শিল্প ও সাহিত্য

ছোটগল্প || করোনা-বিভ্রম

শীতের মরা রোদে চিমসানো স্যাঁতস্যাঁতে এক দুপুরবেলা। উঠোনজুড়ে ঝরা পাতা আর তিন-চারটে পাতি কাকের ওড়াওড়ি আর আনাগোনা। এরই ভেতর মাঝউঠোনে বসে রোদ পোহাচ্ছিল বিপুল ঘোষের বউ আর শাশুড়ি। বয়সের ব্যবধান যথেষ্ট হলেও দুজনার ভাব-বিনিময় তরল হতে হতে এখন বন্ধুর মতো; যখন-তখন লাগামহীন আড্ডায় মাখন গলা ঘি হতে খুব একটা সময় নেয় না!  

খাওয়া-দাওয়ার পর জিনের আছরের মতো কাঁপিয়ে শীত ভর করে শরীরে। দাঁত ঠকঠক করতে থাকে আপনাআপনি। এর থেকে গা বাঁচানোর একটাই টোটকা রয়েছে শাশুড়ি-বউয়ের হাতে, আর সেটি হলো নিয়ম করে রোজ একটুখানি রোদ পোহানো! উঠোনের মাথাউঁচু গাছগুলোর ফাঁক-ফোকর গলিয়ে যে খানিকটা মিনমিনে টাইপের রোদ এসে পড়ে উঠোনের এক কোণে, সেখানেই ওরা নিয়ম করে পিঁড়ি পেতে বসে খানিকক্ষণ। বাড়ির যেখানটায় ভূঁইচাঁপা ঝোপ, পাশে বড়ই গাছতলা, সেখানেই দুপুরবেলার ভাতঘুমে যাওয়ার আগে একচিলতে রোদে গা গরম করতে করতে এলোমেলো কথায় কিছুক্ষণ কাটায় ওরা।  

তবে রোদটা ফিচকে একটা শয়তান, যেমন অস্থির তেমনি অবিশ্বস্ত। শীতের শুরু থেকেই চড়ুইয়ের মতো ফুড়ুত-ফাড়ুত করে বেড়াচ্ছে। একটু আগে ভূঁইচাঁপা ঝোপের ধারে ঝিলিমিলি করছিল; কিছুক্ষণ বাদে ডগমগ করছে গয়াম গাছের গোড়ায়। হয়তো আরেকটু পর তিরতির করবে তুলসিতলার কাছে, তখন রোদের শেষ অবস্থা, খুবই গোমড়া মুখ, বসা-না-বসা এককথা। 

এভাবেই চলতে থাকে। মেলট্রেন ধরার মতো তড়িঘড়ি করে সঠিক সময়ে উঠোনে এসে না বসলে পিঠ পেতে রোদ পাওয়া বড়ই মুশকিল;  সেটুকু ধরতে পারাই বড় কথা, নইলে পুরো দিনটাই যে মাটি! শরীরে সূর্যের এ পরশ পেতে বেশির ভাগ দিন ছিপ ফেলে বসে থাকতে হয় উঠোনে। মাঝে মাঝে  আকাশে কুয়াশা জমলে রোদ নামের মাছের দেখা আর মেলে না। উল্টো কনকনে ঠান্ডা হাওয়া বরফের মতো জমিয়ে দিতে চায় শরীর। মন্দ কপালের সেরকম দিনে ঘরের বার  হওয়া যায় না। খেয়ে-দেয়ে লেপের তলাই একমাত্র ভরসা। তখন লটারির চেয়েও দামি বলে মনে হয় শীতের এটুকু রোদ। ঘণ্টাখানেক ধরে এর স্পর্শ একনাগাড়ে গায়ে মেখে বসে থাকলে শরীর আপনাআপনি উষ্ণ হতে শুরু করে, চনমন করে ওঠে দেহ-মন। ইচ্ছে করে রোদটার সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা  বসে থাকতে। 

আসলে এ রোদ পোহানোর অর্থ হচ্ছে দুপুরবেলার লেপের তলায় ভাতঘুমটাকে তুলতুলে বিড়াল ছানার মতো আরও উষ্ণ ও গাঢ় করে তোলা। এটাই রোদের দিকে পিঠ দিয়ে বসে থাকার মুখ্য কারণ। 

ওদিকে লেপের তলায় শীতকালীন আড়মোড়া ভাঙছে এ বাড়ির একমাত্র উত্তরাধিকার রতন ঘোষ। ওরও ভাতঘুমের বড় নেশা। সুযোগ পেলেই ঘুমের মধ্যে ঘন হয়ে নাক ডাকতে শুরু করে। অথচ কদিন থেকে সে-ও আগের মতো আর নাক ডাকা ঘুমে সঁপে দিতে পারছে না নিজেকে। কোনো কারণে চোখের পাতা ভারি হয়ে এলে ঘুমটাকে বজ্রআঁটুনির ভেতর বেঁধে রেখে দিতে হচ্ছে। কেননা একটু পরপরই রতনকে ছুটতে হয়  হাসপাতালে। দোকানে এখন তালা। কাজ একটাই- রুগ্ন বাবার সেবা-শুশ্রুষায় মগ্ন থাকা সারাক্ষণ। 

তবে বিপুল ঘোষের একমাত্র ছেলে হলেও স্বভাবে সে ঠিক  উল্টো; অলস ও মুখচোরা টাইপ। বয়স পঁয়ত্রিশ হয়ে গেছে তবু মোটেই সামলে চলতে পারে না কিছুই। বউয়ের মুখঝামটা আর বাপের বেশরম বকাঝকায় ফালা ফালা হতে হয় নিত্যদিন। সহ্যশক্তি অপার, মেয়েদের মতো,   বকাঝকার পরও মুখে লেগে থাকে অসহায় বেআক্কেল হাসির ঝলক।

রতনের পুরো শরীর লেপে ঢাকা। শুধু মুখখানা ছাদের দিকে তাক করা। চুন-সুরকির পুরনো বাড়ি।  পলেস্তরা খসা আঁকাবাঁকা চিত্রসম্ভার সেখানে। ইঁদুরের মতো দুটি শূন্য দৃষ্টির চোখ মেলে দিয়ে সে সেগুলোই অর্থহীনভাবে পরখ করে দেখছে। মাঝে মাঝে সম্বিৎ ফিরে পাচ্ছে। বাস্তবে ফিরে আসা মাত্র শীত জেঁকে বসে শরীরের পরতে পরতে। অসহ্য শীতের কামড়ে মুখ লুকাতে ইচ্ছে করে লেপের তলায়। এমন শীত যে একেবারে হাড়ের ভেতর ঢুকে পড়ে ডুগডুগি বাজাতে শুরু করে দেয়! 

তিনদিন হলো বিপুল ঘোষ প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট নিয়ে হাসপাতালে পড়ে রয়েছে। বয়স ষাটের ঘরে; তাগদওলা পুরুষ; ঘাম চটচটে কালো ভুঁড়ির নিচে লুঙি আর ঊর্ধাঙ্গে ফতোয়া জড়িয়ে দিব্যি দাবড়ে চলে চারপাশ। তবে যতই হেঁড়ে গলায় চাপা মেরে বেড়াক, ইদানীং মিষ্টির ব্যবসাটা আর আগের মতো নেই।  নিত্য-নতুন চটকদার দোকানের পাশে বিপুল ঘোষ এখন  আর দাঁড়াতে পারছে না। এলইডি লাইটের পাশে যেন টিমটিম করে জ্বলা এক হ্যাজাক সে। একে তো ভাঙাচোরা দোকান, তার উপর মিষ্টির সম্ভারে নেই কোনো বৈচিত্র। বজ্রপাতে বক মরার মতো অনুষ্ঠান-পার্বণে মাঝে মাঝে বড় অর্ডার হাতে চলে এলেও সামলাতে পারে না মোটেই। সময়জ্ঞান আর দ্রব্যের মান কোনোটাতেই পেরে ওঠে না অন্যদের সঙ্গে।

বিপুল এখন যা পারে তা হলো অবিরাম-অনর্গল বকবক করতে। পরনিন্দা-পরচর্চায় কাটিয়ে দিতে পারে বেহুদা কয়েকঘণ্টা। কিন্তু নিজেকে আর বাপ-দাদা অর্জিত পুরনো সুনামের কাছে ফিরিয়ে আনতে পারে না। মুখ থুবড়ে পড়া ষাঁড় যেন কিছুতেই আর দাঁড়াতে পারছে না! বেশ কদিন ভেবেছিল ব্যাংক থেকে লোন নেবে। সাজ-সজ্জায় ভরিয়ে দেবে ঘোষ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। কদিন সেকথা সবাইকে বলে আলগা ভাবও কিনেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাতেও মন সায় দেয়নি; ঠিক তাও নয়; সে আসলে সাহসটাই জড়ো করতে পারেনি নিজের ভেতর। অকারণে বুক ধড়ফড় করে, যদি লোনটা ফেরত দিতে না পারে, তখন? যদি দোকানের লোনটার জন্যে বসতবাড়িটাও গচ্ছা যায়, তো? এসব সাত-পাঁচ ভেবে লোনের ধারে-কাছে আর যাওয়া হল না। সেই কষ্টে বিপুল ঘোষ কানিকটা বিবাগী হয়ে পড়ল। ইসকনের তিলক কাটা ভাবশিষ্য হয়ে এখন চব্বিশঘণ্টা কৃষ্ণভজনায় মগ্ন। বাড়িতে এখন আর আমিষ বলে কিছু নেই। সব নিরামিষময়। একটুখানি আমিষের স্বাদ নেবার জন্যে বুক ফেটে যায় রতন আর ওর বউয়ের; কিন্তু কিছু করার নেই। সব মুখ বুঁজে মেনে নিতে হচ্ছে দিনের পর দিন!

আর এখন মানুষটা হাসপাতালে শয্যাশায়ী। দাবড়ে বেড়ানো মেজাজি বিপুল ঘোষ গড়াগড়ি খাচ্ছে অসহায়ের মতো। তবে এখানে এসেও  মেজাজ-মর্জি তার কমে নি; বরং বেড়েছে। প্রথম দিকে শক্ত-সমর্থবান মানুষটা হাঁচি-কাশির দাপটে চুপচাপ কাটালেও দ্বিতীয়দিন থেকেই শুরু হয় তার স্বভাবসুলভ খ্যাপাটেপনা।  করোনা-ওয়ার্ডে কেউ যেতে পারে না; অগত্যা টেলিফোনে রতনের উপর চলে অবিরাম ধমক-ধামকের শিলাবৃষ্টি! মোবাইলটা ধরতেই ফ্যাসফ্যাসে গলায় চেঁচিয়ে ওঠে, ‘হারামজাদা শুয়োর, আমি কি কম রোজগার করি যে আমারে না-খাওয়াইয়া রাখছস? একপদ দুইপদের নিরামিষে আমার কিছু অয়? পেটে ঢোকে একরহম খাওন রোজদিন? আমার জপমালা কই? আধারি কই? ’ বলে হাসপাতালের পুরো ওয়ার্ড গরম করে ফেলে সে একা।

মোবাইলের এপাশে থেকেও লজ্জায় রতনের মাথা কাটা যাওয়ার যোগাড়। সে কী করবে আর কী বলবে তা-ই বুঝতে পারছে না। যে বাড়ির রোগী করোনায় আক্রান্ত, সে বাড়ির লোকজনের সঙ্গে কেউ কথা তো দূরের কথা, ঘনিষ্ঠ পরিজনরা সম্পর্ক পর্যন্ত রাখাতে চায় না এসময়। ডাক্তার-নার্সরা  কাছে ঘেঁষে না। আর কাছে ঘেঁষলেও নাকমুখশরীর ঢেকে রীতিমতো নভোচারীর রূপে ধরা দেয়। কারণ বাতাসে ভেসে বেড়ানো করোনার সামান্য সর্দি-কণার সংস্পর্শে এলেই নাকি বিপদ। তাই যে একবার হাসপাতালে এ রোগ নিয়ে প্রবেশ করে তাকে একঘরে হয়ে থাকতে হয় হাসপাতালে; কেউ জানতেও পারে না রোগী কোথায়, কেমন আছে। ঠিকাদার আক্কাস আলীর বড় ভাই এলাকার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ওহিদুল করোনা হওয়ার দুদিনের মাথায় হাসপাতালে মারা গেল, জানাজায় পর্যন্ত শরিক হয়নি কেউ। স্বাস্থ্যকর্মীরা আড়ালে-আবডালে কখন যে দাফন-কাফন সেরে নিয়েছে কেউ টেরও পায়নি। প্রাণ খুলে পরিজনের জন্যে কাঁদতেও ভুলে যাচ্ছে মানুষ;   বেশি কাঁদলে যদি রুষ্ট করোনা আক্রমণ করে বসে? ভয়-শঙ্কার এমনি দমবন্ধ পরিবেশ চারধারে। 

পৃথিবী  জুড়ে লাখ লাখ মানুষ করোনায় বেমক্কা মারা যাচ্ছে আর ওর বাবা রয়েছে খাওয়া আর ধর্ম নিয়ে। এ লজ্জা কোথায় রাখবে সে! সব শুনে আশেপাশের নার্স-ডাক্তাররা হেসে কুটি-কুটি। উপজেলার সবার কাছে বিপুল ঘোষ অতি পরিচিত নাম; তাই  হাসির উপর দিয়ে যাচ্ছে;  কেউ কিছু বলছে না। নইলে যে কী হতো! ভেবে-ভেবে রীতিমতো আকুল রতন। 

অথচ বাড়িতে এসে একথা বলতেই শাশুড়ি-বউ জিভ কাটতে শুরু করে দেয়। এত বড় ভুল কিভাবে হল তাদের? ভোজনরসিক মানুষটা যে ভালো-মন্দ খেতে না পেলে খেপে আগুন হবে,  সেকথা তো সবার জানা। তাহলে এ ভুল কেন? ভেবে দুজনই লজ্জায়-সংকোচে মরমে মরে যাচ্ছে যেন! সংসারের প্রতিটি বিষয়ে যার নির্দেশ হয়ে ওঠে অমোঘ, সেই মানুষ না খেয়ে হাসপাতালের শয্যায় গড়াগড়ি খাচ্ছে, তা কি করে হয়?

তাই খাবার নিয়ে যেতে হবে হাসপাতালে। শাশুড়ি-বউয়ের দীর্ঘ আলোচনার পর স্থির হলো বিপুল বাবুর প্রিয় মুখরোচক সব খাদ্য তালিকা। ভুঁড়িওলা পুরুষ; হাপুস-হুপুস করে খেয়ে ঢেঁকুর তুলতে না পারলে খাওয়ার যজ্ঞটাই যেন বৃথা। তাই বরাবর গুরুপাকের খাওয়া-খাদ্যের প্রতি তার নিত্য ঝোঁক। প্রায়ই মিষ্টির কারখানায় বসে তুলে রাখা দুধের সর খাওয়ার অভ্যেস তার। এজন্য ফতুয়ার পকেটে থাকে ওমোপ্রাজল। মাঝে মাঝে মাখন-দই-কলা-মুড়ি-চিড়া দিয়ে ফলাহার সেরে বাসায় ফেরে। তখন বউকে কাতর গলায়  জানায়, ‘পেটাটা ভালা না। পরে খামু।’ আরতি ঠিকই বুঝতে পারে। কথা না বলে সে বিপুল ঘোষের খুলে রাখা ফতুয়ার বুক পকেট থেকে একটা ওমোপ্রাজল বড়ি আর জলের গেলাস নিয়ে দাঁড়ায় মুখের সামনে। মিষ্টি হেসে বলে, ‘ এ্যাইডা খাইয়া লাও। সাইরা যাইবো।’

সেই খানেওলা মানুষটা এখন রোগশয্যায় শুয়ে মুখ ফুটে খেতে চাইছে তা কি বউ-শাশুড়ি না দিয়ে পারে? বাড়ির কর্তাকে সেবা করার এটাও যে একটা মওকা! দাপুটে মানুষ এ সংসারের, তার খাওয়া-দাওয়া কি আর  যেমনে-তেমনে  হবে? তাও আবার হাসপাতালে! বাদাম-কিশমিশ আর ঘি দিয়ে নিরামিষ পোলাও, বেগুনি, নানাপদের নিরামিষ পাকোড়া, আলু-কপির রসা, আলু-পটলের ডালনা, নারকেল-কিশমিশ দিয়ে বুটের ডাল, পনির-আলুর তরকারি, সয়াবিনের তরকারি, পায়েস আর সঙ্গে দুখানা লাল মোহন মিষ্টি দিয়ে বিপুল বাবুর খাবারের আয়োজন হবে- এটাই তো স্বাভাবিক। এ শুধু খাওয়া নয়, এ ঘরের কর্তা করোনা-রোগী বিপুলবাবুর জন্যে এক নিবেদন। দেবতার ভোগের চেয়ে এ কম হবে কোন্ দুঃখে?

সেই আয়োজন এখন বাটিবন্দি হয়ে টিফিনক্যারিয়ারের ভেতর শুয়ে রয়েছে। বারান্দায় পিলারের সঙ্গে হেলান দেয়া আটবাটির টিফিন-ক্যারিয়ারটি এক পায়ে খাড়া হাসপাতালে যাওয়ার জন্যে। রতন ঘোষের তন্দ্রা ভাঙলেই হলো- ব্যস! শাশুড়ি-বউ মিলে বড় যত্ন করে সাজিয়ে দিয়েছে বাটিগুলো। বেশ ওজন টিফিন-ক্যারিয়ারটির। এ পরিবারের লোকজনের ভুঁড়ির মাপ দেখে বোঝা যায় খাওয়া-খাদ্যের পরিমাণ। যদিও পরিবারের ব্যবসায়িক সব গর্ব অপহৃত হয়েছে অনেকদিন, তবু  খাওয়া-খাওয়ানোর গর্বটুকু এখনও অটুট রয়েছে ওদের। সেটুকু ছাড়তে রাজি নয় কেউ। 

ঘোষ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের এককালে খুব নামডাক ছিল। বলা হয় ওদের দোকানে একসময় গভীর রাতে চারধার আলো করে নাকি পরী নামত মিষ্টি খেতে; পেট পুরে মিষ্টি খাওয়ার পর ক্যাশবাক্সে টাকা রেখে ওরা উড়ে চলে যেত আকাশে। তখন ঘোষ মিষ্টিঘর আলোয় আলো হয়ে থাকত। এত আলো যে চোখ খুললে অন্ধ হয়ে যাওয়ার যোগাড়। তাই যেসব কারিগর রাতের বেলায় দোকানে শুয়ে থাকত ওরা সকলেই চোখের উপর গামছা বিছিয়ে রেখে দিত।    

এসবই শোনা কথা। সত্যি কি মিথ্যে রতন জানে না। তবু কেন যেন মন খারাপ হয়। এখনকার দৈন্যদশার কথা ভেবে মন বিমর্ষ হয়ে ওঠে। 

রতন তাকিয়ে থাকে ছাদের দিকে। কেন যেন মনে হয় এবার ওর বাবা বিপুল ঘোষ ভাল হয়ে গেলেই সে বলবে, ‘ব্যাংক থেইক্যা লোনডা লইয়া লও। আমার কি একটা ভবিষ্যত নাই বাবা?’ কথাটা সে বলেই ছাড়বে। বদমেজাজি বাবাকে সে চেনে। সামান্য কারণে রেগে আগুন। এখনও বাবার সামনে মিঁউমিঁউ করতে থাকে। হাতে-পায় কাঁপন ধরে যায়। মনে মনে একটু-আধটু ক্ষোভ থাকলেও সামনে দাঁড়ালে সে বরাবরের মতন নতজানু প্রজা। ছড়িওলা কলাগাছের মতো পিতৃআদেশে ঝুঁকে থাকে মাটির পানে! তাই শেষ পর্যন্ত বলতে পারবে তো সে? নাকি স্ত্রী প্রভাকে দিয়ে বলাবে? প্রভা যেরকম মুখরা আর চোপা জানে, শ্বশুরকে একথা বলা ওর জন্যে ডাল-ভাত। 

একথা ভাবতেই মনটা ওর ভালো হয়ে গেল। চোখের সামনে একটা সুখি পরিবারের ছবি ভাসতে থাকে। উঠোনের মাঝখানে সে দাঁড়ানো আর ওকে ঘিরে দুটো ফুটফুটে শিশু অবিরাম চক্কর কাটছে। একেবারে বাংলা ছায়াছবির দৃশ্য; অদূরে রোদ পোহাচ্ছে শাশুড়ি-বউ; ওরা নিজেদের ভেতর সাংসারিক কথাবার্তায় মগ্ন। মাঝে মাঝে ওদের দিকে তাকিয়ে সহসা রতনের মা আরতি চেঁচিয়ে উঠছে, ‘ব্যথা পাইবো কৈলাম। আস্তে ছুটাছুটি করা।’

মুখের পরতে পরতে সুখের রসে চুবানো হাসির ঝলক। শীতের বেলাতেও বিজলিবাতির মতো জ্বলজ্বল করছে! দৃশ্যটা যত ভাবছে তত ঘুমঘুম ভাবটা গাঢ় হতে চাইছে রতনের। এই শীতে ঘরের বার হতে চাইছে না অলস এই মন। ঠিক তখনি কারখানার পুরনো কারিগর হারুকাকা হন্তদন্ত হয়ে দৌড়ে ওর কাছে এসে দাঁড়াল। রীতিমতো হাঁফাচ্ছেন তিনি।

দাদুর আমলের কর্মচারী হারুকাকা। মিষ্টির কারিগর হিসাবে বেশ নামডাক ছিল একসময়। এ বাড়ির ভেতরঘরে যখন-তখন তার অবারিত যাতায়াত।  ক-সেকেন্ড তিনি নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকেন রতনের শিয়রের সামনে। রতনের চোখে জিজ্ঞাসা। চাদরে ঢাকা হনুওলা দড়ি-চিমসানো বুড়োটে চেহারাটা এই শীতের পড়ন্ত বেলায় কিছুতেই স্পষ্ট হচ্ছে না ওর কাছে। রতন তবু বলে ওঠে, ‘কিতা অইছে কাকা? এই অসময়ে যে? কারখানা তো বন্ধ। কিতা অইছে?’

তবু মানুষটা চুপ। মনে হল ঠোঁট দুটো অস্থির এক আবেগে থরথর করে কাঁপছে। সহসা অন্ধকার মুখটা ন্ইুয়ে ওর কানের কাছে ফিসফিস করে হারুকাকা বলে উঠলেন, ‘বিপুলকাকা আর নাই রে রতন। ভুলে দেহডা শ্মশানে না গিয়া অন্যখানে চইল্যা গেছে রে। কেউ খেয়াল করে নাই। সব শেষ। অত জপতপ করা ধর্মকর্ম মানা মানুষটা শেষকালে কবরে গেল গা। বুকডা ফাইট্যা যাইতাছে আমার।’ বলেই তিনি শব্দ করে কেঁদে ওঠেন। 

কিছুতেই রতন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। ওর সঙ্গে তিনি কি মিছা কথা বলবেন? সে ভালো করে তাকায় হারুকাকার চেহারাটার দিকে। অথচ হারুকাকার মুখটা অন্ধকারময় শীতের জমাট ছায়ায় ঢাকা।

উঠোনের রোদ-মোলায়েম পরশ ছেড়ে শাশুড়ি-বউ পর্যন্ত  ছুটে আসে ওর ঘরে, চেহারাজুড়ে  একরাশ ভয় আর শঙ্কা। দুজনই একসঙ্গে বলে ওঠে, ‘কিতা  অইছে?’ চোখেমুখে ওদের জিজ্ঞাসা। রতন ততক্ষণে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। কড়া চোখে হারুর দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে, ‘অফিংডা কম খাইতে পারো না রাইতে? মাথাডা তুমার গেছে।’ বলে হনহন করে বেরিয়ে পড়ে সে। যাওয়ার সময় বারান্দায় যত্ন করে রেখে দেয়া টিফিন ক্যারিয়ারটি ওর পায়ের ধাক্কা লেগে উল্টে যায়, বাটির মুখ খুলে উপাদেয় খাবারগুলো চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে। কোথও পনিরের টুকরো, কোথাও পায়েস, আবার কোথাও বা গোলাপ-পাঁপড়ির মতো লালমোহনের টুকরো।  সেদিকে তাকিয়ে দেখারও সময় নেই রতনের। ওর সমস্ত শরীর রাগে রিরি করছে। বুড়ো হারু এত মিথ্যে বলতে পারে?

সে দ্রুত পায়ে গেটের বাইরে কংক্রিটের রাস্তায় এসে পড়ে। বাড়ির সামনে রাস্তা। হোন্ডা আর রিক্সা-ঠ্যালাগাড়ি ছাড়া অন্য কোনও ভারী বাহন এখানে লক্ষ করা যায় না। এরকমই একটি হোন্ডা ওকে চাপা দিতে দিতে রাস্তার একপাশে গিয়ে থমকে দাঁড়ায়। চালক পাড়ার পরিচিত লোক। তবু ঘাড় ঘুরিয়ে মুখ ভেংচে উঠল, ‘পাগলা পানি পেডে পরছে নিকি রতইন্যা?’

সঙ্গে সঙ্গে সম্বিৎ ফিরে পায় সে। মনে হলো কোথাও একটা ভুল হচ্ছে ওর। সে দুপা পিছিয়ে ফিরে আসে বাড়ির গেটের ভেতরে। এবার সত্যি সত্যি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায় সে। উঠোনের মাঝখানে বসে ওর বউ আর মা আগের মতো ঠিকই রোদ পোহাচ্ছে আর অনুচ্চ কণ্ঠে কথা বলছে নিজেদের ভেতর।  তাদের চেহারার কোথাও কোনো তাড়া নেই। 

বারান্দায় একপায় দাঁড়ানো টিফিন-ক্যারিয়ারটাও একইরকম রয়েছে। কোথাও কিছু পড়ে নেই। চারপাশ একদম সাফ-সুতরো।  তাহলে হারুকাকা কোথায় গেল? পরক্ষণে মনে মনে হেসে ফেলল সে। এ সময়ে হারুকাকা এ বাড়িতে আসবে কেন? জরুরি কথা হলে তো মোবাইলেই সারতে পারে।  তাহলে?

‘কিরে, টিফিন ক্যারিয়ারটা না-লইয়া পাগলের লাহান কই দৌড়াইলি আতকা?’ মায়ের প্রশ্নে এবার সে লজ্জা পায়।  সহসা মনে হলো, এরকম একটি খবর আজ সকালেই পত্রিকার পাতায় সে দেখেছে। মাথায় কি সেটাই ঘুরপাক খাচ্ছিল এতক্ষণ?

কে জানে!