শিল্প ও সাহিত্য

সৈয়দ শামসুল হকের কবিতা: ইতিহাস-ঐতিহ্য ও পুরাণপ্রসঙ্গ

গল্প-উপন্যাস-নাটক-প্রবন্ধ সবখানেই সাফল্যের কারণে সব্যসাচী হিসেবে আখ্যায়িত হলেও সৈয়দ শামসুল হক (১৯৩৫-২০১৬) যে মূলত কবিই ছিলেন, একথা কেবল সত্যই নয়; তিনি নিজেও কবি পরিচয়ে অধিক শ্লাঘা অনুভব করতেন। পঞ্চাশের দশকে বাংলা কবিতায় আবির্ভূত হয়ে উত্তরোত্তর সমৃদ্ধির শিখরের দিকে যে-কজন কবি এগিয়ে যেতে সমর্থ হয়েছিলেন, সৈয়দ শামসুল হক তাদের অন্যতম। অনেক ধরনের কবিতায় পারদর্শী এই কবি শিল্প-সাহিত্যের চর্চায় কখনও শ্লথ হননি, নির্মাণকল্পে ছাড় দেননি।

সাহিত্যের অন্যান্য শাখার মতো কবিতার ক্ষেত্রেও তিনি নিরীক্ষাপ্রবণ ছিলেন। প্রথাগত ছন্দের সঙ্গে প্রথাহীন ছন্দেও লিখেছেন অনেক কবিতা। প্রতীচ্য সাহিত্য সম্পর্কে বিস্তর ধারণাসত্ত্বেও কবিতার বিষয়-বক্তব্যে, অধিকাংশক্ষেত্রেই সৈয়দ হক ইতিহাস ও ঐতিহ্যলগ্ন ছিলেন। প্রাচ্য পুরাণকেই বেছে নিয়েছিলেন হৃদয়ের হাতিয়ার।

সৈয়দ হক যে ব্যাপকভাবে ইতিহাস-ঐতিহ্য ও পুরাণ নির্ভর ছিলেন, তাঁর কবিতা রাজ্য এ কথার সাক্ষ্য দেয়। সমকালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কবি শামসুর রাহমান গ্রিক পুরাণের বিপুল ব্যবহারকেই কবিতার এক ভিন্ন নিয়তি বানিয়েছিলেন। অন্যদিকে শামসুল হক আপন ঐতিহ্য, তথা ভারতীয় পুরাণকেই প্রধান পাথেয় করেছেন। তাঁর অনেক কবিতায় অত্যন্ত প্রতিপত্তিসহকারে ভারতীয় পুরাণ, বিশেষত বাঙালির লোকপুরাণের অনুষঙ্গসমূহ হাজির হয়েছে। বাঙালি পাঠকের জন্যে কবির অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপহার ‘বৈশাখে রচিত পঙ্ক্তিমালা’। এই কাব্যে কবি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে উচ্চারণ করেছেন:

‘আমারও সংসার হবে- শিল্পের সংসার। চন্দ্রাবতী হবে বোন, কালিঘাটে আত্মীয় আমার। আমি জানি মনসার ক্রোধ মানে মানুষের জয়, চাঁদ রাজা হার মানে। লৌহ বাসরের  কালছিদ্রে চোখ রেখে আমি কালরাতে পূর্ণিমা ধবল দেহে আজো জেগে থাকি।’

একইসঙ্গে পৌরাণিক ও ঐতিহ্যিক এ-ধরনের প্রয়োগ সৈয়দ হকের কবিতায় হামেশাই দেখা যায়। এমনকি ঐতিহাসিক অনুষঙ্গের ভেতরেও অবলীলায় তিনি অনুভব করিয়ে দেন পুরাণের স্বাদ। বাংলার প্রথম নারী কবি চন্দ্রাবতী একইসঙ্গে কিংবদন্তিও, আর কালিঘাট তো গঙ্গাতীরেরই বিখ্যাত স্থান, ঐতিহ্যগতভাবে খ্যাতি ও পবিত্রতার প্রতীক। দেবী হলেও কোপণস্বভাবের কারণে বাংলা কবিতায় মনসা বরাবরই নেতিবাচকতায় উপস্থাপিত, আর মানুষ হলেও চাঁদ রাজা তার দৃঢ়তার কারণে আমাদের চিত্তের আশ্রয়। ঈর্ষাপরায়ণ সর্পদেবী মনসা পূজাপ্রাপ্তির লোভে লৌহবাসরে সাপ ঢুকিয়ে হত্যা করেছিল চাঁদপুত্র লখিন্দরকে। চাঁদ সওদাগর বেহুলার অনুরোধে মনসাকে পূজা দিলেও নিতান্ত অবহেলা ও অবজ্ঞায়, বাঁ হাতে প্রদত্ত সেই পূজায় আসলে চাঁদ রাজারই জয় ঘোষিত হয়েছে। এজন্যেই কবি লিখেছেন- ‘মনসার ক্রোধ মানে মানুষের জয়’।  লোকপুরাণের অনবদ্য ব্যবহার রয়েছে ‘কবিসংঘের প্রতি’ কবিতাটিতে। কবি যখন বলেন- 

‘সন্ধ্যায় শাঁখের শব্দ, ফজরের পবিত্র কালাম, বাংলার বুকের মধ্যে বর্ণমালা নিয়ত সাজায়, তারই শব্দে শাকচুন্নী আজো মরে যায়। এমন বেগার কেউ খাটে বলে আজো এ বাংলায় জননীরা সন্তানের নাভি পুঁতে রাখে সব উৎসন্নতায়, প্রাচীন অক্ষরগুলো অঙ্গে পরে স্বপ্ন-ডিজাইন, পুনরায় নামে পরী বিষনীল দুপুর বেলায় পতিত বাংলায়।’

তখন আমাদের মানসচক্ষে চিত্রায়িত হয় শত শত বছর ধরে চলে আসা হিন্দু-মুসলমানের যৌথজীবন, তাদের সংস্কার-কুসংস্কার, স্বপ্ন-দুঃস্বপ্ন গাথা। অনুভব করতে পারি সেই মিথ-ঐতিহ্যে প্রভাবিত গ্রাম্যবাংলার প্রতি কবির মমতা। বাংলার ইতিহাস ও লোকপুরাণের সমন্বয় আছে ‘কবিতার তরুণ বেলাল’ কবিতাটিতে। ‘হুসেন শাহার কাল’, ‘মিনার’, ‘ত্রিশূল’, ‘রূপসনাতন’, ‘বায়েজিদ বোস্তামি’... সব মিলিয়ে অসাম্প্রদায়িক মিথ ও সংস্কৃতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বলা যেতে পারে কবিতাটিকে।

সৈয়দ শামসুল হক দীর্ঘ কবিতার অনন্য রূপকার। দীর্ঘ কবিতার প্রায় প্রত্যেকটিতেই কোনো না কোনোভাবে ইতিহাস-ঐতিহ্য-পুরাণের সংস্পর্শ রয়েছে। ‘সংহিতা’ নামক একটি দীর্ঘ কবিতায় প্রেম, প্রিয়তমার জন্য আকুলতা এক রোম্যান্টিক আবহ ধরে এগিয়ে যেতে যেতে পৌরাণিক অনুষঙ্গকেও আত্মীকরণ করে নিয়েছেন। 

‘আমাদের যুগল শরীর ঘিরে চন্দনের ঘ্রাণ তুমি এঁকে দিয়েছিলে, বিবাহের আলপনা করেছিলে আলোয় ছায়ায়?- যেন কোনো অশুভের ছিপ এসে পার্বতীর কপালে না চিহ্ন রেখে যায়...’

এখানে ‘চন্দনের ঘ্রাণ’ শুধু ঘ্রাণ নয়, অমঙ্গলকে দূরে রাখার প্রচলিত মিথের সমার্থক, আর পার্বতী তো ভারতীয় পুরাণেরই বিখ্যাত চরিত্র, পতিপ্রেমে যার খ্যাতি রয়েছে। এ-কবিতায় সিন্ধুসভ্যতার ‘মহেঞ্জোদারো’ এসেছে ইতিহাস-ঐতিহ্যের প্রতি অনুরক্ততা থেকেই। 

ভারতীয় পুরাণের যে-উৎসটি কবি-সাহিত্যিকদের কাছে সর্বোচ্চ আদরণীয়, সেটি মহাভারত। মহাভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা অর্জুন; দুহাতে শরসন্ধান করতে সমর্থ এই পাণ্ডবকে, বাস্তব ইতিহাসের সুবিখ্যাত চরিত্র লেলিনের সাথে মিলিয়ে কিংবদন্তি যাত্রাভিনেতা অমলেন্দু বিশ্বাসের উপরে আরোপ করে সৈয়দ হক লিখেছেন ‘মধুসূদনরূপে অমলেন্দু বিশ্বাসকে দেখে’ কবিতাটি। এখানে শুধু মধুসূদন নয়, আরও অনেকরূপেই যে অমলেন্দু ছিলেন অনন্য, সেকথা বলতে গিয়ে এক পর্যায়ে পৌরাণিক অর্জুনের সব্যসাচী বৈশিষ্ট্যের শরণাপন্ন হয়েছেন- 

‘আপনি অর্জুন, আপনি লেলিন। আমরা আপনাকে দেখেছি নয়ারহাটে নদীর পাশে পুলিনে কুরুক্ষেত্রের পূর্বমূহুর্তে উদিত সূর্যকে প্রণাম করতে’

ব্যাখ্যা না করলেও বোঝা যায়, কবির এই আকাঙ্ক্ষা ঐতিহ্যের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে প্রসূত। এবং একইসঙ্গে বর্তমানও সেখানে শুভ-আকাঙ্ক্ষার আলোকে প্রতিফলিত।কবিতার জন্ম হতে পারে যে-কোনো জায়গা বা বিষয় থেকেই। বর্তমানের বিবিধ ঘটনাবলি থেকে যেমন, তেমনি অতীত ইতিহাস এবং পৌরাণিক অনুষঙ্গও জন্ম দিতে পারে কবিতার পঙ্ক্তি। ‘কবিতার ব্রতকথা’য় কবি যেমনটা বলেছেন-

‘ফোরাতের রক্তভেজা প্রান্তর থেকে কবিতা, চৈতন্যের খাম থেকে কবিতা, কৃষ্ণের নীল শরীর থেকে কবিতা...’

প্রত্যেকটি অনুষঙ্গই ঐতিহ্যিক ও পৌরাণিক। ভারতীয় পুরাণ কিংবা আরবীয় পুরাণ, কবিতা যে সর্বজন্মা, সে-কথারই প্রতিধ্বনি আছে এই পঙ্ক্তিগুলোতে। এমনিভাবে ইতিহাস-ঐতিহ্যকে হৃদয়ে ধারণ করে ‘তোমাকে তুলনা করি’সহ আরও বেশকিছু কবিতা লিখেছেন কবি। সকল কবিতাই অসাম্প্রদায়িক চেতনার দীপ্তিতে ভাস্বর।  

সৈয়দ শামসুল হকের পুরাণ বা ঐতিহ্যচেতনা মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ সবখানেই প্রতিফলিত। একাত্তরের পঁচিশে মার্চের সেই ভয়াল রাতের কথা আমরা জানি। ‘একাত্তরের পঁচিশে মার্চের অসমাপ্ত কবিতা’য় গণহত্যার সেই রাতটিকে মিথের সাহায্যে আরও চিত্রময় করে তুলেছেন কবি। ‘ঈশ্বরের রাজপথ রক্তে ভেসে যায়। / স্বর্গীয় ফলের মতো ফেটে যায় বাংলার আকাশ।’ অনুচ্চ কণ্ঠে, পরিমিত শব্দ ব্যবহারে অসামান্য এক চিত্রকল্প এসে হাজির হয় এই পুরাণ প্রভাবিত দুটি পঙ্ক্তিতে। পাক-হানাদার বাহিনীর অতর্কিত হামলা ও গণহত্যার সেই রাতের বীভৎসতাকে এমন অনন্য নান্দনিক ব্যঞ্জনায় চিত্রায়িত করা- জাতকবির চারিত্র বটে। একাত্তরের যুদ্ধকালীন বাস্তবতা নিয়ে লিখিত ইতিহাস-ঐতিহ্যসন্ধানী একটি কবিতা ‘একাত্তরের চিঠি : প্রাপক বনলতা সেন’। সৈয়দ হকের এই কবিতায় জীবনানন্দের নাম নেই, কিন্তু তাঁর বনলতাকে সামনে পেয়ে হানাদার বিপর্যস্ত বাংলার কঠিন-করুণ দিনগুলোর কথারই বিবরণ আছে। কবি লিখছেন-

‘এখন সূর্যের আলো পোড়াকাঠ অঙ্গারের কষ। যুদ্ধ কী করবো আমি! হৃৎপিণ্ডে এতখানি শোক- নদীবক্ষে ভাসে লাশ- বন্ধ সব জানালা দরোজা- বাতাসে উৎকট ঘ্রাণ পেট্রোলের সতত অস্থির।  মাংস কি কাঠের মতো চড়চড় পোড়ে? ব্যাবিলন নিমেষেই হয়ে যেতে পারে কি শ্মশান? 

এই কবিতায় মাৎসন্যায়, রাজা গোপাল, ফকির সন্ন্যাসী, তেভাগা আন্দোলন...এসব প্রসঙ্গও এসেছে ইতিহাসের পরম্পরার হয়ে।  

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বেশকিছু কবিতা লিখেছেন সৈয়দ শামসুল হক। কোনো কোনোটা হয়তো বঙ্গবন্ধুর জন্ম-মৃত্যু বা বিশেষ উপলক্ষ্যে। কিন্তু অধিকাংশ কবিতাতে সৈয়দ হকের স্বরটা চেনা যায়। স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর মর্যাদা সর্বোচ্চ। তাকে নিয়ে যে-কোনো লেখাতেও কবি শ্রদ্ধাশীল। মুজিব তো শুধু রাষ্ট্রীয় মর্যাদায়িত নামমাত্র নয়, মুজিব বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্যের এক গর্বোদ্ধত প্রতীক। তাই কবিতার শিরোনাম ‘মুজিবের রক্তাক্ত বাংলায়’ হলেও শুধু মুজিবেই আবদ্ধ থাকেন না কবি, ইতিহাস-ঐতিহ্য সবই ছুঁয়ে এগিয়ে যান মিথিক্যাল বৈশিষ্ট্যে। কিংবদন্তির উলঙ্গ সন্ন্যাসী, রাজা রামপাল, গরিবুল্লাহ, আবদুল হাকিম এদের নাম উচ্চারিত হয় সেই ঐতিহ্যের গরিমাকে বুকে নিয়ে। আর কবির বিখ্যাত ‘আমার পরিচয়’ কবিতাটির কথা তো বলাই বাহুল্য; ইতিহাস সেখানে শেকড়ের গভীরে প্রোথিত, ঐতিহ্য ও মিথের গৌরবে প্রতিষ্ঠিত। বাঙালির প্রাচীন সাহিত্য নিদর্শন চর্যাপদ, চাঁদ সওদাগরদের ডিঙার বহর, এ-মাটির প্রাচীন প্রতিনিধি কৈবর্তদের বিদ্রোহ, পালদের চিত্রকলা, বৌদ্ধ বিহার, জোড়বাংলার মন্দির-মসজিদ, আউল-বাউল, বারো ভুঁইয়া, কমলার দীঘি, মহুয়ার পালা, গীতাঞ্জলি-অগ্নিবীণা, তিতুমীর-ক্ষুদিরাম-সূর্যসেন অবন ঠাকুর-জয়নুল এসব পার হয়ে শেষে শেখ মুজিবকে মাথায় তুলে নিয়েছেন জনকের মর্যাদায়।

‘পরিচয়ে আমি বাঙালি, আমার আছে ইতিহাস গর্বের- কখনোই ভয় করিনাকো আমি উদ্যত কোনো খড়গের। শত্রুর সাথে লড়াই করেছি, স্বপ্নের সাথে বাস; অস্ত্রেও শান দিয়েছি যেমন শস্য করেছি চাষ; একই হাসিমুখে বাজায়েছি বাঁশি, গলায় পরেছি ফাঁস; আপোষ করিনি কখনোই আমি- এই হলো ইতিহাস।

এই ইতিহাস ভুলে যাবো আজ, আমি কি তেমন সন্তান? যখন আমার জনকের নাম শেখ মুজিবুর রহমান; তারই ইতিহাস প্রেরণায় আমি বাংলায় পথ চলি- চোখে নীলাকাশ, বুকে বিশ্বাস পায়ে ঊর্বর পলি। 

এই কবিতায় কবি কেবল নিজের ব্যক্তিগত পরিচয় দেননি, এই পরিচয় আসলে বাঙালির সামষ্টিক পরিচয়, যে-কোনো বাঙালিরই প্রকৃত পরিচয়। ব্যক্তিক অনুভূতির মোড়কে নৈর্ব্যক্তিক আবেদন জাগানিয়া এই কবিতাটি সৈয়দ হকের ইতিহাস-ঐতিহ্য-পুরাণলগ্নতার দীপ্ত মাইলস্টোন।