সাতসতেরো

সাকরাইন: তারায় তারায় রটিয়ে দেওয়া উৎসব

সাকরাইন উপলক্ষে পুরান ঢাকায় বইছে উৎসবের বাতাস। সাকরাইনকে ঘিরে পুরান ঢাকার অলিগলিতে বেড়েছে ঘুড়ি বেচাকেনা। শিশু, তরুণ, বৃদ্ধরা কিনছেন ঘুড়ি, নাটাই, সুতা, ফানুস। সাজ সাজ রব চারদিকে!

সাকরাইন ‘ঘুড়ি উৎসব’ নামেও পরিচিত। সংস্কৃত শব্দ ‘সংক্রান্তি’ ঢাকাইয়া অপভ্রংশে সাকরাইন-এ রূপ নিয়েছে। পৌষ ও মাঘ মাসের সন্ধিক্ষণে, পৌষ মাসের শেষ দিন ভারতবর্ষের অনেক জায়গায় সংক্রান্তি উদযাপিত হয়। তবে পুরান ঢাকায় পৌষসংক্রান্তি বা সাকরাইন সার্বজনীন ঢাকাইয়া উৎসবের রূপ নিয়েছে। বাংলা বর্ষপঞ্জিকার নবম মাস অর্থাৎ পৌষ মাসের শেষ দিন এই উৎসবের আয়োজন করা হয়। ভারতীয় উপমহাদেশে দিনটি ‘মকর সংক্রান্তি’ নামেও পরিচিত।

সাকরাইনের ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৭৪০ সালের পৌষ মাসের শেষ এবং মাঘ মাস শুরুর সন্ধিক্ষণে মোঘল আমলে নায়েব-ই-নাজিম নওয়াজেশ মোহাম্মদ খানের আমলে ঘুড়ি উৎসবের প্রচলন হয়। কাল পরিক্রমায় দিনটি পুরান ঢাকার মানুষের অন্যতম উৎসবে পরিণত হয়েছে।  যুগ যুগ ধরে এই উৎসব পালন করে আসছেন তারা। 

বৃহস্পতিবার সারাদিন ও সন্ধ্যাবেলা পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি চলছে সাকরাইনের। সূত্রাপুর, নবাবপুর, শ্যামবাজার, ধূপখোলা, শাঁখারি বাজার, তাঁতীবাজার, ধোলাইখাল, লক্ষ্মীবাজার, ফরাশগঞ্জ, সদরঘাট, গেন্ডারিয়া, নারিন্দা, লালবাগ, চকবাজার, মুরগিটোলাসহ বিভিন্ন এলাকায় শুরু হয়েছে সাকরাইনের আমেজ। ছাদগুলো সাজানো হয়েছে লাল নীল পর্দা ও নানা রঙের বাতি দিয়ে। চলছে ঘুড়ি ওড়ানোর রিহার্সেল। শেষবারের মতো বাজিয়ে দেখা হচ্ছে সাউন্ড সিস্টেম, বাজানো হচ্ছে ডিজে গান।

সাকরাইন উপলক্ষে যেসব ঘুড়ি পাওয়া যাচ্ছে এর মধ্যে অন্যতম চোখদার, রকদার, গরুদার, ভোমাদার, কাউঠাদার, মাছলেঞ্জা, ফিতালেঞ্জা, একরঙা, চানতারা, সাপঘুড়ি, প্রজাপতি ঘুড়ি, দাবা ঘুড়ি, বাদুর, চিল, অ্যাংগ্রি বার্ড, ঈগল, পেঁচা ঘুড়ি, বাক্স ঘুড়ি। উৎসবের কারণে ঘুড়ির দামও বেড়েছে। সাধারণ ঘুড়ি বিক্রি হচ্ছে ১০-২০ টাকায়, যা আগে বিক্রি হতো ৫-৬ টাকা করে। অন্যান্য ঘুড়ির দাম ৫০-৪৫০ টাকা পর্যন্ত।

ঘুড়ি ওড়ানোর জন্য বাঁশের নাটাইসহ পিতল ও লোহার নাটাই পাওয়া যায়।  এগুলোর মধ্যে অন্যতম চাবাডি, মুখবন্ধ, বাটিওয়ালা, লোহা নাটাই, কাঠের নাটাই ইত্যাদি। ছোট থেকে বড় সব রকমের নাটাই পাওয়া যায়। নাটাই সর্বনিম্ন দুই থেকে সর্বোচ্চ দশ ইঞ্চি হয়। সাধারণ নাটাই কিনতে পারবেন ৮০-৮০০ টাকার মধ্যে।  পিতল ও লোহার নাটাই নিতে চাইলে গুণতে হবে অতিরিক্ত টাকা।

ঘুড়ি ওড়ানোর অন্যতম উপাদান সুতা। এসব সুতার রয়েছে বাহারী সব নাম। যেমন ড্রাগন সুতা, ভুত সুতা, বিলাই সুতো ইত্যাদি। গজ ও পাইকারি হিসেবে কিনতে পারবেন সুতা। কাঁচের মাঞ্জা দেওয়া সুতা পাওয়া যাচ্ছে বিভিন্ন দোকানে। ৪০ টাকা থেকে শুরু করে ৫০০ টাকা পর্যন্ত দামে কিনতে পারবেন সুতা।

সাকরাইনের অন্যতম উপাদান হচ্ছে আতশবাজি। আতশবাজির জন্য অন্যতম জনপ্রিয় হচ্ছে কদম ফুল, তারা শট, ঝর্ণা, ব্যাটারি বোম, চকলেট বোম, শলতা বোম, রকেট বোম, পাতা বোম, ২৮ বোম, ফ্লেম টর্চ, পাঁচ শট, বারো শট, একুশ শট, বত্রিশ শট, আশি শট, একশ বিশ শট, দেড়শ শট ইত্যাদি। কার্যক্ষমতা ও আকার বুঝে প্রতিটি আতশবাজি বিক্রি হচ্ছে ৪০০ থেকে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত।

সাকরাইনের রাতে পুরান ঢাকার আকাশ দখল করে নেয় ফানুস। হরেক রকম ফানুস পাওয়া যাচ্ছে পুরান ঢাকার বিভিন্ন দোকানে। এদের মধ্যে অন্যতম গোল ফানুস, চারকোণা ফানুস, হার্ট ফানুস। প্রতিটি ফানুসের দাম ৫০-১৫০ টাকা পর্যন্ত। ফানুস থেকে বিভিন্ন জায়গায় আগুন লাগার ঘটনা এবং আতশবাজি থেকে বিকট শব্দ দূষণ হওয়ায় এসব বিক্রি ও ব্যবহারে থাকছে নিষেধাজ্ঞা। তবে এই নিষেধাজ্ঞা মানছেন না বিক্রেতা ও ক্রেতারা।

বাবার হাত ধরে পুরান ঢাকার শাঁখারীবাজারে ঘুড়ি কিনতে এসেছে সপ্তম শ্রেণির রায়হান। কিনেছে বাহারী রঙের ঘুড়ি। রায়হান বলেন, ‘ছোট থেকেই আমরা সাকরাইন পালন করে থাকি। প্রতি বছর আমি বাবার সাথে ঘুড়ি, সুতা, ফানুস কিনতে আসি। আমরা এদিন সবাই অনেক মজা করি।’

সাকরাইন উপলক্ষে ধূপখোলা মাঠে ঘুড়ি কিনতে এসেছেন ষাটোর্ধ কাইয়ুম শেখ। তিনি বলেন, ‘এককালে বহুত ঘটা কইরা হগলে সাকরাইন করতাম। সব আত্মীয়রা এইদিনে (পুরান ঢাকায়) আইতো। আমগো কাছে এইডা ঈদের দিনের মতো। ঈদের দিনের মতো। এই ধূপখোলা মাঠে সারাদিন ঘুড্ডি উড়াইতাম আমরা। ওহনো এইডা আমাগো পোলা-মাইয়ারা ধইরা রাখছে।’

শাঁখারীবাজারের ঘুড়ি বিক্রেতা প্রহ্লাদ কান্তি বলেন, ‘আগে আমাদের বিক্রি খুব ভালো ছিল। করোনা না থাকলে আরও বেশি হতো। এখন চাহিদা কম। আগে দিনে ১০-২০ হাজার ঘুড়ি বিক্রি হতো, এখন কম।’ সুব্রত দে নামে একজন বিক্রেতা বলেন, ‘করোনার জন্য আমাদের বিক্রি একটু কম।’

আজ রোদের তীব্রতা যত বাড়বে তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছেয়ে যাবে পুরান ঢাকার আকাশ। দেখলে মনে হবে যেন আকাশজুড়ে ঘুড়ির মেলা বসেছে। হবে ঘুড়ি কাটার প্রতিযোগিতা। সন্ধ্যা নামলেই আকাশ ছেয়ে যাবে ফানুসের দখলে। উড়ানো হবে রং-বেরঙের ফানুস। মুখে আগুন নিয়েও কসরত দেখায় অনেকে। এটা আগুনের খেলা। ফুটানো হবে আতশবাজি। ডিজে গানের সঙ্গে নেচে উঠবে কিশোর-তরুণ-যুবারা। 

আরও পড়ুন

সাকরাইন উৎসবে ফানুস নিষিদ্ধ