জাতীয়

বঙ্গবন্ধু জাগ্রত এক ইতিহাস

১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় চৈত্রদিনের গান, বসন্তকালের আলো-হাওয়া প্রবাহিত তখন, এরই মাঝে আবির্ভূত হলেন বাংলার সহস্র বর্ষের সাধনার নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সাধিত সেই ধন্য পুরুষের ১০২তম জন্মবর্ষে বাঙালি জাতি নতুন উদ্দীপনায় তাঁরই নির্দেশিত পথে মুক্তির রথে এগিয়ে চলেছে। ইতোমধ্যে জাতি পালন করেছে তাঁর পিতার জন্মশতবর্ষ, মুজিববর্ষ। উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন জাতীয় শিশু-কিশোর দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।

তিনি শুধু একটি নাম নন, জাগ্রত ইতিহাস। একটি স্বাধীন জাতিসত্তার অপরিমেয় অহঙ্কার, বর্ণিল ঐশ্বর্য। বঙ্গবন্ধু, বাঙালি এবং স্বাধীনতা একসূত্রে গাঁথা। বাংলাদেশের অস্তিত্বস্পর্শী অমর নাম। ন্যায়, সত্য, কল্যাণ এবং আত্মমুক্তির পক্ষে সোচ্চার উদার হৃদয় মহান মানুষ। কোনো প্রকার সংকীর্ণতা, গোঁড়ামি এবং সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প তাকে স্পর্শ করেনি কখনো। বাঙালিত্ব ছিল তার অহঙ্কার। এই বাঙালিকে তিনি জাগিয়ে তুলেছেন রাজনৈতিক এবং সাংগঠনিক দক্ষতায়। কোটি মানুষের ইচ্ছার অনিন্দ্য কুসুম ফুটিয়ে তুলেছিলেন তিনি। বাঙালি জাতি তাঁরই আহ্বানে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল যুদ্ধজয়ের রক্তাক্ত অধ্যায়ে। সৃষ্টি করেছিল ইতিহাস। জাতির শাণিত শিরায় অকুতোভয় সাহস ছড়িয়ে দিয়েছিলেন তিনি। দুঃসময়, হতাশার সব বাধার দেয়াল ভেঙে দীর্ঘ পরাজিত, শোষিত, বঞ্চিত জাতিকে স্বাধীনতার সূর্যস্নানে স্নাত করিয়েছেন। তাই তো প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম উচ্চারিত হয় ত্যাগের উজ্জ্বল মহিমায় সিক্ত একটি নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এই নাম অবিরাম প্রতি সূর্যোদয়ে, সূর্যাস্তে অক্ষয়-অম্লান। চিরদিন বাংলার আকাশে-বাতাসে-মাটিতে শৌর্যে-বীর্যে বহমান নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের প্রিয় নাম হয়ে প্রজ্বলিত যুগ থেকে যুগে।

‘জীবন-মৃত্যু পায়ের ভৃত্য’ হিসেবে জেনেছেন তিনি। ঘুমন্ত জাতির প্রতিটি শিরা-উপশিরায় রক্তপ্রবাহের উত্তাপ বঙ্গবন্ধু ধারণ করতেন। তাই জাতিকে নিজের মতো করে ধীরে ধীরে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। ইতিহাসের চাকা ঘুরিয়ে দিয়েছেন। হাজার বছর ধরে পরাধীন-পর্যুদস্ত থেকে যে জাতি আধমরা থেকে পুরো মরায় পরিণত হচ্ছিল ক্রমশ; বজ্রহুঙ্কারে শুধু নয়, আদরে-সোহাগে প্রাণের প্রবাহে স্পন্দন তুলে একটি বিন্দুতে এনে দাঁড় করিয়েছিলেন।

অভাব, বাসস্থানের অভাব, চিকিৎসার অভাব; এই অভাবের মাঝেও তিনি মনে করলেন যে সুশিক্ষার দরকার আছে এবং এ জন্য শুরু করতে হবে প্রাথমিক শিক্ষা থেকে। তিনি বাংলাদেশের সব প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকে জাতীয়করণের আওতায় নিয়ে এলেন। অর্থাৎ রাষ্ট্রীয়  কোষাগার শূন্য হলেও প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা সব রাষ্ট্রীয় কোষাগারের ওপর ন্যস্ত করলেন। একই সঙ্গে তিনি শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত বাধ্যতামূলক করে দিলেন। বাধ্যতামূলক ঘোষণা দিয়ে তিনি বসে থাকলেন না। তিনি সঙ্গে সঙ্গে সেটিকে অবৈতনিক করে দিলেন। কারণ তিনি জানেন যে বাংলাদেশে বহু পরিবার আছে যাদের ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠানোর মতো আর্থিক সংগতি নেই। অতএব এটা অবৈতনিক না করলে বাধ্যতামূলক অর্থপূর্ণ হয় না। তিনি অবৈতনিক করলেন।

একই সঙ্গে আবার তিনি বলে দিলেন, প্রাথমিক শিক্ষা হবে একমুখী। স্বাধীন বাংলাদেশের উপযোগী শিক্ষা। বাংলাদেশের ইতিহাস ঐতিহ্য সংস্কৃতি সমন্বয়ে যে শিক্ষা কার্যক্রম সেটি চালু করার জন্য তিনি নির্দেশ দিলেন। দেশে একমুখী শিক্ষা দিয়ে তিনি যে দর্শন আমাদের সামনে উপস্থিত করলেন, যেটি বঙ্গবন্ধুর সারা জীবনের দর্শন। সামনের বাংলাদেশ, মানবিক মর্যাদার বাংলাদেশ। সামাজিক ন্যায়বিচারের বাংলাদেশ। এগুলো আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণা। সেই ঘোষণায় স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা আছে যেটি বঙ্গবন্ধুর জীবন দর্শনের মধ্যে পাওয়া যায়। বঙ্গবন্ধু শিশুদের একই শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিলেন। কারণ, শিশুদের মনে যেন কোনো বৈষম্যবোধ সৃষ্টি না হয়। বিত্তবান পরিবারের ছেলেমেয়েরা এক ধরনের স্কুলে যাচ্ছে। বিত্তহীন পরিবারের ছেলেমেয়েরা আরেক ধরনের স্কুলে যাচ্ছে। এ ধরনের কোনো বৈষম্য থাকবে না।

বিত্তবান, বিত্তহীন নির্বিশেষে সব শিশু একই পোশাকে একই ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাচ্ছে এটি ছিল বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন। শিক্ষাব্যবস্থাকে তিনি কতটা গুরুত্ব দিয়েছিলেন তা বোঝা যায় যখন তিনি ড. কুদরত-এ-খুদার নেতৃত্বে একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। শিক্ষা কমিশনকে তিনি বলেন, আপনারা আমাকে একটি স্বাধীন দেশের উপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা সুপারিশ করেন। ড. কুদরত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন ১৯৭৪ সালে সম্ভবত ৭ জুন তারিখে বঙ্গবন্ধুর হাতে সেই সুপারিশ হস্তান্তর করে। বঙ্গবন্ধু সেদিন এই খসড়া রিপোর্ট গ্রহণ করে উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেছিলেন, আমি অতি দ্রুত এই শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়ন করব। এই রিপোর্টে মূল যে পরিবর্তনের কথাগুলো বলা হয়েছিল সেটি ছিল প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষা প্রথম শ্রেণী থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত থাকবে। প্রথম শ্রেণী থেকে অষ্টম শ্রেণী যে শিক্ষা এটি সারা দেশে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একই পাঠ্যক্রমে চলবে। একমুখী শিক্ষা হবে।

বঙ্গবন্ধুর যে ইতিপূর্বে ঘোষণা দিয়েছিলেন প্রাথমিক শিক্ষা হবে অবৈতনিক এবং বাধ্যতামূলক ও একমুখী। এই তিনটি বৈশিষ্ট্যই প্রথম শ্রেণী থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত কার্যক্রমে থাকতে হবে এই ছিল কুদরত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশনের সুপারিশ। নবম শ্রেণী থেকে দ্বাদশ শ্রেনী পর্যন্ত মাধ্যমিক শিক্ষা। এই নবম শ্রেণী থেকে দ্বাদশ শ্রেনী পর্যন্ত মাধ্যমিক শিক্ষা এটি সাধারণ শিক্ষার কার্যক্রমে থাকবে। ছেলেমেয়েদের যাদের ইচ্ছা তারা কারিগরি শিক্ষায় যাবে, ধর্মীয় শিক্ষায় যাবে। এখানে এসে একটি অপশন বা তাদের পছন্দ অনুযায়ী একটি ধারা নির্বাচনের সুযোগ দেওয়া ছিল। পরে মাধ্যমিক পর্যায়ে নবম-দশম, একাদশ-দ্বাদশ শ্রেনীর লেখাপড়া শেষ করে কেউ যদি উচ্চশিক্ষায় আগ্রহী হয় তার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষাব্যবস্থার সুপারিশ ছিল।

১৯৭৪ সালেই স্বাধীন বাংলাদেশে যে সুপারিশমালা প্রণয়ন করা হয়েছিল সেটি আজ উন্নত বিশ্ব যেভাবে শিক্ষাব্যবস্থা সাজিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করে সেইরকম একটি শিক্ষাব্যবস্থার সুপারিশ করেছিল কুদরত-এ-খুদার সেই শিক্ষা কমিশন। সেখানে প্রাথমিক শিক্ষাকে কতটা গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল সেটি বুঝা যায় যে, প্রজাতন্ত্রের শিক্ষাখাতে যত বরাদ্দ থাকবে তার ৬৫ শতাংশ বরাদ্দ করতে হবে প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে। ২০ শতাংশ বরাদ্দ করতে হবে মাধ্যমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে এবং ১৫ শতাংশ বরাদ্দ করতে হবে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে। অর্থাৎ পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকে যদি আমরা পিরামিড চিন্তা করি তাহলে পিরামিডের ফাউন্ডেশন বা ভীত সেটা হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষা। অতএব সেখানে প্রজাতন্ত্রের আর্থিক বরাদ্দের সর্বোচ্চ বরাদ্দ সেই জায়গায় দরকার আছে। কারণ, এখানে প্রজাতন্ত্রের সব শিশু বাধ্যতামূলকভাবে যাচ্ছে। অতএব সব শিশুকে মানসম্পন্ন শিক্ষা দেওয়াটা এটা প্রজাতন্ত্রের দায়িত্ব এবং বঙ্গবন্ধু সঠিকভাবে বিষয়টি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন।

১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে হত্যাকাণ্ডের শিকার হলেন। বঙ্গবন্ধু যে কথা বলেছিলেন, শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট আমি অত্যন্ত দ্রুত বাস্তবায়ন করব, সেটি আর তিনি বাস্তবায়ন করতে পারলেন না। বঙ্গবন্ধুর পর বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীরাই যেহেতু এ দেশ পরিচালনা করছে দশকের পর দশক, অতএব কুদরত-এ-খুদার শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট আর আলোর মুখ দেখেনি। এটাই হলো বাস্তবতা। পরে আমরা দেখেছি ১৯৭৫ থেকে ২০১০ এই পুরোটা সময় আমাদের দেশে কোনো শিক্ষানীতি ছিল না। অবশেষে ২০১০ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা একটি শিক্ষানীতি চূড়ান্ত করে জাতিকে উপহার দিলেন। এখন আমরা সেই শিক্ষানীতি নিয়ে এগিয়ে চলছি। আমরা যদি বঙ্গবন্ধুর কুদরত-এ-খুদা কমিশনের শিক্ষা রিপোর্ট সেই সময়ে বাস্তবায়ন করতে পারতাম দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, আজ ২০২১ সালে এসে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার বড় ধরনের উন্নয়ন আমরা লক্ষ করতাম। বঙ্গবন্ধু শিক্ষাকে যেমন গুরুত্ব দিতেন সেইভাবে তিনি শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের ভালোবাসতেন। বঙ্গবন্ধু শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে  চেয়েছিলেন। তিনি একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তনের মাধ্যমে গোটা দেশের শিক্ষা কার্যক্রম নতুন করতে সচেষ্ট ছিলেন।

১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে তিনি উপস্থিত হয়েছিলেন।  সেখানে তিনি বলেছিলেন, বাংলাদেশে কেরানি বানানোর শিক্ষার যে পদ্ধতি, সেটা আমি থাকতে দেব না। এটা পরিবর্তন করতে হবে। আমাদের দেশে কারিগরি শিক্ষার যে সম্প্রসারণ ঘটানো, এটার জন্যও বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা অপরিসীম। আমাদের দেশে বিএ, এমএ পাস বেকার লোকের সংখ্যা অসংখ্য। এটা নিয়েও বঙ্গবন্ধু কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, কেরানিগিরির শিক্ষাব্যবস্থা বন্ধ করতে হবে। পাশাপাশি কারিগরি শিক্ষার প্রসারে তিনি গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। তিনি শিশুশিক্ষার ক্ষেত্রেও অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। জীবদ্দশায় তিনি কোনোরকম কেক কেটে বা অনুষ্ঠান করে জন্মদিন উদযাপন করতেন না। তিনি শিশুদের নিয়ে জন্মদিনে আনন্দ করতেন। বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনের দিনটিই এখন আমাদের জাতীয় শিশুদিবস। বঙ্গবন্ধু সব সময়ই শিশুবান্ধব একটি রাষ্ট্র গড়ে তুলতে সচেষ্ট ছিলেন।

লেখক: মহাপরিচালক, প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি) ও একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক