তিনিও ছিলেন এক কবি। কবি বলেই সত্যদ্রষ্টা। যথার্থ বিপ্লবী নেতার মতোই প্রয়োজনে তাঁকে বহুবার আন্ডারগ্রাউন্ডে যেতে হয়েছে। উদ্বেগ, আশঙ্কা এবং ক্ষেত্রবিশেষে দুর্দমনীয় নৈরাশ্যে আক্রান্ত হন তিনি রক্তমাংসের বিপ্লবীর মতোই। অনুচরের বিশ্বাসঘাতকতায় তিনি ক্ষুব্ধ হন। কিন্তু তিনি বিপ্লবী হয়েও হিংস্র নন। আর্ত, রুগ্ন, বিপণ্ন মানুষ তাঁর স্পর্শে ফিরে পায় স্বাস্থ্য আর জীবনের স্বাদ। বিশ্বাসঘাতক অনুচর তাঁকে ধরিয়ে দেয়। বধ্যভূমিতে তিনি শুধু একবারই আর্তচিৎকার করেছিলেন- ঈশ্বর! আমার ঈশ্বর! তুমি কি আমাকে ভুলে গেলে! [এলি এলি লামা সবক্তানি!]

‘বনলতা ও হেলেন’ একেবারেই আলাদা ধরনের প্রবন্ধ। কবি ও কবিতা নিয়ে এত বিশাল এবং আকর্ষণীয় পরিভ্রমণ আমাদের চোখে পড়েনি বহুকাল। একবার পুরো পাশ্চাত্যজুড়ে একটি দীর্ঘস্থায়ী বিতর্ক চলেছিল। তা হচ্ছে- মোজেস এবং হোমার, কে কার লেখা থেকে চুরি করেছেন? Who plagiarised from whom? একদিকে ওল্ড টেস্টামেন্ট, অনদিকে ইলিয়াড-ওডেসি। ভেতরের বিভিন্ন উপগল্প উভয় গ্রন্থে মোটামুটি সদৃশ হওয়াতে এই বিতর্ক।

বুদ্ধদেব বসু এবং তদানীন্তন বাংলাসাহিত্যের অনেক দিকপালের বক্তব্য শুনে বাঙালি পাঠকসমাজ মেনেই নিয়েছিলেন যে জীবনানন্দ দাশ ‘বনলতা’ কবিতাটি লিখেছিলেন অ্যালান পো’র ‘হেলেন’ কবিতা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে। এই প্রবন্ধে সেই ধারণাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছেন সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ।

বুদ্ধদেব বসু বোদলেয়ার-প্রসঙ্গে আলোচনার ফুটনোটে লিখে গেছেন- ‘প্রসঙ্গত উল্লেখ না ক’রে পারছি না যে অ্যালান পো-র কবিতা থেকে প্রত্যক্ষ আহরণ করেছেন। একজন আধুনিক বাঙালি কবি ‘বনলতা সেস’ ও ‘Helen, the beauty is to mine', এ-দুটি কবিতার সাদৃশ্য স্বয়ংপ্রকাশ। ‘চুল’ ‘মুখ’ ‘সমুদ্র’ ও ‘ভ্রাম্যমাণ’ এ-সবই আক্ষরিক অর্থে অ্যালান পো’র, কিন্তু যেমন ‘হায়, চিল’ কবিতায়, তেমনি এ-ক্ষেত্রেও জীবননান্দ তাঁর উত্তমর্ণকে বহুদূরে অতিক্রম করে গেছেন।’

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ এই বক্তব্যকে বলছেন- ‘গরু মেরে জুতা দান’। সাহিত্যে অধমর্ণ বলা মানে যে ভদ্রভাবে চোর বলা, তা তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন। আরো মনে করিয়ে দিয়েছেন, বুদ্ধদেব এই রচনা লিখছেন ১৯৫৮ সালে, জীবনানন্দের মৃত্যুর পরে। অর্থাৎ উত্তর দেবার জন্য জীবনানন্দ বেঁচে নেই। প্রাবন্ধিক নিজেই তাই উত্তর লিখেছেন। এবং আপাত যে চারটি শব্দ উদাহরণ হিসাবে বেছে নিয়ে বুদ্ধদেব বসু এই অনুকরণের যুক্তি দাঁড় করিয়েছেন, সেই শব্দগুলি জীবনানন্দের অসংখ্য কবিতায় যে অসংখ্যবার উচ্চারিত হয়েছে, তার উদাহরণ তুলে ধরেছেন। সর্বোপরি অ্যালান পো’র কবিতার পটভূমি, মর্মবস্তু এবং বাকপ্রতিমার সাথেও যে ‘বনলতা সেন’-এর কোনো মিলই নেই, সেকথাও সপ্রমাণ করেছেন।

সঞ্জয় ভট্টাচার্য (কবি ও প্রকাশক, পূর্ব্বাশা পত্রিকার সম্পাদক) জীবনানন্দ ও ইয়েটসকে এক প্রবন্ধে একসাথে আলোচনা করেছেন। সেখানে ইয়েটস-এর ‘Curlew' কবিতার সাথে জীবনানন্দের ‘হায় চিল’ কবিতাটির মিল খুঁজে জীবনান্দকে ইয়েটস-প্রভাবিত বলেছেন। বুদ্ধদেব বসুও একই কথা বলেছেন এই কবিতা প্রসঙ্গে। সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ যথারীতি এই দাবির অসারতাও তুলে ধরেছেন প্রবন্ধে। পূর্বোক্ত কবি ও আলোচকদের লক্ষ করে বলেছেন- ‘বাঙলার কোমল নিসর্গ, গ্রামীণ জীবন, আর পারিপার্শ্বিক সম্পর্কে নগর-অভিমানী শিক্ষিতের বোধ এবং অনভিজ্ঞতার পরিধি এতই সুবিস্তীর্ণ যে, ‘চিল’ নামক সাধারণ পাখিটির সঙ্গে জড়িত গ্রামীণ চৈতন্যের সূক্ষ্ম অনুষঙ্গগুলি তাঁদের কাছে অপরিচিত। পাড়াগাঁর দুপুরে চিলের ডাকে যে নৈঃসঙ্গবোধ এবং বেদনাময় স্মৃতির গভীরতার জাগরণ ঘটে, তা তাঁদের জানার বাইরে। জীবনান্দের চিল ‘Curlew' নয়। বাঙলার চিল, সোনালী ডানার চিল, অসংখ্যবার তাঁর কবিতায় এসেছে নৈঃসঙ্গবোধজনিত বিষাদ আর আতুর স্মৃতির প্রতীক হয়ে।’ [পৃষ্ঠা- ৯৪]

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ এই ধরনের আলোচনা-প্রবণতা ও মানসিকতাকে বলছেন ‘একদা ইউরোপীয় কলোনি-দেশের দাসম্মন্যতা জনিত হ্যাংওভার’। 

জীবনানন্দের কবিতাগুলোর আরো গভীরতর বিশ্লেষণের পর তিনি পাঠককে মনে করিয়ে দেন- ‘বনলতা সেন’কে সম্পূর্ণ করে বুঝতে বৌদ্ধ-হিন্দু জন্মান্তরবাদ অপরিহার্য। ‘ঘাসের ভিতর ঘাস’ হয়ে জন্মানোর আকাঙ্ক্ষা ‘কমলালেবুর করুণ মাংস’ হয়ে ‘পরিচিত মুমূর্ষুর বিছানার কিনারে’ আসার সাধেও জীবনানন্দীয় অবচেতনায় নিহিত জন্মান্তরবাদী প্রত্যয় ভিন্ন ভিন্ন সংকেতে অভিব্যক্ত হয়েছে। এই কবির সমস্ত উচ্চারণের আদিভূমি ভারতীয় দার্শনিক ধ্যানধারণা। বিভিন্ন সংকেতে সেগুলোর প্রাতিভাসিক কায়া পরিদৃশ্যমান। তাঁর নিসর্গলোক কদাচ নিশ্চেতন, দ্বন্দ্বহীন প্রকৃতি নয়। তা মন্ময় প্রকৃতি। ইউরোপীয় চৈতন্য থেকে তাঁকে কোনো বোধ আহরণ করতে হয়নি, প্রয়োজনই ছিল না।’

কারো কারো আপত্তি থাকতেই পারে সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের বক্তব্যের সঙ্গে। কিন্তু এভাবে জীবনানন্দের কবিতাপাঠের প্রকাশ নতুন এক দিগন্তের পথ যে খুলে দিয়েছে সে বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।

ব্যাপক বিচিত্র এবং প্রয়োজনীয় বিষয়ের রচনা নিয়ে সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের ‘প্রবন্ধ সংগ্রহ’। মৌলবাদ এবং ধর্মীয় শুদ্ধতাবাদের সম্পর্ক জানতে হলে পড়তে হবে ‘ইসলামি নবজাগরণ, না আরববাদ’ প্রবন্ধটি। ব্রাহ্মধর্মের উৎপত্তির দার্শনিক ভিত্তি খুঁজতে চেষ্টা করেছেন তিনি ‘রামমোহন এবং ইসলাম’ প্রবন্ধে। ইসলাম, ক্রিস্টান, ইহুদি- তিনটি আব্রাহামিক ধর্ম হলেও কেন এই তিনধর্মের বিশ্বাসীদের মধ্যে এত পারস্পরিক অবিশ্বাস এবং ঘৃণা, তার ইতিহাস জানা যাবে বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ থেকে। ‘র‌্যালফ ফিচের বেঙ্গালা-বৃত্তান্ত’ থেকে আমরা জানতে পারি, ইংরেজ এবং ইউরোপীয়রা কতখানি শঠ, ধুরন্ধর, নীচাশয় ছিল।

যারা মনে করেন যে ইংরেজরা আমাদের ‘মানুষ’ করেছে, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ তাদের পড়তে বলছেন সেযুগের ইংরেজ লুটেরা বণিক অভিযাত্রীদের জাহাজের লগবুক, কোম্পানি রিপোর্ট, ব্যক্তিগত ডায়েরি এবং চিঠিপত্র। তাহলে তাদের জ্ঞানচক্ষু কিছুটা হলেও উন্মিলিত হতে পারবে। 

আমার শেষ কথা, পাঠকরা এই আলোচনা না পড়ে যদি সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের ‘প্রবন্ধ সংগ্রহ’ পাঠ করেন, তাহলে অনেক বেশি আনন্দময় অভিজ্ঞতার আস্বাদ পাবেন।