‘আমার যখন আট বছর, বাবার তখন শ্বাসকষ্ট অসুখ হয়। নৌকা আর চালাতে পারেন না। বাবার ওষুধ কেনার টাকা নেই, ঘরে খাবারও নেই। কী করি? খেয়া ছাড়া আমাদের তো আয় নাই। বাবা একদিন ডেকে বললো- নে মা, খেয়া পারাপার শিখায়া দেই। বাবা আমারে কোলে বসাইয়া হাতে বৈঠা ধরাইয়া দিয়া নৌকা পারাপার শিখায়া দিছিল।’
বলছিলেন লিলি আক্তার। তিনি বরগুনা সদর উপজেলার ঢলুয়া ইউনিয়নের পোটকাখালীর মৃত ফটিক উদ্দিন মাঝির মেয়ে। শিশুকাল থেকেই খাকদোন নদীর সঙ্গে তার গভীর মিতালী। জীবনটাই যে বয়ে নিয়ে চলেছে তার। এই নদীর বুকেই নৌকা চালিয়ে চলছে লিলির সংগ্রামী জীবন।
লিলির জমি নেই। থাকার মতো ঘরও নেই। নদীর পাড়ে ছোট একটি ঝুপড়িতে থাকেন। ঘরের ঠিক নিচেই নোঙর করা থাকে নৌকা। তার জীবন। নদীর পাড়ে মাটিতে গাঁথা ঘরের খুঁটিতে সিঁড়ির মতো তৈরি করা। যারা নদী পার হন সবাই তাকে চেনেন। ঘাটপাড়ে দাঁড়িয়ে হাঁক দিলেই সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসেন লিলি। এরপর নোঙর খুলে বৈঠা হাতে জলের বুকে ছলাৎ ছলাৎ শব্দ তুলে চলেন গন্তব্যে।
স্থানীয়রা জানান, প্রথমে চাচাতো ভাই জাকিরের সঙ্গে বিয়ে হয় লিলির। স্বপ্ন ছিল ভাগ্য পরিবর্তনের, কিন্তু দুঃখে যাদের জীবন গড়া… বিয়ের ৮ বছরের মাথায় ভাঙে লিলির ঘর, লিলির স্বপ্ন। জাকির তাকে তালাক দিয়ে চলে যায়। আর ফিরে তাকায় নি। লিলিও বেছে নেয় অন্যঘর। ২০০১ সালে ঢলুয়া গ্রামের নাসিরের সঙ্গে তার দ্বিতীয় বিয়ে হয়। নাসিরও পানির মানুষ। গভীর সমুদ্রে যখন সে মাছ ধরতে যায় তার দুচোখে উঁকি দেয় রুপালি ইলিশ।
মাত্র আট বছর বয়সে বাবা লিলিকে নৌকা চালানো শিখিয়েছিলেন। লিলি এখন ৩৬। তিন মেয়ের দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন; এই নৌকা চালিয়ে আয়ের পয়সায়।
তিন ভাই-বোনের মধ্যে লিলি ছিল সবার ছোট। কিন্তু আদর মেলেনি। সে তুলনায় দায়িত্ব মিলেছে ঢের বেশি। লিলি যথাসাধ্য সে দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করেন সংসারে। বিশেষ করে ২০০৫ সালে বাবা মারা যান। বৃদ্ধা মা এখনো বেঁচে। বড় বোনের বিয়ে হয়েছে। ভাই আলাদা থাকেন। তবে তারা মায়ের তেমন খোঁজ নেন না। তাই বাবার মৃত্যুর পর থেকে মায়ের দেখভাল, ভরন-পোষণ ও চিকিৎসার সব খরচ লিলি বহন করেন।
তবে হ্যাঁ, দ্বিতীয় ঘরে এসে সুখের মুখ কিছুটা হলেও দেখেছেন লিলি। স্বামী নাসিরের কণ্ঠে শোনা গেল সেই সুর। ‘সব জেনেশুনেই লিলিকে বিয়ে করি। ও খুব ভালো মেয়ে। নিজে খেটে কামাই করে। আমি নিজেও অন্যের নৌকায় সাগরে যাই। ওর রোজগারে পরিবারের খুব উপকার হয়।’ বলেন নাসির।
নৌকা পারাপারের গল্প বলতে গিয়ে লিলি বলেন, ‘আমি যখন নৌকা পারাপার শুরু করি তখন দিতে হতো চারআনা। টাকা-পয়সার বদলে কেউ কেউ ধান, মিষ্টি আলু দিত। বছর শেষ হলে ধান আর আলু দিয়ে যেত তারা।’
আর এখন? প্রশ্ন করতেই লিলি বলেন, ‘এখন ৫ টাকায় পার করি। গড়ে প্রতিদিন দেড়শ টাকা আয় হয়।’ তবে লিলির আরেকটি অর্জন আছে। উভয় পাড়ের মানুষ লিলিকে ভালোবাসে। কেউ ডাকে ‘নানী’, কেউ ডাকে ‘আফা’। সবাই টাকা দেয়, কেউ ঠকায় না। দু’একজন দু’চার টাকা বেশিও দেয়। এর উল্টোটাও ঘটে। টাকা না থাকলে লিলি তার সামনে হাত বাড়ান না।
দিনে প্রায় ১০ ঘণ্টা বৈঠা বাইতে হয়। হাতে ফোসকা পড়েছে। ফলে হাত দিয়ে এখন অন্য কোনো কাজ করতে পারেন না লিলি। কিন্তু হাতের চিকিৎসা করাতে পারছেন না। আয়ের সিংহভাগ চলে যায় অসুস্থ মায়ের চিকিৎসার খরচে। এরপর আছে সংসার খরচ। তবে নৌকায় ইঞ্জিন লাগাতে পারলে বৈঠা চালানোর কষ্টটা অন্তত কমতো। লিলি বলেন, ‘বেশি কিছু না, একটা স্যালো ইঞ্জিন আর পরিবার নিয়ে থাকার জন্য একটা ঘর হলেই আমি খুশি।’
লিলিকে নিয়ে কথা হয় বরগুনার জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমানের সঙ্গে। সব শুনে তিনি বলেন, ‘জীবনসংগ্রামে প্রতিনিয়ত সংগ্রামী এক নারী লিলি। বৈঠা দিয়ে তার নৌকা চালানোর বিষয়টি নজিরবিহীন। আমরা তাকে বাছুরসহ একটি গাভি উপহার দিয়েছি। তারপরও কিছু করা যায় কিনা, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে আপনাদের জানাব।’