ভ্রমণ

হঠাৎ বাঘের দেখা রক্ত হিম করা রোমহর্ষক অভিজ্ঞতা 

সুন্দরবনে বাঘের দেখা পাওয়া অনেকের জীবনে; বিশেষ করে যারা ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফি করেন তাদের জন্য এক বিরল প্রাপ্তি। বছরের পর বছর বেঙ্গল টাইগারের দেখা পাওয়ার জন্য অনেকেই ছুটে বেড়ান। কিন্তু বাঘের দেখা পাওয়ার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়। পোড়া কপাল বলে নিজেকে ধিক্কার দেন। নেশার তীব্রতা বেড়ে যায়- এ এক অদম্য নেশা। অথচ এমন অনেকেই আছেন যারা প্রথমবার সুন্দরবনে গিয়েই বাঘের দেখা পেয়েছেন। তবে এদের সংখ্যা খুবই নগন্য।

পরিচিত বেশ কয়েকজন ফটোগ্রাফারের মুখে শুনেছি তারা শতবারের বেশি সময় সুন্দরবনে গিয়েও বাঘের দেখা পাননি। আজ শোনাবো সুন্দরবনে কয়েকজন ওয়াইল্ড ফটোগ্রাফারের বাঘ দেখার সাফল্যের কথা।  

দিনটি ছিল ৩১ মার্চ। আমরা ৯ জনের একটি টিম গিয়েছিলাম সুন্দরবনে। জনপ্রিয় ট্যুর অপারেটর ফেমাস ট্যুর বিডির জাহাজ এমভি গাঙচিলে করে আমাদের যাত্রা শুরু হয়। এবারের টিমে ছিলেন দেশের বরেণ্য ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফার ও কুমির বিশেষজ্ঞ আদনান আজাদ আসিফ, বিশিষ্ট ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফার ফরিদী নোমান, ইমদাদুল ইসলাম বিটু, আরটিভি’র শেরপুর প্রতিনিধি মুগনিউর রহমান মনি, আদনান হোসেন সম্রাট অন্যতম। 

২৯ মার্চ থেকে শুরু করে একটানা চারদিন পুরো সুন্দরবন চষে বেড়াই। এর আগেও বিভিন্ন সময়ে আমরা সুন্দরবনে ফটোগ্রাফি করতে গেছি। তখনও আমাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল বেঙ্গল টাইগারের ছবি তোলা। সেই সঙ্গে সুন্দরবনের অন্যান্য পাখি এবং জীব-বৈচিত্রের ছবি তোলা। তবে এবারের সফরটা ছিল ভিন্ন রকম।

গত কিছুদিন থেকেই বিচ্ছিন্ন ভাবে খবর পাচ্ছিলাম সুন্দরবনে বাঘ দেখা যাচ্ছে। ফেমাস ট্যুর বিডির কর্ণধার ও গাইড তানজিল হোসেন রুবেল আমাদের বাঘের আপডেট জানাচ্ছিলেন। সেই অনুযায়ী ফরিদী নোমান, ইমদাদুল ইসলাম বিটু সুন্দরবন সফরের বিষয়টি চূড়ান্ত করেন। আমাদের সঙ্গে ফরিদপুর থেকে ডা. সাইফুল এবং চুনারুঘাট থেকে মমিনুল ইসলাম ও দেওয়ান ফরহাদ চৌধুরী যোগ দেন।

বলছিলাম এবারের সফরটা ছিল ভিন্ন রকম। অর্থাৎ শুধু বাঘের ছবি তোলার জন্য। পরপর দুইদিন সুন্দরবনের যে সব জায়গায় বাঘের দেখা পাওয়ার খবর পেয়েছি সেসব জায়গা সূর্য ওঠা থেকে সূর্যাস্ত যাওয়া পর্যন্ত চষে বেড়িয়েছি। ট্যুর অপারেটর রুবেলের জন্য এবারের সফরটা সত্যি চ্যালেঞ্জ ছিল। সময় গড়াচ্ছিল সঙ্গে সঙ্গে রুবেলের মধ্যে বিমর্ষতা ছায়া ফেলছিল। একই অবস্থা আমাদেরও। প্রথম দুইদিন বিভিন্ন প্রজাতির পাখি এবং সরিসৃপ জাতীয় নানা প্রাণির দেখা পেলেও আমাদের মধ্যে অনেকের সেসব ছবি তোলার তেমন আগ্রহ দেখা যায়নি। সবার লক্ষ্য ছিল বাঘের ছবি তোলা। কিন্তু তার দেখা না পাওয়ায় কখন যেন সবার মধ্যে একটা হতাশার কালো মেঘ জমে যায়।

জাহাজ বড় নদীতে রেখে আমরা দেশী নৌকায় ছোট ছোট খালে বাঘের সন্ধানে ঘুড়ে বেড়িয়েছি। না কোথাও নেই। এভাবে প্রায় সন্ধ্যা নেমে আসি আসি করছিল। একটা খালের ভেতরে ঢোকার পর নৌকা সামনের দিকে এগুচ্ছে। তখন ভাটা। খালের একটি পাড় ধরে আমাদের নৌকা চলছিল। হঠাৎ রুবেল পুরো শরীর মোচড় ভেঙ্গে অনেকটা চিৎকার দিয়ে বলে ওঠেন- ‘বাঘ! বাঘ!’ একই সঙ্গে ফরিদী নোমানও চিৎকার করে ওঠেন। সঙ্গী মমিনুল ইসলাম অনেকটা সাহসী। এর আগে বন থেকে একটি চিকন গাছ সংগ্রহ করে তার সঙ্গে থাকা চাকু দিয়ে সেটা বল্লমের রূপ দিয়েছিলেন। নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে তিনি দ্রুততার সঙ্গে সেটি হাতে তুলে নেন।

আমাদের মধ্যে তীব্র  উত্তেজনা বিরাজ করছিল। এর আগে আমি থাইল্যান্ড ও ভারতের রানথাম্বর থেকে বাঘের ছবি তুলেছি। তবে সুন্দরবনের বাঘের ছবি তোলাটা যে একটা আলাদা বিষয় সেটা বুঝতে পারি বাঘের চোখে চোখ রেখে ছবি তোলার অভিজ্ঞতা থেকে। রক্তহিম হয়ে যাওয়া এক লোমহর্ষক অভিজ্ঞতা। বাঘের চোখে চোখ রেখে ছবি তোলার অভিজ্ঞতা অর্জন করার সৌভাগ্য যাদের এখনো হয়নি তাদের পক্ষে এই অনুভূতি অনুভব করা সম্ভব নয়। তবে তাদের জন্য শুভ কামনা রইল। তবে এতটা কাছ থেকে সুন্দরবনে বাঘের ছবি তোলার রেকর্ড আছে কিনা আমার জানা নেই। মাত্র ১৫ থেকে ৩০ ফুট দূর থেকে আমরা ছবি তুলতে পেরেছি। কখনো কখনো ছবি তুলতে তুলতে বিপজ্জনক অবস্থায় চলে গেছি কেউ বুঝতে পারিনি।

শুরুতে আমাদের মধ্যে যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছিল সেটা ইমদাদুল ইমলাম বিটু এবং আদনান আজাদের ধমকে বন্ধ হয়ে যায়। তবে সেটা কাজে লেগেছিল পরে আর কেউ কোনো শব্দ করেননি।  আমরা কেউ বিশ্বাস করতে পারছিলাম না এমন একটি সুবর্ণ অভিজ্ঞতার ঝুড়ি নিয়ে ঘরে ফিরতে পারবো। মুহূর্তের মধ্যে সব ভয় কাটিয়ে সবাই ক্যামেরা তুলে ছবি তুলতে থাকি। ক্রমাগত শার্টার টেপার শব্দ। চোখ দুটো জ্বলজ্বল  করছে। মাটি থেকে ৬/৭ ফুট উঁচু একটি গাছের ডাল খালের দিকে ঝুলে পড়েছে। ইংরেজী ওয়াই টাইপের একটি ডালের দুপাশে দু’পা ছড়িয়ে আয়েশের সঙ্গে বসে ছিল সে। ভয় ছিল সে ইচ্ছে করলে যে কোনো সময় আমাদের নৌকার উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারতো। 

প্রথম দিকে আমাদের দিকে তার দৃষ্টি ছিল তীক্ষ্ম। ঝুলে থাকা লেজটা অনবরত দুলছিল। আর এদিক ওদিক তাকাচ্ছিল। তবে তার সতর্ক দৃষ্টি ছিল আমাদের উপর। যখনই আমরা অসাবধানতায় কাছাকাছি চলে গেছি তখনই সে বিষয়টি খেয়াল করে তার অভিব্যক্তি দিয়ে তা বুঝিয়ে দিয়েছে আর সতর্ক হয়ে উঠেছে। এর মধ্যে সে দু’বার গাছের ডালে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে। তার পায়ের নখগুলো বের হয়ে গাছের ডালে শক্ত হয়ে গেথে গেছে। আর তখনই আদনান আজাদ বলে ওঠেন, আর নয়, এর মোটিভ ভালো নয়। চলেন ব্যাক করি। এখানে আর থাকা উচিত হবে না। যখন আমরা স্থান ত্যাগ করি তখনও বাঘটি সেখানেই বসে ছিল। আমরা এক ঘণ্টারও বেশি সময় তার ছবি তুলতে পেরেছি।

বন বিভাগ থেকে সুন্দরবনের বাঘ গণনা কর্মসূচির আনুষ্ঠানিক ঘোষণা করা হয় ৩১ মার্চ। প্রায় ৩৬ কোটি টাকার বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্পের আওতায় বাঘ শুমারির জন্য সোয়া ৩ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। খুব শিগগির এ গণনার কাজ শুরু হবে। সে সময় তিন মাস সুন্দরবনে বহিরাগতদের ঢোকা সম্পূর্ণ বন্ধ থাকবে বলে জানা গেছে। ফরিদী নোমান ভাই বললেন, সুন্দরবনে সব মিলিয়ে আমি প্রায় শতাধিকবার ভ্রমণ করেছি। কিন্তু কখনও বাঘের দেখা মেলেনি, ফলে ছবিও তোলা হয়নি। এ এক রোমহর্ষক অভিজ্ঞতা। এত কাছ থেকে বাঘের ছবি তুলতে পারবো কল্পনা করিনি কোনো দিন।

সেদিন সুন্দরবনে কটকা'র সমুদ্রের মোহনায় ঢেউয়ের কারণে বোট নিয়ে এই খালটিতে আমাদের ঢুকতে হয়েছে। কটকা অফিস পাড়াতেই বিকেলে নামার পরিকল্পনা ছিল। খারাপ আবহাওয়ার কারণে প্রায় ১০ কিলোমিটার সরে এসেছি আমরা। প্রথম যে শাখা-খালে ঢুকি সেখান থেকে কয়েকটা ব্রাউন-উইঙড কিংফিশার, স্মল মিনিভেট, স্পেকলড পিকুলেটসহ আরো কিছু ছোট পাখির দেখা মিললো। শাখা-খালটি থেকে বেরিয়ে বাঁয়ের আরেকটি খালে ঢোকার চেষ্টা করলাম, পানি কম থাকায় সেখান থেকেও বেরিয়ে এসে ডানদিকে কিছুদূর এগোনোর পর কেওড়া পাতার ফাঁকে গাড়ো হলুদ বাঘটিকে দেখতে পাই। খালের পাড়ে বেশিরভাগই কেওড়া গাছ। মাঝে পানিতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা একটা বাইন গাছের ওপর খুব আয়েশি ভঙ্গিতে বেঙ্গল টাইগার বসে আছে। এটা যে কোনো ফটোগ্রাফারের জন্য অনেক বড় প্রাপ্তি।

আদনান আজাদ আসিফ বলেন, আমরা একটা ইতিহাসের সাক্ষি হয়ে রইলাম। ইদানিং সুন্দরবনে বাঘের দেখা মিলছে। এভাবে আগে কখনো দেখা যায়নি। এর আগে গত ১২ মার্চ সুন্দরবনে ঘুরতে গিয়ে পর্যটকরা ৫টি বাঘ দেখেছে। বনজীবী ও বনরক্ষীরাও জানিয়েছেন মাঝেমধ্যেই বাঘের দেখা মিলছে। তবে সেটা অনেক দূর থেকে। কখনো তাদের সাঁতরিয়ে নদী পাড় হতে দেখা গেছে আবার কখনো গোলপাতা বা ঘন বনে স্বল্প সময়ের মতো দেখা গেছে। তবে এবারের মতো এত কাছে থেকে এবং দীর্ঘ সময় ধরে ছবি তোলার সুযোগ পাওয়ার কোনো উদাহরণ নেই। হয়তো সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা বেড়েছে বলেই তাদের দেখা মিলছে।

ছবি: লেখক ও ফেমাস ট্যুর বিডি