মতামত

‘বাংলাদেশ জিততে পারলে অভাবনীয় ব্যাপার হবে’

তৃতীয় দিন শেষে বাংলাদেশ একটা দারুণ অবস্থানে আছে। আমরা যেমনটা আশা করেছিলাম কিংবা আমাদের যেরকম প্রত্যাশা ছিল তার চেয়ে অনেক ভালো খেলছে। টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের চ্যাম্পিয়ন একটি দলের বিপক্ষে, তাদের মাঠে এমন খেলবে এমনটা কিন্তু আমরা অনেকেই আশা করিনি। প্রতিকূল কন্ডিশন কিংবা পরিবেশে আমাদের হাল ছেড়ে দেওয়ার একটা ঝোক থাকে। এবার কিন্তু এই দলটা এখন পর্যন্ত সেরকম কিছু করেনি।

ব্যাটসম্যানদের ভালো পারফরম্যান্স আমাদের চোখে পড়ছে। তার আগে কিন্তু বোলাররা দারুণ করেছে। তাদের অবদানের কথা কিন্তু বলতে হবে। তারা নিউ জিল্যান্ডের মতো একটি দলকে, ওই কন্ডিশনে এতো অল্প রানে আটকে দিয়েছে। পুরো দশ উইকেট তুলে নিয়েছে। সে কারণে আমরা এমন একটা লক্ষ্যমাত্রা পেয়েছি যেটা দল হিসেবে চেস করার মানসিকতা তৈরি হয়েছে ড্রেসিং রুমে।

তাছাড়া নিউ জিল্যান্ড প্রথম দিনে যেখানে থেমেছিল, সেখান থেকে কিন্তু সুযোগ ছিল বড় স্কোর করার। কিন্তু সেটা করতে দেয়নি। এই কৃতিত্বটা কিন্তু আমাদের বোলারদের দিতে হবে। বোলিং ইনিংস থেকেই কিন্তু আমরা ম্যাচে দারুণভাবে আমাদের অবস্থানটাকে দৃঢ় করতে পেরেছি।

বোলারদের মধ্যে নতুন হিসেবে প্রশংসা করতে হবে শরীফুলের। মেহেদী হাসান মিরাজের প্রশংসা করতে হবে। সৌরভের প্রশংসা করতে হবে। তার কাছ থেকে কেউ বল হাতে এমন পারফরম্যান্স প্রত্যাশা করেনি। তারপরও দুটি উইকেট পেয়েছে। বোলিং কিন্তু মোটামুটি আমাদের ভালো হয়েছে। যারা উইকেট পায়নি তারাও কিন্তু ভালো বোলিং করে একটা প্রেসার ক্রিয়েট করেছে। তাতে যারা উইকেট পেয়েছে তাদের উইকেট পাওয়াটা সহজ হয়েছে।

মূলত প্রথম দিনে নিউ জিল্যান্ডকে ২৫৮ রানের মধ্যে আটকে রেখে বাংলাদেশ দল উজ্জীবিত ছিল। সেটার রেশ তারা টেনে নিয়েছে দ্বিতীয় দিনে। এরপর অল্পরানের মধ্যে স্বাগতিকদের তারা অলআউট করেছে।

এরপরে যদি ব্যাটিংয়ের কথা বলি তাহলে বলবো যে নিউ জিল্যান্ডের কন্ডিশনে ব্যাটিং করা সহজ কাজ নয়। কিন্তু উদ্বোধনী জুটিতে সাদমান ও জয় স্বাচ্ছন্দ্যে ব্যাটিং করেছে। তারা বাকিদের পথ দেখিয়েছে, একটা স্ট্যান্ডার্ড সেট করে দিয়েছে। তাদের ব্যাটিং দেখে কিন্তু মনে হয়নি যে কন্ডিশন কঠিন ছিল। এজন্যই বোধহয় ড্রেসিংরুমে যারা ছিল তারাও সাচ্ছন্দ্যবোধ করেছে। সাদমানও বেশ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে খেলছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সে আউট হয়ে গেছে। আমার মনে হয় উদ্বোধনী জুটিটা ব্যাটসম্যানদের বেশ সাহায্য করেছে।

এরপর যার কথা না বললেই নয়, সেটা হলো জয়। তার এই লেভেলে খেলার অভিজ্ঞতা বেশি নাই। যদিও বিদেশের মাটিতে অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে সে যথেষ্ট রান করেছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক এই লেভেলটা কিন্তু অনেক ভিন্ন। তারপর তার যে শারীরিক ভাষা ছিল সেটা কিন্তু দেখার মতো ছিল। জয় কিন্তু ইয়াং ক্রিকেটারদের দেখিয়ে দিয়েছে যে ইচ্ছা থাকলে অনেক কিছু করা যায়।

আমরা কিন্তু সবাই ভাবছিলাম যে নিউ জিল্যান্ডের কন্ডিশনে বাংলাদেশ কেমন করে। আজ যদি বাংলাদেশ ২১০ অথবা ২২০ রানে অলআউট হয়ে যেতো তাহলে আমরা কিন্তু অবাক হতাম না। কিন্তু এরকম একটা অবস্থা থেকে জয়ের মতো তরুণ ক্রিকেটাররা যখন দারুণ ব্যাটিং করে তখন সেটা কিন্তু অন্যদের দারুণ উজ্জীবিত করে। জয়ের পাশাপাশি শান্ত দারুণ একটা পার্টনারশিপ গড়েছে। যেটা আমাদের ব্যাটসম্যানদের জন্য একটা প্ল্যাটফরম তৈরি করে দিয়েছিল। তাদের মানসিকভাবেও আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছিল যে, না এটা সম্ভব।

টেস্ট খেলার যে মেজাজ, টেস্ট খেলার যে প্রবণতা সেটা ধরে ব্যাটিং করাটা আমার মনে হয় ভিন্ন ছিল এই দলটার ক্ষেত্রে। জয় তো অনেক সময় ধরে খেলেছে। শান্ত তার মতো করে খেলেছে। লম্বা ইনিংস খেলার চেষ্টা ছিল তার মধ্যে। মুমিনুলের মধ্যে ডিফেন্সিভ খেলার প্রবণতা ছিল। আজ আমরা ভিন্ন এক মুমিনুলকে দেখেছি।

আর একটা বিষয় বলতে হবে মুমিনুলের মধ্যে নেতৃত্বের যে ব্যাপারগুলো সেটা আস্তে আস্তে আসছে। আজ সে দায়িত্ব নিয়ে ব্যাটিং করেছে। অধিনায়ক হিসেবে খেলার চেষ্টা করেছে। তার বডি ল্যাঙ্গুয়েজ, এক্সপ্রেশন- সব মিলিয়ে দারুণ ব্যাপার ছিল। টপ অর্ডারের ব্যাটিংয়ের আত্মবিশ্বাস কিন্তু ইয়াসির আলী রাব্বী ও মিরাজও ক্যারি করছে। তবে খুব ভালো হতো যদি মুমিনুল কিংবা লিটনের মধ্যে একজন থাকতে পারতো, তাহলে নিউ জিল্যান্ড অত্যন্ত চাপের মধ্যে থাকতো।

নিউ জিল্যান্ড এখন এই ভেবে চাপমুক্ত যে কালকে সকালে তাড়াতাড়ি তারা নতুন একটা বল নিতে পারবে। তাদের পেস বোলাররা আবার একটু বিশ্রাম পাবে। বিশ্রাম পেয়ে আবার বোলিং করতে পারবে। দ্রুত বাংলাদেশকে অলআউট করার চেষ্টা করতে পারবে।

পাশাপাশি রাব্বী ও মিরাজের পার্টনারশিপটা যদি আর একটু বড় করা যায়, প্রথম ইনিংসে আমাদের লিডটা যদি আর একটু বড় হয় তাহলে আমরা চালকের আসনে থাকতে পারবো।

যেহেতু টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের একটা খেলা হচ্ছে এখানে, সেহেতু নিউ জিল্যান্ড চাইবে ঘরের মাটিতে বাংলাদেশকে হারিয়ে পয়েন্ট নিতে। আর সেটা করার চেষ্টা করতে গিয়ে নিউ জিল্যান্ড যদি দ্বিতীয় ইনিংসে আক্রমণাত্মক ব্যাটিং করার চেষ্টা করে এবং বাংলাদেশ যদি সেই সুযোগটা নিতে পারে তাহলে দারুণ ব্যাপার হবে। 

এই মুহূর্তে যদি বলি তাহলে পরবর্তী দুইদিনে এই ম্যাচটা যেকোনো দিকে যেতে পারে। ম্যাচে আমাদের জেতার সম্ভাবনা বেশি। তবে বাংলাদেশ লিড নিয়েছে তার মানে এই না যে এই ম্যাচটা আমরা হারতে পারি না। শেষ দুইদিনে খেলার মোড় কিন্তু ঘুরে যেতে পারে। সেটা যেমন বাংলাদেশের পক্ষে ঘুরতে পারে, তেমনি নিউ জিল্যান্ডের পক্ষেও ঘুরতে পারে। বাংলাদেশ লিড পাওয়ার সুবিধাটা কাজে লাগিয়ে যদি জিততে পারে তাহলে সেটা অভাবনীয় ব্যাপার হবে।

কারণ, আমাদের টেস্টের মান নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে। আমরা যদি এই টেস্টে ভালো খেলতে পারি তাহলে আমাদের সম্পর্কে অনেকের ধারনা বদলে যাবে। এই টেস্টটা আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে কাজটা কিন্তু সহজ নয়, খুবই কঠিন। নিউ জিল্যান্ড কিন্তু কঠিন একটা চ্যালেঞ্জ দেওয়ার চেষ্টা করবে। আশা করছি বাংলাদেশ ভালো কিছু উপহার দিবে।

লেখক: নাজমুল আবেদীন ফাহিম, ক্রিকেট উপদেষ্টা, বিকেএসপি।