বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন

বঙ্গবন্ধু : বাঙালির স্বতন্ত্র জাতিসত্তার প্রতিষ্ঠাতা

একজন নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ও রাজনৈতিক দূরদৃষ্টিকে মূল্যায়ন করে ব্রিটিশ লর্ড ফেন্যার ব্রোকওয়ে বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিব জর্জ ওয়াশিংটন, গান্ধী এবং দ্য ভ্যালেরার থেকেও মহান নেতা ছিলেন।’

বঙ্গবন্ধু তাঁর ব্যক্তিগত নোটবুকে লিখেছিলেন, ‘একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মানবজাতি নিয়েই আমি ভাবি। একজন বাঙালি হিসেবে যা কিছু বাঙালিদের সাথে সম্পর্কিত তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এই নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালোবাসা, অক্ষয় ভালোবাসা, যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি ও অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে।’

আজ থেকে ঠিক ১০২ বছর পূর্বে আজকের এইদিনে ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের ১৭ মার্চ; ১৩২৬ বঙ্গাব্দের ৩ চৈত্র তারিখের এক আলোকিত প্রভাতে চিরকাল শোষিত বাঙালি জাতির মুক্তির বারতা নিয়ে বাংলা মায়ের কোলে জন্ম নিয়েছেন কালজয়ী ইতিহাসের মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। শেখ মুজিবকে মা বাবা আদর করে খোকা নামেই ডাকতেন।

শৈশব থেকেই শেখ মুজিব তাঁর পারিপার্শ্বিক সমাজের প্রতি গভীর আত্মীয়তা ও দায়বদ্ধতা অনুভব করতেন। চিরবিপ্লবী মুজিব ছিলেন অন্যায়ের প্রতি আপসহীন এক অনন্য মানবসত্তা। সেজন্য তাকে ছোট্ট বয়সেই কারাবরণ করতে হয়েছে। সেই ১৯৩৮ সালের দিকে কিশোর বঙ্গবন্ধু যখন গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে পড়েন। তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক এবং শ্রমমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী গোপালগঞ্জ আসেন।  মুজিব তাদের হোস্টেলের ছাদের বেহালদশা সম্পর্কে অবহিত করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ জানান।

জাতীয় নেতাদের কাছে কিশোর মুজিবের এই অনুরোধের মধ্যে নিহীত ছিলো নিজ সমাজ ও দেশের প্রতি গভীর দায়বদ্ধতা এবং ভালোবাসার সুপ্ত বীজ। যা পরবর্তিকালে তাঁকে বাঙালি জাতির ত্রাণকর্তারূপি মহিরুহে পরিণত করেছিলো। 

১৯৪৭ সালের দেশভাগ তথা পাকিস্তান সৃষ্টির নেপথ্যে ভারতীয় উপমহাদেশের কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে পাকিস্তান আন্দোলনে অন্যতম প্রধান ছাত্রনেতা ছিলেন ইসলামিয়া কলেজ ছাত্র সংসদের নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক (জিএস) বেকার হোস্টেলের মুজিবুর রহমান। কিন্তু দেশভাগের পর বঙ্গবন্ধু অনুধাবন করলেন পাকিস্তান অর্জিত হলেও সাংস্কৃতিকভাবে একটি স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে বাঙালি জাতির কোন রাজনৈতিক ও আর্থ সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কেননা পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ততদিনে বাঙালির মুখের ভাষা বাংলাকেও হরণ করতে আগ্রাসী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। 

বাঙালি জাতির সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির মহান স্বপ্নকে লালন করে ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি, বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ (বর্তমান নাম বাংলাদেশ ছাত্রলীগ) প্রতীষ্ঠা করেন।  ১৯৪৮ সালে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার রাজপথের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে ১১ মার্চ গ্রেফতার হন শেখু মুজিবুর রহমান, শামসুল আলম প্রমুখসহসহ ৬৯ জন বাংলা মায়ের দামাল ছেলে।  ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ছিলো রক্তস্নাত বাংলা ভাষার চূড়ান্ত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠার দিন।  সেদিন রাজপথ রঞ্জিত হয়েছিলো বাংলা মায়ের দামাল ছেলের বুকের তাজা রক্তে।  বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি অর্জনের মধ্যেই বাঙালি জাতির স্বাধীনতার চিরকালীন আকাঙ্ক্ষার মনস্তাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক সম্ভাবনা জাগ্রত হয়েছিলো।

পরবর্তীকালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রত্যক্ষ করে বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে রাজনৈতিকভাবে ঐক্যবদ্ধ করতে আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে শুধুমাত্র আওয়ামী লীগ লীগ করার মধ্য দিয়ে এক যুগান্তকারী রাজনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করলেন। বঙ্গবন্ধুর এই পদক্ষেপের মাঝেই প্রোথিত হয়েছিলো বাঙালি জাতিসত্তার অভিন্ন সমাবেশ যেখানে বাংলার হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খৃষ্টান নির্বিশেষে মানুষ হিসেবে সকলের সমান মর্যাদা ও সমান রাজনৈতিক অধিকার নিশ্চিতভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে এরপর ১৯৫৭ সালে করাচীতে পাকিস্তানের গণপরিষদের তরুণ সদস্য শেখ মুজিবুর রহমান বক্তৃতা দেওয়ার সময় ‘পূর্ব পাকিস্তান’ নামটির প্রতিবাদ করে বলেন যে, পূর্ব বাংলা নামের একটি ইতিহাস ও ঐতিহ্য আছে।

‘আর যদি পূর্ব পাকিস্তান নাম রাখতেই হয়, তাহলে বাংলার মানুষের জনমত যাচাই করতে হবে।  তারা নামের এই পরিবর্তন মেনে নিবে কিনা- সেজন্য গণভোট নিতে হবে।’

১৯৬২ এর শিক্ষা আন্দোলন, বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু প্রণীত ১৯৬৬ সালের ৬ দফা ছিলো পরাধীন জাতি হিসেবে বাঙালির মুক্তির মহান ম্যাগনাকার্টা। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ৬ দফা আন্দোলনের ধারাবাহিক কর্মসূচির সফল রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে স্বৈরাচার আয়ুবশাহীর পতন ঘটে। সে সময় গণঅভ্যুত্থানে সাধারণ রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও ছাত্র-জনতার স্লোগানের ভাষা ছিলো, 

‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো,  বাংলাদেশ স্বাধীন করো।’

আবহমান বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসের কালপ্রবাহে এই প্রথম পূর্ব বাংলাকে ‘বাংলাদেশ’ নামে অভিহিত করা হয়।

একই বছরের ৫ ডিসেম্বর গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দির ৬ষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন, ‘আমাদের স্বাধীন দেশটির নাম হবে বাংলাদেশ’।

ওই বৈঠকে আওয়ামী লীগের নেতারা বিভিন্ন নাম প্রস্তাব করেন। পরে শেখ মুজিবুর রহমান ‘বাংলাদেশ’ নামটি প্রস্তাব করলে তাতে সবাই একবাক্যে সায় দেন।

এই নাম দেওয়ার কারণ হিসেবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘১৯৫২ সালে সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত বাংলা ভাষা থেকে ‘বাংলা’, এরপর স্বাধীন দেশের আন্দোলন সংগ্রাম থেকে দেশ।  এই দুটো ইতিহাস ও সংগ্রামকে এক করে ‘বাংলাদেশ’ নামকরণ করা হয়।’

এই ঐতিহাসিক ঘটনার পর সরকারি নথিপত্রে পূর্ব পাকিস্তান লিখতে হলেও মুখে কেউ পূর্ব পাকিস্তান নাম উচ্চারণ করতেন না। সবাই বলতেন বাংলাদেশ। বাংলাদেশের নামকরণে মুখ্য ভূমিকা পালনের মাধ্যমে বিশ্বের রাজনৈতিক ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ পরস্পরের অবিচ্ছেদ্য পরিপূরক হয়ে ওঠে।