জাতীয়

গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও বঙ্গবন্ধু

সমাজ বদলে চীনের ভাবনা অনেক তরুণের মতো পূর্ববঙ্গের এক তরুণ শেখ মুজিবুর রহমানকেও আকৃষ্ট করেছিল। তাঁর বয়স তখন ৩০। ৩২-এ তিনি গেলেন চীনে। চীন ছিল তখনকার যুবকদের কাছে ‘নয়াচীন’। তখনকার যুবক কেন, ষাটের দশকে আমাদের কাছেও চীন ছিল নয়াচীন যা সম্পূর্ণ আলাদা পুরনো চীন থেকে। ১৯৫২ সালের অক্টোবরে বঙ্গবন্ধু চীন যান এবং চীন তাঁর চিন্তাধারাকে অবশ্যই প্রভাবিত করেছিল। ১৯৫৪ সালে যখন তিনি জেলে, তখন লিখলেন ‘আমার দেখা নয়াচীন’; যা প্রকাশ করল বাংলা একাডেমি।

এক কথায় নয়াচীন বঙ্গবন্ধুর ভালো লেগেছিল। কিন্তু অন্তিমে যে প্রশ্নটি আমাদের কেন অনেক মানুষের মনে জাগে তা হলো- কমিউনিস্ট বা সমাজতান্ত্রিক দেশে কি মানুষ স্বাধীন? না একটি খাঁচায়ই তাকে থাকতে হয়। তাত্ত্বিকরা কমিউনিজম বা সোশ্যালিজমের যে কাঠামো তৈরি করেছেন, মানুষকে কি হুবহু সেই ফ্রেমে আটকানো যায়? যায় না। কারণ, মানুষ মূলত স্বাধীন, একটি কঠিন কাঠামোয় আপাতত সন্তুষ্ট হলেও পরবর্তী সময় হয় না। আশ্রয় বাসস্থান খাদ্যের অভাব ঘুঁচলেই সে অন্য কিছু নিয়ে চিন্তা করতে চায়। সজীব থাকতে চায়। তাত্ত্বিকরা এটি উপেক্ষা করতে চেয়েছেন দেখে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেছে। মাও সে তুংয়ের চীন ৮০ ভাগ পুঁজিবাদ বেছে নিয়েছে। আজ থেকে ৭০ বছর আগে বঙ্গবন্ধুও সেই সমস্যায় পড়েছেন। বইয়ের শেষে তিনি লিখেছেন, চীন তাঁকে মুগ্ধ করেছে কিন্তু সেখানে “অন্য কোনো নতুন আদর্শের দল সৃষ্টি করার অধিকার কারও নাই।” উপসংহারে লিখেছেন, “ভাত-কাপড় পাবার ও আদায় করে নেবার অধিকার মানুষের থাকবে। সাথে সাথে নিজের মতবাদ প্রচার করার অধিকারও মানুষের থাকা চাই। তা না হলে, মানুষের জীবন বোধহয় পাথরের মতো শুষ্ক হয়ে যায়।”

সোভিয়েত ইউনিয়ন বা চীন আদতে যে কাঠামোয় যাত্রা শুরু করেছিল তাতে থাকতে না পারার কারণ, মানুষের মন শুষ্ক হয়ে যায়। আর শুষ্ক মনের মানুষ নিয়ে এগিয়ে যাওয়া যায় না।

বঙ্গবন্ধু নিজেকে কমিউনিস্ট না মনে করতে পারেন কিন্তু পাকিস্তান গোয়েন্দা সংস্থা তাঁকে কমিউনিস্ট বলেই উল্লেখ করেছে। ১৯৪৯ সালে গোয়েন্দা সংস্থা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে দুজনকে কমিউনিস্ট হিসেবে উল্লেখ করেছে। একজন মুনীর চৌধুরী অপরজন শেখ মুজিবুর রহমান। অবশ্য তখনকার পরিপ্রেক্ষিতে মুসলিম লীগ-বিরোধী হলেই ভারতীয় এজেন্ট অথবা কমিউনিস্ট বলে উল্লেখ করত। কমিউনিস্ট মানেই হচ্ছে ইসলামবিরোধী, নাস্তিক। এ ধারণা এখনো বিদ্যমান, যে কারণে কমিউনিস্ট পার্টি হয়তো জনমানসে কোনো স্থান করে নিতে পারেনি।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিয়ে ১৯৬১ সালে তিনি প্রথম বৈঠক করেছিলেন কিন্তু অন্য কারো সঙ্গে নয়, কমিউনিস্ট পার্টির মণি সিংহ আর খোকা রায়ের সঙ্গে। আওয়ামী লীগের পক্ষে আলোচনায় ছিলেন মানিক মিয়া ও শেখ মুজিব। খোকা রায় লিখেছেন, “আন্দোলনের দাবি নিয়ে আলোচনার সময় শেখ মুজিবুর রহমান বারবার বলেছিলেন যে পাঞ্জাবের ‘বিগ বিজনেস’ যেভাবে পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ করছিল ও দাবিয়ে রাখছিল তাতে ওদের সঙ্গে আমাদের থাকা চলবে না। তাই এখন থেকেই স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের জন্য আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে; আন্দোলনের প্রোগ্রামে ঐ দাবি রাখতে হবে ইত্যাদি।”

মণি সিংহ ও খোকা রায় বোঝালেন যে, সে পরিস্থিতি এখনো আসেনি। যখন আসবে তখন দেখা যাবে। মুজিব বললেন, “ভাই এবার আপনাদের কথা মেনে নিলাম। আমাদের নেতাও অর্থাৎ সোহরাওয়ার্দী সাহেব আপনাদের বক্তব্য সমর্থন করেন। তাই এখনকার মতো সেটা মেনে নিয়েছি। কিন্তু আমার কথাটা থাকল ইত্যাদি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬১ সাল থেকেই স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন।”

প্রায় এক মাস নয়াচীন ঘুরেছেন বঙ্গবন্ধু। চীনে যা কিছু দেখেছেন, তার বর্ণনা দিয়েছেন। গ্রন্থের শেষে প্রায় ৩৫ পৃষ্ঠা যা দেখেছেন তা পর্যালোচনা করেছেন যেটি এ বইয়ের গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং আমাদের জন্যও।

বঙ্গবন্ধু লিখেছেন: ‘‘নয়াচীনের উন্নতি দেখে সত্যিই আমি সন্তুষ্ট হয়েছি। যদি দশ বছর তারা দেশকে শান্তিপূর্ণভাবে গড়তে পারে তবে জনসাধারণের কোনো দুঃখ-দুর্দশা থাকবে না, অশিক্ষা-কুসংস্কার মুছে যাবে। এবং দুনিয়ার যে কোনো শক্তির সঙ্গে তারা মোকাবিলা করতে পারবে সকল দিক থেকে। কারণ জাতিকে গড়ে তোলার যে প্রধান শক্তি জনসাধারণের মনোবল তা নয়াচীনের জনগণের মধ্যে আছে। নয়াচীনের অনেক কিছুই আমার ভালো লেগেছিল এ কথা সত্য।” [ঐ, পৃ. ১১৮] কিন্তু যে বিষয়টি তাঁর ভালো লাগেনি তা হলো, সেখানে কমিউনিস্ট আদর্শ ছাড়া অন্য কোনো আদর্শ প্রচার করতে দেয়া হয় না।

সমাজতান্ত্রিক ও পুঁজিবাদী মতবাদ সম্পর্কে নয়াচীন-এ বঙ্গবন্ধু সুস্পষ্ট কোনো মন্তব্য করেননি যা করেছেন আত্মজীবনীতে। তিনি লিখেছেন যা প্রণিধানযোগ্য- “আমি নিজে কমিউনিস্ট নই। তবে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি এবং পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে বিশ্বাস করি না। একে আমি শোষণের যন্ত্র হিসেবে মনে করি। এই পুঁজিপতি সৃষ্টির অর্থনীতি যতদিন দুনিয়ায় থাকবে ততদিন দুনিয়ার মানুষের ওপর থেকে শোষণ বন্ধ হতে পারে না। পুঁজিপতিরা নিজের স্বার্থে বিশ্বযুদ্ধ লাগাতে বদ্ধপরিকর। নতুন স্বাধীনতাপ্রাপ্ত জনগণের কর্তব্য বিশ্ব শান্তির জন্য সংঘবদ্ধভাবে চেষ্টা করা। যুগ যুগ ধরে পরাধীনতার শৃঙ্খলে যারা আবদ্ধ ছিল। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি যাদের সর্বস্ব লুট করেছে- তাদের প্রয়োজন নিজের দেশকে গড়া ও জনগণের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক মুক্তির দিকে সর্বশক্তি নিয়োগ করা। বিশ্ব শান্তির জন্য জনমত সৃষ্টি করা তাই প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।” [পৃ. ২৩৪]

বঙ্গবন্ধু খুশি মনে চীন সফর করেছেন। পাকিস্তানে ফিরে বিশ্ব শান্তি নিয়ে মন্তব্যও করেছেন। তাঁর মনে হয়েছে, “সত্য কথা বলতে কি- নতুন দেশ, নতুন মানুষ, নতুন তাদের ব্যবহার। মনে হয় সকল কিছুর মধ্যেই নতুনত্ব।” চীন সফর তাঁর মানস জগতে বেশ প্রভাব ফেলেছিল। কীভাবে সেটি বোঝার চেষ্টা করব।

চীনের আদর্শ, কমিউনিস্ট আদর্শ ছাড়া, তারা যে কাজ করেছে সেগুলো তিনি গ্রহণ করতে চেয়েছিলেন। ঐ যে নতুনভাবে সব করার চেষ্টা এটিই ছিল তাঁর কাছে আকর্ষণীয়। যে বাংলাদেশের স্বপ্ন তাঁর মধ্যে অঙ্কুরিত হচ্ছে সে দেশটিকে তিনি এভাবেই গড়তে চেয়েছেন, নতুনভাবে চিন্তা করতে চেয়েছেন। কিন্তু পাকিস্তানি রাজনীতিবিদদের এটি পছন্দ ছিল না। মুসলিম লীগপন্থিদের তো নয়ই। এমনকি মুজিব যাদের সঙ্গে রাজনীতি করেছেন, তারাও নয়। তবে মুসলিম লীগ নেতাদের থেকে তারা প্রাগ্রসর ছিলেন। আওয়ামী লীগের যাঁরা গিয়েছিলেন চীন সরকারের কাজকর্ম তাদের ভালো লেগেছিল। তবে মুজিব তাঁদের থেকে এগিয়ে ছিলেন।

রাজনৈতিকভাবে সমাজতন্ত্রের [চীন/রাশিয়া] কথা বলা ছিল বিপজ্জনক। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সে ঝুঁকি নেয়ার সাহস দেখিয়েছিলেন। সে সময় মুসলিম লীগের রাজনীতি বর্তমান বিএনপি-জামায়াত রাজনীতির মতোই ছিল। এর বিপরীতে কমিউনিস্ট পার্টির নেতাকর্মীরা ছিলেন ত্যাগী ও সৎ। এ গুণটি বঙ্গবন্ধুকে আকর্ষণ করেছিল। ১৯৭৫ সালের জুন মাসে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গেছেন অধ্যাপক কবীর চৌধুরী ও শামসুজ্জামান খান। সেখানে ছাত্রলীগের নেতৃস্থানীয় কয়েকজন ছিলেন। তারা অভিযোগের সুরে বলছিলেন, “আপনি ছাত্র ইউনিয়নের  সম্মেলনেও  তো গেলেন।’ তিনি বললেন, ‘তোমাদের কাজে আমি সন্তুষ্ট হতে পারি না সব সময়। ছাত্র ইউনিয়নের ওরা পরিশ্রমী, নিষ্ঠাবান, ত্যাগী। ওরা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সীডবেড করে উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে নিজদের যুক্ত করেছে। আমি একটিমাত্র জাতীয় পার্টি [বাকশাল] করছি। ত্যাগী সৎ লোকেরা কাজের মাধ্যমে সেই পার্টির সামনের কাতারে আসবে। অকর্মণ্য গলাবাজরা পিছনে পড়বে। দেখো না আমি আলতাফ সাহেবকে মন্ত্রী করেছি। এমন একটা লোক পাওয়া ভাগ্যের কথা।”

ছেলেবেলা থেকেই তিনি গরিবদের প্রতি সহানুভূতিশীল। কমিউনিস্টরাও শ্রমিক-কৃষকদের কথা বলে। সুতরাং তিনি কমিউনিস্ট না হলেও এ ভাবধারার প্রতি অনুরাগী ছিলেন। এখানে উল্লেখ্য, ১৯৫২ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত আওয়ামী লীগে অনেক সময় ডানপন্থিরা শক্তিশালী হয়ে উঠেছে কিন্তু বঙ্গবন্ধু সব সময় পার্টিকে মধ্য বা মধ্য বামে রেখেছেন। ডান পন্থায় তাঁর বিশ্বাস ছিল না। 

আমি কয়েকটি উদাহরণ দিচ্ছি। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, চীনের সাধারণ মানুষ হতদরিদ্র; এর অর্থ অবস্থা আগে আরো খারাপ ছিল কিন্তু মাও সেতুং সে অবস্থার পরিবর্তন করছেন। এ বিষয়টি তাঁকে বেশ নাড়া দিয়েছিল। ১৯৫৩ সালের কাউন্সিল সভায় সাংগঠনিক রিপোর্টে বলেছিলেন- “শোষকের ওপর শোষিতের সংঘাত ভঙ্গুর ধ্বংসোন্মুখ সমাজকে ধ্বংসের হাত হইতে উদ্ধার করিবার জন্য শোষণের কেন্দ্রগুলোর ওপর আক্রমণই আমাদের প্রথম কাজ। পণ্য হিসেবে নয়- মানুষ মানুষের পরিপূর্ণ মর্যাদা লইয়া বাঁচিতে চায়। আওয়ামী লীগ এই বাণী লইয়া বঞ্চিত মানুষের নেতৃত্ব গ্রহণ করিয়াছে। এই মানবিক সম্পর্কের প্রতিষ্ঠার শপথই আওয়ামী মুসলিম লীগের কর্মসূচির মধ্য দিয়া প্রতিভাত হইয়াছে। আওয়ামী লীগ ভালো করিয়াই বুঝিয়াছে জাতির সম্পদের উপযুক্ত উৎপাদন ও বণ্টনের মধ্য দিয়াই উহার সংকটের অবসান করিয়া মানুষের সমৃদ্ধি রচনা করিতে হইবে।” ঐ সময়ে যেসব দল প্রকাশ্য রাজনীতি করত তাদের কোনো নেতা এ ধরনের কথা বলতে পারেননি।

কৃষকের সঙ্গে যুক্ত ভূমি। বঙ্গবন্ধু দেখিয়েছেন, চীনে লাঙল যার জমি তার এই নীতি গ্রহণ করা হয়েছিল এবং জমিদারদের জমি কৃষকদের মধ্যে ভাগ করে দেয়া হয়েছিল। কৃষকদের খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার উপায় সৃষ্টি হয়েছিল। জমিদারি প্রথাও বিলুপ্ত হয়েছিল।

চীন যাওয়ার আগেই বঙ্গবন্ধু ১৯৪৯ সাল থেকে জমিদারি প্রথা বিলুপ্তের দাবি করছিলেন এবং তা লুপ্ত করা হয়েছিল। ১৯৫৩ সালে কাউন্সিল মিটিংয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘‘আমরা ভূমি ব্যবস্থার  বৈপ্লবিক পরিবর্তন চাই। কিন্তু ভূমি ব্যবস্থার সাথে সাথে শিল্পায়ন প্রচেষ্টাও আমাদের সংগঠিত করিতে হইবে। সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের কাঁচামাল, উৎপাদিত পণ্যের বাজার, নিয়োজিত মূলধনের জোগান হিসেবে আমাদের দেশকে ব্যবহার করিয়াছে বলিয়াই আমাদের কৃষি ও শিল্পের এই দুর্গতি।”

বঙ্গবন্ধু ব্যক্তিগতভাবে ছিলেন অসাম্প্রদায়িক। তাঁর ধর্মমতের সঙ্গে এর কোনো দ্বন্দ্ব ছিল না। ইসলাম এর বিরোধী। সুতরাং এর বিরোধিতা করা ধর্মীয় নীতি পালন করাও বটে। ১৯৫৩ সালে কাউন্সিল সভায় তিনি ঘোষণা করেছিলেন, “গণতান্ত্রিক শক্তি [আওয়ামী মুসলিম লীগ] বুঝিয়াছে যে গণআন্দোলনকে ব্যাহত করিবার ইহা গণদুষমনদের একটি হাতিয়ার মাত্র। আর তাদের এই হাতিয়ারকে ধ্বংস করিয়া দিতে হইবে হিন্দু-মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মধ্য দিয়া। মানুষের এই চেতনাই ১৯৫০ সালে দাঙ্গার শিক্ষা।” তিনি আরো বলেন, ১৯৪৯ আর ১৯৫৩ ভিন্ন। তাদের এই অভিজ্ঞতা হয়েছে যে, রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে বিরোধকে তারা আজ আর সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে বিরোধ বলে মনে করেন না।

শেখ মুজিব লক্ষ্য করেছিলেন, চীনারা আমেরিকাকে প্রচণ্ডভাবে ঘৃণা করে। বঙ্গবন্ধুর কাছে ব্রিটেন ছিল কাছের, আমেরিকা দূরের। পাকিস্তান তখন কমনওয়েলথের অন্তর্ভুক্ত। ১৯৫৩ সালে সেই কাউন্সিল সভায় তিনি ঘোষণা করেন, আওয়ামী লীগ কৃষ্টি ও শিল্পে প্রগতিবাদী কর্মসূচি গ্রহণ করেছে যা সামন্তবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থার একান্ত পরিপন্থি। তাই আওয়ামী লীগ শুধু কমনওয়েলথ নয় সাম্রাজ্যবাদী জোটের সঙ্গে সম্পর্কহীন সক্রিয় নিরপেক্ষ নীতি গ্রহণ করছে এবং আওয়ামী লীগ এখন থেকে সামন্তবাদ ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী শক্তির মহান নেতা।

ঐ সময় আওয়ামী লীগ নেতা ভাসানীও ঘোষণা করেছিলেন, অধিক স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে, জমিদারি উচ্ছেদ করতে হবে, পাট ও প্রধান শিল্প জাতীয়করণ করতে হবে।

১৯৭১ সালের ঘটনাবলি কিছুটা হলেও তাঁর মনে অভিঘাত সৃষ্টি করেছিল। চীন তাঁর মানুষের বিরুদ্ধে, যুক্তরাষ্ট্রও তা। কিন্তু চীনের বিষয়টিকে কি তিনি মানতে পেরেছিলেন? অন্যদিকে যে সোভিয়েতের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল না, সেই সোভিয়েতের প্রতি শ্রদ্ধা বেড়েছিল। এবং সোভিয়েত তো সমাজতন্ত্রেরই ধারক। সুতরাং সমাজতন্ত্রের সঙ্গে তাঁর আপস করতে হয়নি। আর আমেরিকা বিরোধিতা করবে কিন্তু তার সঙ্গেই বসবাস করতে হবে।

১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমির কয়েকজন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য ৩২ নম্বরে যান। শামসুজ্জামান খান ছিলেন সেই দলে। তিনি লিখেছেন, একজন বঙ্গবন্ধুকে বলছিলেন, মুক্তিযুদ্ধেতো চীন বাংলাদেশকে সমর্থন করেনি। বঙ্গবন্ধু বললেন- “দুটো বিষয়তো আলাদা, মাও একজন বড় নেতা। জীবনে বহু সংগ্রাম করেছেন। তাঁর জীবন ও চিন্তাটা জানা ও বোঝা দরকার। একটা অনুন্নত বিশাল দেশকে তিনি স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন। সে দেশটায় এত মানুষ হওয়া সত্ত্বেও কত উন্নত হয়েছে। এই ব্যাপারটা কীভাবে ঘটেছে তা উপলব্ধি করার চেষ্টা করছি।’ 

হঠাৎ তাঁর মুখে একটু বেদনার ছায়া পড়লো। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তারপর বললেন, রাজনীতি বড় জটিল, নিষ্ঠুর। এর ফলে কত অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটে। তা না হলে চীনের আমাদের সমর্থন না করার ক্ষেত্রে কোনো যুক্তিই নেই। চীন খুব অন্যায় কাজ করছে।”

যে ধারণাগুলো চীন থেকে নিয়ে এসেছিলেন তার দুটি দিক ছিল- এক. তাত্ত্বিক, দুই. ব্যবস্থা। তাত্ত্বিক দিক থেকে অসুবিধা ছিল না। সমাজতন্ত্রের মূল নীতিই তাঁর কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল। ‘মাও-এর চিন্তাধারা’ তখনো ব্যাপ্তি পায়নি সুতরাং সে ধারণা তাঁর মানসজগতের বাইরে ছিল। আমি কয়েকটি ধারণা দিই।

১৯৬৪ থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত প্রায় প্রতিটি জনসভায় তিনি শ্রমিক-কৃষকের ব্যাপারটি এনেছেন। যেমন ১৩ জুন ১৯৬৪ সালে এক জনসভায় বলেন, পাকিস্তানি ব্যবস্থায় শিল্পপতিরা করমুক্ত আর কৃষক করভারে জর্জরিত। আসলে হওয়া উচিত তো উল্টোটা।

১৯৫০ থেকে যা ভেবেছেন, ২১ বছর পর ১৯৭২ সালে সেসব ধারণা তিনি কার্যকর করতে চাইলেন। বিষয়টি এভাবে বিবেচনা করা যায়, বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ, বিভিন্ন আদর্শের সঙ্গে পরিচয়ে তিনি নতুন দেশের জন্য কী করবেন তার একটা ধারণা মনে তৈরি করেছিলেন।

২৭ মার্চ ১৯৭২ সালে শ্রমিক সমাবেশে বলেন, “শ্রমিক ভাইদের বলি শ্রম ও পুঁজির মধ্যে আবহমান কাল ধরিয়া যেই পরস্পরের বিরোধিতা রহিয়াছে তা আমাদের নতুন নীতি গ্রহণের ফলে বাংলাদেশ হইতে অনেকখানি বিলুপ্ত হইবে। শ্রমিক কর্মচারীকে আর সর্বদা মালিকের সঙ্গে বিরোধে লিপ্ত থাকিতে হইবে না।” চীনে তিনি দেখেছিলেন শ্রমিক প্রতিনিধি ও মালিক একসঙ্গে বসে কারখানার কর্মসূচি গ্রহণ করছেন।

চীনে তিনি যেমন দেখেছিলেন মালিক শ্রমিক মিলে পরিকল্পনা করে কারখানা চালায় তেমনি ১৯৭৫ সালে বাকশাল গঠনের সময় বলেছিলেন- “শ্রমিক ভাইয়েরা আমি শ্রমিক প্রতিষ্ঠান করেছি। আপনাদের প্রতিনিধি ইন্ডাস্ট্রিজ ডিপার্টমেন্ট, লেবার ডিপার্টমেন্টের প্রতিনিধি বসে একটা প্ল্যান করতে হবে। সেই প্ল্যান অনুযায়ী কি করে আমরা বাঁচতে পারি। তার বন্দোবস্তো করতে হবে।”

২৯ এপ্রিল ১৯৭২ সালে বলেছেন, “ধর্মনিরপেক্ষতা বর্তমান সরকারের নীতি ইহার অর্থ এই নয় যে, কাহাকেও ধর্ম চর্চা করতে দেওয়া হইবে না। অন্যের ধর্মে হস্তক্ষেপ করা ইসলামের নীতি নহে।” তিনি আরো বলেন, “ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মকর্ম করার অধিকার থাকবে। আমরা আইন করে ধর্মকে বন্ধ করতে চাই না এবং করবও না।” অর্থাৎ এক কথায়, ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার।

খোন্দকার ইলিয়াসকে এক সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন ১৯৭২ সালে “জিন্নাবাদ এ দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সৃষ্টি করে সাম্প্রদায়িকতাবাদের বিষবাষ্প। তার জবাবে আমি বলি যার যার ধর্ম তার তার- এরই ভিত্তিতে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের কথা।”

চীনে এই কারণেই তিনি বিভিন্ন জায়গায় মুসলমানদের সঙ্গে আলাদা কথা বলতে চেয়েছেন। তাদের মনোভাব বুঝতে চেয়েছেন। ১৯৯০ সালে যখন চীনে যাই, তখনো এ খোঁজ নেয়ার চেষ্টা করেছি। সেদিক থেকে দেখলে এ ক্ষেত্রে ১৯৫২ সালে চীনে যে নীতি ছিল, ধর্ম সম্পর্কে ১৯৯০ সালেও তাই ছিল। মুসলমানরা বঙ্গবন্ধুকে দৃঢ়ভাবে জানিয়েছেন, তাদের ধর্মকর্মে বাধা দেওয়া হয় না। বরং ধর্মের নামে যে শোষণ তা বন্ধ করার প্রয়াস নেয়া হয়েছে। বঙ্গবন্ধুও তাই চেয়েছিলেন। তাঁর আমলের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতা সংযোজন। তিনি আরেকটি বিপ্লবী কাজ করেছিলেন, রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছিলেন। চীন ছাড়া আর কেউ ঐ সময়ে এ কাজ করার সাহস পায়নি।

১৯৭২ সালের মার্চ মাসে তিনি বলেছেন, “আমার সরকার অভ্যন্তরীণ সমাজ বিপ্লবে বিশ্বাসী এবং সমাজ ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হবে। সমাজ তো চাট্টিখানি কথা নয়। এ দেশের বাস্তবিক প্রয়োজনের ভিত্তিতে পুরাতন সামাজিক কাঠামো ভেঙে দিয়ে নতুন সমাজ গড়তে হবে। শোষণ, অবিচারমুক্ত নতুন সমাজ কাঠামো আমাদের গড়ে তোলার চেষ্টা করতে হবে শুভ সূচনা হিসেবে আমরা উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলো জাতীয়করণ করছি।” কৃষকদের খাজনা চিরদিনের [২৫ বিঘার কম] জন্য মওকুফ করেছেন। তিনি সোনার বাংলা গড়ে তুলতে চান এবং সোনার বাংলায় থাকবে শোষণমুক্ত সমাজ। শ্রমিকদের বলেছেন [২৭ মার্চ ১৯৭২], “শ্রম ও পুঁজির মধ্যে আবহমান কাল ধরিয়া সেই পরস্পরের বিরোধিতা রহিয়াছে।” তা বিলুপ্ত করা হবে।

সমাজতন্ত্র পছন্দ করেন কিন্তু তিনি কমিউনিস্ট নন। তিনি পুঁজিবাদে বিশ্বাসী নন, গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। এই কন্ট্রাডিকশন কীভাবে মেটাবেন তার একটি ফর্মুলা তিনি করেছিলেন। ১৯৭২ সালের আগস্টে এক বক্তৃতায় তা বলেছিলেন- চার মূলনীতি যেন সবাই সমর্থন করেন এই নিশ্চয়তা চেয়ে তিনি বলেন, “এই চার নীতির ভিত্তিতে দেশ গড়তে চান। আমরা সমাজতন্ত্র কায়েম করতে চাই। আমরা একটি নতুন ইয়ে দিয়েছি যে গণতন্ত্রের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র কায়েম করা যায় কিনা তা আমরা চেষ্টা করেছি। আমরা স্বাধীনতা দিচ্ছি কারণ দেখা যায় সমাজতন্ত্র করতে গেলে অনেক সময় বাধার সৃষ্টি হয়। মানুষ চটানোর জন্য এটা করতে চাচ্ছি না এই জন্য যে, আমি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। দেখছি গণতন্ত্রের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র হবে কিনা এবং চেষ্টা করে দেখছি বাঙালি জাতীয়তাবাদ তার ভিত্তিতে আবার আন্দোলন, এ না থাকলে আমার স্বাধীনতার ঐক্য নষ্ট হয়ে যায়। আর ধর্মনিরপেক্ষতা আমার রয়েছে।”

বঙ্গবন্ধু গণতন্ত্র চান আবার সমাজতন্ত্র চান, এটি কী সবে সম্ভব? বঙ্গবন্ধু ঐ সাক্ষাৎকারে বলেন- “শোষক শ্রেণীকে দমন করার মতো যথেষ্ট ক্ষমতা দেশবাসীর আছে। সামাজতন্ত্র রাতারাতি হয় না- দীর্ঘদিনের ব্যাপার। শান্তিপূর্ণভাবে এবং ধীরে ধীরে অগ্রসর হতে হবে, ধাপে ধাপে অগ্রসর হতে হবে। রক্তপাত অনেক হয়েছে, আর নয়। এবার সংসদীয় গণতন্ত্রের মাধ্যমে এবং শান্তিপূর্ণ উপায়ে আমরা দেশকে ঐক্য, প্রগতি ও সমাজতন্ত্রের পথে এগিয়ে নিতে চাই। এ কাজে আমি মনে করি- শক্তির উৎস বন্দুকের নল নয়, শক্তির উৎস আমার জনগণ।

পুঁজিবাদী ও সামন্তবাদী শোষণব্যবস্থায় ধ্বংস সাধনের মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠিত হয় সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা, শোষণহীন সমাজব্যবস্থা। কাজেই সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে পৃথিবীর প্রত্যেকটি দেশেই পুঁজিবাদ ও সামন্তবাদ প্রতিরোধ গড়ে তুলবার চেষ্ট করে। তাদের সঙ্গে কখনো প্রকাশ্যে, কখনো গোপনে যুক্ত হয় শোষকদের আন্তর্জাতিক দোসর-সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ ও নয়া-উপনিবেশবাদ। বাংলাদেশেও তার পুনরাবৃত্তি ঘটা অস্বাভাবিক নয়। বাঙালির স্বাধীনতাযুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদের বৈরী ভূমিকায় আমরা ঘৃণা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছি, কিন্তু বিস্ময় প্রকাশ করি নি। কারণ, জাতীয় স্বাধীনতা বিরোধীতা করাই তাদের বিঘোষিত নীতি। তবে, সাম্রাজ্যবাদী দেশসমূহেও প্রগতিশীল সংগঠন ও ব্যক্তি আছেন। তাঁরাও তাঁদের দেশে শান্তি, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের জন্যে সংগ্রাম করছেন। আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রামে আমরা তাঁদের সক্রিয় সমর্থন লাভ করেছি। আশা করি, আমাদের সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও শান্তির সংগ্রামেও তাঁদের সক্রিয় সমর্থন আমরা লাভ করব।

সারা জীবন যা চেয়েছেন তার নির্যাস তিনি ১৯৭২ সালের সংবিধানে লিপিবদ্ধ করেছিলেন। তিনি জানতেন যে, সমাজতন্ত্র বা ধর্মনিরপেক্ষতা বাঙালি সম্পূর্ণ মেনে নেবে না। বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তাই তিনি জাতীয়তাবাদের কথা ভেবেছেন। চীনে তিনি নারী-পুরুষ সমতা দেখেছেন, আমাদের সংবিধানেও তার নিশ্চয়তা আছে। ঐ আমলের পরিপ্রেক্ষিতে খুবই আধুনিক ছিল আমাদের সংবিধান। শুধু তাই নয়, পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রেও তিনি সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে  বৈরিতা নয়- এই অবস্থান নিয়েছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতার পরপর লেনিন বা মাও সে তুং যেভাবে আদর্শ ও নীতির ক্ষেত্রে সমস্যাগুলো সমাধান করেছিলেন বঙ্গবন্ধুর পক্ষে তা সম্ভব হয়নি। লেনিন বা মাও তাদের দর্শন প্রচার করেছেন, ক্যাডার সৃষ্টি করেছেন এবং জয়লাভের পর তা বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছেন। তাদের ম্যান্ডেটও ছিল তা।

বঙ্গবন্ধুর ম্যান্ডেট ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা। আওয়ামী লীগে বহু ধরনের মানুষ জমায়েত হয়েছিলেন। তাজউদ্দীন আহমদ যেমন ছিলেন, খন্দকার মোশতাকও ছিলেন। সমাজতন্ত্রের কথা বঙ্গবন্ধু দীর্ঘদিন ধরে বলেছেন, কিন্তু সে সম্পর্কে কারো কোনো স্পষ্ট ধারণা ছিল না। এ লক্ষ্যে তিনি যখন জমির সিলিং ঘোষণা করেন এবং জাতীয়করণ করেন তা স্বার্থান্বেষী একটি মহল মেনে নেয়নি। মাও সে তুং বা লেনিন স্বাধীনতার পর শত্রুপক্ষকে যতটা পারেন নির্মূল করেছেন। বাংলাদেশের যারা বিরোধিতা করেছিল তাদের ব্যাপারে ব্যবস্থা নিয়েছিলেন কিন্তু ধনী এলিট, আমলাতন্ত্র, বিভিন্ন চরম বাম দল এবং নিজের দলের বিভক্তি- একসঙ্গে এতো ফ্রন্টের সামাল দেয়া ছিল মুশকিল। ছোট দেশ, তার ওপর সব বিধ্বস্ত, খাদ্যাভাব, অর্থাভাব সব সমস্যা প্রকট হয়ে উঠেছিল। এসব সমস্যা সমাধানে তিনি আবার সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর ফর্মুলা গ্রহণ করতে চেয়েছেন। ডাক দিয়েছিলেন দ্বিতীয় বিপ্লবের, গঠন করেছিলেন বাকশাল। এবং লক্ষ করুন এই নামে কৃষক ও শ্রমিকদের নামই রাখা হয়েছিল। এ পরিপ্রেক্ষিতেই তাঁকে হত্যা করা হয়।

অনেকে বলেন, স্বাধীনতার পর যে সংবিধান রচিত হয় তা ভারত ও সোভিয়েতের চাপে। এটি সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। সমাজতন্ত্রের কথা, অসাম্প্রদায়িকতার কথা [ধর্মনিরপেক্ষতা] বঙ্গবন্ধু পঞ্চাশ দশক থেকেই বলেছিলেন। চীনে তিনি দেখেছেন, চীন যেভাবে সমস্যাগুলোর সমাধান করেছে তা তিনি ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করেছেন। পরে সোভিয়েত ব্যবস্থাও তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছে সমস্যা সমাধানে। কিন্তু গণতন্ত্রের কথা তিনি ভোলেননি। এবং সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা এটি ছিল তাঁর কাছে অস্বস্তিকর, যা তিনি নয়াচীনে লিখেছিলেন। বাকশাল করার সময় তিনি বলেছিলেন, কম দুঃখে তিনি বাকশাল গঠন করেননি। কিন্তু অবস্থা ফিরলে তিনি আবার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরে যাবেন। সেদিন আর আসেনি। কিন্তু বাকশালের পর শৃঙ্খলা ফিরে আসছিল, উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছিল। মুজিব যে সমাজতান্ত্রিক রূপান্তরের প্রয়াস চেয়েছিলেন তা মওদুদ আহমদও তাঁর গ্রন্থে স্বীকার করেছেন। তাঁর মতে, “আওয়ামী লীগ ছিল একটি দ্বন্দ্ববহুল বিশৃঙ্খল পেটি-বুর্জোয়া রাজনৈতিক সংগঠন। অসংখ্য ধরনের শ্রেণি ও পেশার প্রতিনিধিত্ব নিয়ে দলটি একটি বহুমুখী শ্রেণি চরিত্রের ধ্বজাধারী হিসেবে বিকশিত হচ্ছিল। দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে চিন্তাগত অভিন্নতার কোনো অস্তিত্ব ছিল না। ফলে অসংখ্য ধরনের বিক্ষিপ্ত চিন্তা-চেতনাকে একসূত্রে গ্রথিত করে সমাজতান্ত্রিক আদর্শের দিকে তাদের উদ্বুদ্ধ করা সম্ভব ছিল না।” কিন্তু এই দলটির ওপরই তাঁকে নির্ভর করতে হচ্ছিল।

যাক সেসব অন্য প্রসঙ্গ, এখানে সরল ভাষায় বলতে পারি, সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারা বঙ্গবন্ধুকে উদ্বুদ্ধ করেছিল এবং চীন ভ্রমণ সে চিন্তাকে বিকশিত করেছিল। তাঁর লেখা আমার দেখা নয়াচীন- তারই প্রমাণ।

লেখক: ইতিহাস গবেষক, অধ্যাপক