মতামত

অস্থির প্রাণ রাসেল

রাসেল কয়েক বছর আগে বিস্তর প্রযুক্তিগত সুবিধা সম্বলিত একটি কম্পিউটার উপহার পেয়েছিল ওর এক বন্ধুর কাছ থেকে। আমাকে ফোন করে জানিয়েছিল খবরটা। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে- রাসেলের সেই কম্পিউটার এখন কে ব্যবহার করে?

আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে রাসেলের ঘরের বইপত্রগুলো কে নেড়েচেড়ে দেখে? আর ওর লেখার খাতাটা, যেখানে একটা ধারাবাহিক নাটকের পরিকল্পনা লেখা আছে, সেটার কী হলো? রাসেল নিজে একটা অমিমাংসিত রচনার অংশ হিসেবে শেষ দৃশ্যে নিজেই নিজের জীবনের প্রদীপ নিভিয়ে দিয়ে ফিরে গেছে।

ফেরাই তো তাই না? পৃথিবীর অস্থির প্রাণেরা তো ফিরেই যায়। তারা সমাহিত হয় না। ফিরে গিয়ে হয়তো আরেকটা সংসারে লেখা লিখে, ভাবনা দিয়ে, অনর্গল কথা বলে বলে, রাত জেগে আর অবেলায় ঘুমিয়ে থেকে আরও কিছু মানুষকে অস্থির করে তোলে। রাসেলের কাছে গিয়ে মানুষ অস্থির হতো কেন? ছেলেটির গুণের পাশাপাশি একটা টান ছিলে ওর আত্মার ভেতরে। সেই টানটা ঝট করে আরেকজন ব্যক্তিকে দখল করে ফেলতো। এই শহরে রাসেলের দখল করে নেয়া কত যে মানুষ আছে তার ইয়ত্তা নেই।

রাসেল ও নীল সাংবাদিকতা করেছে, নাটকের স্ক্রিপ্ট লিখেছে, সফল গীতিকারও ছিল। রাসেল কথা দিয়ে কথা রাখেনি, দিনের পর দিন ফোন কল রিসিভ করেনি, ওর হাতের লেখা খুব বাজে ছিল তাই নাটকের পরিচালকরা পড়তে পারতো না, ও মাথার ভিতরে অদ্ভুত সব ভাবনা নিয়ে ঘুরতো, ওর অবিশ্রান্ত রসিকতায়  হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যেত মানুষের।

নিজের জীবন নিয়ে রসিকতা করতে ভালোবাসতো রাসেল ও নীল। নিজেই প্রশ্ন করতো, আমার জীবনে এত কমেডি ঘটে কেন বলতে পারো? সেই কমেডিগুলো কখনও ছিল জীবনের গভীর ট্র্যাজেডি। কিন্তু রাসেলের মুখ ম্লান হতে দেখিনি। গত পঁচিশ বছরে অসংখ্যবার রাসেলের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে, একসঙ্গে খেয়েছি, ঘুমিয়েছি, নাটকের স্ক্রিপ্ট লিখেছি কিন্তু তাকে হাসি ছাড়া কখনও দেখিনি। 

রাসেলের একটা সিগারেট রাখার কেস ছিল, হাতে এবং এক পায়ে  চামড়ার ব্যান্ড বাঁধা থাকতো, গলায় একদা মাদুলি ধরনের বস্তু ঝুলতো। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে সেই পরমপ্রিয় জিনিসগুলো রাসেলের মতোই অবহেলাভরে কোথায় খুঁজে নিয়েছে অজ্ঞাতনিবাস? রাসেলের মতো মানুষরা কোথায়, কতদূর চলে গিয়ে আর ফিরে আসে না? 

রাসেলের ভেতরে দুটি প্রাণ একসঙ্গে বেঁচে থাকতো। একটি প্রাণ গভীর মনোযোগে ভাবনা আর কাজ গুছিয়ে রাখতো, আর অন্যটি এক ফুঁয়ে সব স্থিতি উড়িয়ে দিয়ে হারাতো সন্ধ্যার বাতাসে। আসলে রাসেল এমনই ছিল। ও এক সরল আত্মায় পরিচালিত মানুষ ছিল। 

টুপ করে বালক হারালো ভুল জলে। সামান্য তরঙ্গ, একটা ঘুমহীন রাত, কয়েকটা দিন মনের মধ্যে বিষাদের হাওয়া ঘুরে যায়। স্মৃতি ভিড় করে...তারপর? তারপর আমাদের সামনে সেই ছোট্ট পুকুরটা আবার নিস্তরঙ্গ। কারো টুপ করে ডুবে যাওয়ার গল্পটা ইতিহাস। রাসেল মানে, আপনাদের রাসেল ও নীল চলে গেল। নিজের হাতেই নিজের জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দিলো। 

‘বালক’ বললাম রাসেলকে। কারণ ও আমার কাছে গত কুড়ি পঁচিশ বছর ধরে বালক-ই। এই শহরের এক অস্থির প্রাণ। একদিন এসেছিল এখানে, ভুলে জলে নেমে সাঁতার কাটতে চেয়েছিল। কতদূর গেলো রাসেল? যতদূর দেখি, সে পথ বিচ্ছেদের। তার আত্মার নিচে যে চমৎকার আয়নাটা ছিল সেটা ভেঙে চুরমার হয়ে আছে দেখি। মনের মধ্যে ছড়িয়ে থাকলো ছোট ছোট ভাঙা কাচের মতো রাসেলের স্মৃতি।