ফাগুনের মলাট

নিষিদ্ধশয্যা: যৌনকর্মীর জীবনের ট্র্যাজেডিতে সমাজপিতাদের দায় 

হানা ক্যাথারিন মুলেন্সের (১৮২৬-৬১) লেখা ‘ফুলমনি ও করুণার বিবরণ’ বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস। প্যারীচাঁদ মিত্রের ‘আলালের ঘরের দুলাল’র (১৮৫৮) মধ্যে উপন্যাসের লক্ষণ দৃষ্টিগোচর হলে সাহিত্য সমালোচক মহলে আলোচনা হয় এটিও একটি উপন্যাস। তবে প্রায় সবাই একবাক্যে মেনে নিয়েছেন, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের (১৮৩৮-৯৪) ‘দুর্গেশ নন্দিনী’ বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক উপন্যাস। তিনি প্রকৃতপক্ষে আধুনিক বাংলা উপন্যাসের স্রষ্টা। 

ক্যাথারিন, প্যারীচাঁদ ও বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পথ ধরেই এগিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১)। গল্প ও উপন্যাসে তিনি ঈর্ষণীয় অবস্থানে নিজেকে নিয়ে গিয়েছেন। ব্যক্তির মন ও মননের অপূর্ব সমন্বয়ে রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসগুলো অসাধারণত্ব অর্জন করেছে। যেখানে বঙ্কিমের উপন্যাসে সমাজ ও পারিপার্শ্বিক চাপে কিংবা দ্বন্দ্বে ব্যক্তি তার আত্ম অবস্থান তুলে ধরতে কিংবা সফল হতে পারেনি, কেন্দ্রীয় চরিত্র সীমাহীন দুর্ভোগ ও লাঞ্ছনার শিকার হয়েছে, সেখানে রবীন্দ্রনাথে এসে দেখা গেল নতুন কালের নারী ও পুরুষের অন্যরকম ব্যঞ্জনা। যারা মানবিক উৎকর্ষতার দীক্ষায় প্রচলিত সামাজিক বিধান শুধু অস্বীকার করে থেমে থাকে না, নারী-পুরুষের সমানাধিকারের ভিত্তিতে চেয়েছে আত্মপ্রতিষ্ঠা। 

সেই ধারাবাহিকতায় নগর জীবনের পটভূমি কিংবা পরম্পরা অক্ষুণ্ণ রেখে কবি ও কথাসাহিত্যিক জব্বার আল নাঈম নিয়ে এসেছেন উপন্যাস ‘নিষিদ্ধশয্যা’। এ উপন্যাসে সমাজ ও বাস্তবতার নিরীক্ষায় পিছিয়ে পড়া কিংবা অবমূল্যায়িত একজন যৌনকর্মীর টিকে থাকার সংগ্রামকে যেমন তুলে এনেছেন লেখক তেমনই মিথ, ইতিহাস, ইসলামি তত্ত্ব, সমকালীন রাজনীতি এবং চলমান ঘটনাপ্রবাহকে জড়ো করে যেভাবে অসংখ্য টুকরো টুকরো গল্প গেঁথেছেন তাতে আমার মনে হয়েছে- দীর্ঘ প্রস্তুতি নিয়েই জব্বার নিজের অস্তিত্ব জানান দিতে এসেছেন। তাছাড়া, মাটির পৃথিবীতে বাস করেন এমন কোনো লেখক যতই নান্দনিকতার দোহাই দিক না কেন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে হলেও তারা যে রাজনীতির বৃত্ত থেকে মুক্ত হতে পারেন না জব্বার এ উপন্যাসে জোর দিয়ে জানিয়ে গেছেন সেটাও। 

২. নারীকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা, সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত রাখা ও জোর খাটিয়ে ব্যবহার করার মতো ব্যাপারগুলো সভ্য জগৎ ব্যবস্থার প্রতি কঠোর কশাঘাতস্বরূপ। তা সত্ত্বেও আমাদের এখানে রয়েছে নারীকে নিপীড়ন-নির্যাতনের এক করুণ ইতিহাস, যা দিয়ে গল্প-উপন্যাস লেখার মতো প্রচুর তথ্য-উপাত্তও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এমন একটি প্রেক্ষাপটকেই নিষিদ্ধশয্যা উপন্যাসে উপজীব্য করেছেন জব্বার। নামকরণের কারণে বইটি নিয়ে আগে থেকেই আমার বিশেষ উৎসাহ ছিল। তবে পড়তে পড়তে যুগপৎভাবে বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ হয়েছি। একজন যন্ত্রণাক্লিষ্ট নারীর অসহায়ত্ব আর মর্মবেদনা অনুভব করার পাশাপাশি তার বেদনায় আক্রোশে ফুঁসে উঠেছি বহু জায়গায়। এর পাশাপাশি আলেয়ার চরিত্র অঙ্কন করতে গিয়ে পতিতাদের জীবনের চরম অমোঘ নিয়তিকে যেভাবে তুলে এনেছেন জব্বার- তাতে আমার মনে হচ্ছিল, এতো কেবল ভাগ্যের কাছেই হেরে যাওয়া! 

আমাদের এখানে প্রচলিত আছে- পুরুষ লেখকদের কথায় নারীর কথা থাকলেও, নারীর একান্ত অনুভব আর অভিজ্ঞতার যা- পুরুষ লেখকরা তার বাস্তব রূপ সহজে আঁকতে পারেন না। ‘নিষিদ্ধশয্যা’ উপন্যাসটি পড়ার পর সেই ধ্যান-ধারণায় পরিবর্তন এসেছে। উপন্যাসজুড়ে লেখক একজন স্বার্থক নারী চরিত্রই নির্মাণেই প্রাধান্য দিয়েছেন। এখানে যেমন লেখক উপন্যাসের প্রধান চরিত্র স্বপ্নার মর্মবেদনা ফুটিয়ে তুলেছেন তেমনই তুলে ধরেছেন তার জীবনের নানা সংকট, সংশয় ও টানাপড়েনও।

জব্বার রাজনীতি সচেতন লেখক, রাজনীতিকে প্রত্যক্ষ করেছেন একেবারে কাছে থেকে। ফলে একজন যৌনকর্মীর জীবনের সমস্ত গ্লানি ও কষ্টকর দিকগুলো তুলে ধরতে যেয়ে সমকালীন নোংরা রাজনীতিকেও অত্যন্ত চমৎকারভাবে লেখনীর অনুষঙ্গ করে তুলেছেন। এখানে সেই সময় আর রাজনীতিকেই তুলে এনেছেন লেখক- যেখানে নারীর চলার পথ কন্টাকাকীর্ণ হয়ে ওঠে। ফলে তার লেখায় সাবলীলভাবে উঠে এসেছে রাজনৈতিক দলের প্রধান সেলিম ঠাকুর, তার অনুগত এমপি আলাউদ্দিন মিজি, মখলেস চেয়ারম্যানের মতো নেগেটিভ চরিত্রগুলো। যারা তাদের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য, ক্ষমতায় যাওয়ার সিড়ি হিসেবে বিভিন্নভাবে স্বপ্নাকে ব্যবহার করেছেন বা করতে চেয়েছেন অথচ প্রয়োজন শেষে ছুড়ে ফেলতে দু’বার ভাবেন নি। 

সমাজ, বাস্তবতা, রাজনীতি, হানাহানির মাঝেও প্রেমের প্রসঙ্গ ভুলে যাননি লেখক। বরং দুই মেরুতে অবস্থান ও বয়সের একটি বড় পার্থক্য থাকলেও নারী-পুরুষের চিরন্তন ভালোবাসার প্রস্ফুটন দেখিয়েছেন নিষিদ্ধশয্যায়। যদিও প্রেমের পরিণতি পুরোপুরি খোলাসা করেন নি। এ প্রেম স্বপ্নার সাথে পুষ্পশয্যা প্রপার্টিজ এর এজেন্ট আজিজের। যে প্রেমের শুরু কিংবা পরিণতিটা অন্য আট-দশটা প্রেমের মতো নয়। যেখানে স্বপ্নার অপূর্ব রূপের চাইতেও ব্যক্তিত্বই আজিজকে আকর্ষিত করে। অর্থাৎ একজন যৌনকর্মীর প্রেম আঁকতে গিয়ে লেখক কোথাও ভোগের সামগ্রী হিসেবে তাকে উপস্থাপন করেন নি। নিরেট মানবীয় প্রেমকেই তুলে ধরেছেন। যেখানে একসময় স্বপ্নাও ধীরে ধীরে নির্ভরতা বাড়াতে থাকে আজিজের প্রতি। অর্থাৎ দুই মানব-মানবীর ভেতরে চিরন্তন প্রেমকে ফুটিয়ে তুলতে গিয়ে সমকালের বেশিরভাগ লেখক যে পথে হাঁটেন জব্বার সে পথে হেঁটে কেবল রূপজ মোহকেই বড় করে দেখান নি। ব্যক্তিত্বকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। তবে মানসিক দ্বন্দের বিচিত্র বহিঃপ্রকাশ তাদের ভালোবাসাকে স্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তুলতে না পারলেও একেবারে শেষে স্বপ্নার ক্ষোভ মিশ্রিত অভিব্যক্তিতে আজিজের প্রতি তার ভালোবাসাকে পুরোপুরি স্পষ্ট করে দেয় পাঠকের সামনে। 

বাংলাদেশে সরকার যৌনকর্মীদের জন্য পতিতাপল্লী অনুমোদন করলেও মৃত্যুর পর একজন পতিতার দেহকে কি করা হবে তা নিয়ে কোনো লিখিত বা অলিখিত সনদ প্রদান করেনি। ফলে কিছু ব্যতিক্রম ক্ষেত্র বাদে এখনও কোনো পতিতার মৃত্যুর পর তাকে কাফনের কাপড় পরানো কিংবা জানাযা দেওয়া হয় না। এমনকি কোনো শ্মশানেও দাহ করা হয় না। নির্জনতায় মাটি চাপা দিয়ে পুঁতে ফেলা কিংবা বস্তাবন্দী করে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়াই যেন নিয়তি। অর্থাৎ বেঁচে থাকতে তারা যেই লাঞ্ছনা সহ্য করে, তারচেয়ে আরো বেশি সহ্য করে মৃত্যুর পরে। গল্পের শুরুতেই আমাদের এমন একটি প্রেক্ষাপটের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন লেখক। শুরুতেই দুই ভুবনের দুইজন মানুষের কথোপকথন। একজন স্বপ্না অন্যজন তার মা। যেখান থেকে আমরা জানতে পারি, মাকে কবর দিতে না পারার আফসোস মেয়ে স্বপ্নাকে কুড়ে কুড়ে খায়। 

অর্থাৎ শুরুতেই উপন্যাসের গতিপ্রবাহের একটা ইঙ্গিত পাওয়া যায়। বোঝা যায়, নিষিদ্ধশয্যা মূলত একজন নারীর জীবন সংগ্রাম আর আক্ষেপের গল্প। পড়তে পড়তে বারবার ঘোর লেগে যায়। না পাওয়ার বেদনা যেমন প্রতীয়মান হয়ে বারবার এসেছে, তেমনিভাবে অজস্রবার প্রতারিত হওয়ার আখ্যানও উপস্থাপিত হয়েছে। উপন্যাসটির প্রধান চরিত্র স্বপ্না তার মায়ের সাথে একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান সেলিম ঠাকুরের অবৈধ সম্পর্কের ফসল। 

৩.  স্বপ্নার পাশাপাশি এই উপন্যাসের অন্যতম প্রধান চরিত্র সেলিম ঠাকুর। আগাগোড়াই রহস্যঘেরা একজন। সে হিন্দু কি মুসলমান এ নিয়ে একটা ধন্ধ স্পষ্ট। ঔরসজাত হলেও স্বপ্না এবং ইকবালকে সন্তান হিসেবে স্বীকৃতি দিতে চায় না সে। এমনকি সম্পদের দাবিদার হয়ে ওঠা ইকবালকে খুন করতেও দু’বার ভাবে নি। স্থানীয়রা তাকে ভয় পায়। নামে মিল থাকায়, উপন্যাসটি পড়তে পড়তে কখনও কখনও খন্দকার মোশতাকের অন্যতম ঘনিষ্টজন এবং ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নারকীয় হত্যাযজ্ঞের অন্যতম কুশীলব তাহের ঠাকুরের সাথে তাকে মিলিয়ে ফেলছিলাম। তাহের ঠাকুরের মতো সেলিম ঠাকুরকেও আমার কাছে একইরকম রাজনৈতিক কুচক্রী বলে মনে হয়েছে। 

নিষিদ্ধশয্যায় লেখক একটি গল্প বলতে যেয়ে সে গল্পের ডালপালাকে বহুদিকে বিস্তৃত করেছেন। স্বপ্নার জীবনের চরম ট্রাজেডি কিংবা নিপীড়িত নারী সমাজের প্রতি আবহমান অবিচারের ভেতরেই বইটির বিষয়বস্তুকে সীমাবদ্ধ রাখেন নি তিনি, আমাদের ঘুণে ধরা সমাজব্যবস্থার নিন্দনীয় রূপকেও চোখে আঙুল দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন। এখানে ঘটনার উপস্থাপন ও বয়নকৌশল যেমন মুগ্ধকর তেমনই ভিন্নতর। অন্যদিকে, পুরো উপন্যাস জুড়ে লেখক বেশকিছু নীতিবাক্যের যথার্থ ব্যবহার করেছেন। এগুলোকে আমার কাছে সমাজ-রাজনীতি ও জীবন সম্পর্কে জব্বার আল নাঈম এর দীর্ঘ অভিজ্ঞতার ফসল বলেই মনে হয়েছে। যা উপন্যাসটিকে ভিন্ন একটি আঙ্গিক বা মাত্রায় নিয়ে গেছে। 

ভাগ্যহত নারীদের জীবন সংগ্রাম এবং বঞ্চনা অনুভব করতে হলে এ উপন্যাসটির পাঠ জরুরি। কারণ, উপন্যাস ‘নিষিদ্ধশয্যা’ সুবিধাবাদী পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিরাট চপেটাঘাত।