ভ্রমণ

‘ভয়ঙ্কর সুন্দর’ সুন্দরবনে হঠাৎ বাঘের মুখোমুখি  

সুন্দরবন থেকে ফিরে আসার পর থেকেই একটা বিষয় খুব ভাবিয়ে তুলছিল। আমরা যারা একসঙ্গে গিয়েছিলাম তাদের সঙ্গে কেন জানি শেয়ার করতে পারছিলাম না। এটা কি কাকতালীয় নাকি সবার অনুভূতির ঐকতান? না হলে সবাই কেন একসঙ্গে বলে উঠলাম ‘ভয়ঙ্কর সুন্দর’!

সেদিন ছিল ৩১ মার্চ, স্বাধীনতার মাসের শেষ দিন। এর আগে সুন্দরবনে আমাদের যাত্রা শুরু হয় ২৮ মার্চ। এবারই শুধু নয়, আমাদের অনেকেই বহুবার সুন্দরবন ভ্রমণে গেছেন। উদ্দেশ্য একটাই বিশ্বখ্যাত বেঙ্গল টাইগারের দেখা পাওয়া বা ছবি তোলা। যারা ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফি করেন তারা সুন্দরবনের বাঘের ছবি তোলার স্বপ্নটাকে মাথায় রেখেই ঝুঁকিপূর্ণ এই নেশায় আত্মনিয়োগ করেন। অন্তত আমার অনুভূতি তাই বলে।

সে যাই হোক, ২৯ মার্চ ভোরে আমাদের বহনকারী ফেমাস বিডি ট্যুরস-এর জাহাজ এমবি গাঙচিল সুন্দরবনের উদ্দেশ্যে মংলা ছাড়ে। দীর্ঘপথ চলার পর সরকারি রাজস্ব পরিশোধ এবং জাহাজে নিরাপত্তার জন্য একজন বনরক্ষী সঙ্গে নেওয়ার বিধান রয়েছে। সেটা সম্পন্ন করতে কিছুটা সময় লেগে যায়। এরপর আমাদের যাত্রা শুরু  হয়। রাতের অন্ধকার নেমে এলেই আমরা জাহাজে ফিরে আসতাম। এছাড়া পুরো সময়টা কখনো জাহাজে আবার কখনো দেশী নৌকায় সুন্দরবনের এক নদী থেকে আরেক নদী, এ খাল থেকে আরেক খালে ছুটে বেড়িয়েছি।

সমমনা না হলে এ ধরনের ট্রিপ সফল করা খুব কঠিন। বিশেষ করে গাইডের নির্দেশনা মেনে না চললে যে কোনো সময় সমস্যা দেখা দিতে পারে। আমাদের ৯ সদস্যের টিমটাও সেভাবেই নির্বাচন করা হয়েছিল। এর মধ্যে ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফার ফরিদী নোমান, ইমদাদুল ইসলাম বিটু, কুমির বিশেষজ্ঞ আদনান আজাদ আসিফ, আদনান হোসেন সম্রাট, সাইফুল ইমলাম, আরটিভি’র শেরপুর প্রতিনিধি মুগনিউর রহমান মনি ছিলেন। এ ছাড়াও হাবিগঞ্জের চুনারুঘাটের বন্ধু মোমেনুল ইসলাম এবং ফরহাদ চৌধুরী আমাদের টিমের সদস্য ছিলেন।

লেখাটা যখন লিখতে বসেছি তখন এপ্রিলের ৮ তারিখ। সুন্দরবন থেকে ফিরে আসার পর বারবার মনে হয়েছে এও কি সম্ভব! যে বাঘের ভয়ে মানুষের রক্ত হিম হয়ে যায়, তারই ছবি তুললাম এত কাছে থেকে! এটা সত্যি বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। আমার ব্যক্তিগত ধারণা ছিল বনের ভেতর উঁকি দিয়ে আছে কিংবা নদী পাড় হচ্ছে, বা দূরে কোনো হরিণ শাবককে আক্রমণ করেছে- বাঘের এমন ছবি পেলেও পেতে পারি। সুন্দরবন ভ্রমণে গিয়েই বাঘের দেখা পাওয়া যাবে, এটা যারা ভাবেন তাদের ভাবনাটা ভুল।

সুন্দরবনকে বলা হয় ‘আনপ্রেডিক্টেবল’! কখন কী ঘটে সেটা বোঝা খুবই কষ্টসাধ্য। বছরের পর বছর শতবার সুন্দরবনে গিয়েও অনেকে বাঘের দেখা পান না। আবার জীবনের প্রথমবার গিয়েই খুব কাছ থেকে বাঘের দেখা পেয়েছেন এমন অনেকেই আছেন। এ বিষয়ে আমাদের টিমের অন্যতম সদস্য বিশিষ্ট ফটোগ্রাফার ও চিত্রশিল্পী ফরিদী নোমান বলেন, আমি প্রায় ২০ বছরে সুন্দরবনে শতাধিকবার গিয়েছি। অনেক দুর্লভ পাখি ও অন্যান্য জীবজন্তুর ছবি তুলেছি কিন্তু বাঘের দেখা পাইনি। এবরাই প্রথম নিজ চোখে বাঘ দেখলাম এবং ছবি তুলে দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা পূরণ করলাম। এই অনুভূতি প্রকাশ করার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি।

ফরিদী নোমানকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, আলোক স্বল্পতার কারণে ছবি তোলা শেষ ঘোষণা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সবাই একসঙ্গে ‘ভয়ঙ্কর সুন্দর’ বলে আনন্দ প্রকাশ করে। এটা কি পূর্ব পরিকল্পিত নাকি স্বতঃস্ফূর্ত? তিনি জবাব দেন, এটা সত্যি একটি অনন্য অভিব্যক্তি। সবাই ছবি তোলা শেষে একযোগে ‘ভয়ঙ্কর সুন্দর’ শব্দটি উচ্চারণ করেছে!

আমাদের টিমের প্রফেশনাল ফটোগ্রাফার ইমদাদুল ইসলাম বিটু ‘ভয়ঙ্কর সুন্দর’র বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলেন, বাঘ সম্পর্কে আমাদের মধ্যে একটা ভীতিকর অনুভূতি কাজ করে। আর সেটা যথার্থ। স্বভাবের দিক থেকে এই প্রাণী এতটাই ভয়ঙ্কর যা বর্ণনাতীত। পাশাপাশি আমরা যেভাবে দেখেছি তারা ছাড়া আর কারো পক্ষে এর সৌন্দর্যের বর্ণনা দেওয়া সম্ভব নয়। আমাদের দেখা বাঘের চেহারাটা যে সুন্দর ছিল সেটা শুধু আমরাই অনুভব করেছি। এটা ছিল আমাদের পরম পাওয়া। ছবি তোলা শেষে সবাই যখন আমরা আনন্দ প্রকাশ করি তখন একযোগে ‘ভয়ঙ্কর সুন্দর’ শব্দটাই মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছে। যা অনেকটা কাকতালীয়।

ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফার ও কুমির বিশেষজ্ঞ আদনান আজাদ আসিফ বলেন, বাঘের ছবি পাবো কি পাবো না এ নিয়ে দ্বিধা ছিল। একদিকে ভ্রমণের শেষ দিন, অন্যদিকে সন্ধ্যা নেমে আসছিল। প্রকাশ না করলেও সবার মধ্যে এক ধরনের হতাশা ফুটে উঠছিল যে, আমরা বোধহয় এবারও বাঘের দেখা পেলাম না। আমাদের নৌকা যখন একটি মরাকালের কাছে পৌঁছায় তখন হঠাৎ আমাদের মধ্য থেকে বাঘ...বাঘ...বলে অস্ফুট আওয়াজ শোনার পর সবাই যে যার মতো করে খুঁজতে শুরু করে বাঘটা আসলে কোথায়?

কেউ খালের কিনারে আবার কেউ খালের অন্যপাড়ে ক্যামেরা তাক করে বাঘ খুঁজতে থাকে। হঠাৎ সবাই একযোগে দেখতে পায় বাঘ খালের উপর একটি বাইন গাছের ডালে বসে আছে। কোনো কথা না বলে একযোগে ৭টি ক্যামেরার শার্টার একযোগে ক্লিক হয়। মনে হয় যেন যুদ্ধক্ষেত্রে মেশিন গানের গুলি ছোড়া হচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ এভাবে তোলার পর সবাই সম্বিত ফিরে পান। কেউ ভাবতেই পারেননি গাছের ডালে এভাবে বাঘ বসে থাকবে। আমরা যখন বাঘটিকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করি তখন দেখতে পাই তার গায়ে কোথাও একটু কাঁদা বা ভেজার চিহ্ন নেই। এতে বোঝা যায় বাঘটি খালে জোয়ারের আগে থেকে ওখানে আশ্রয় নিয়েছিল। ভাটির সময় সে নিচে নামেনি। গাছের ডালে বসে সে আমাদের দেখে বারবার লেজ নাড়াচ্ছিল। এটা ভালো লক্ষণ ছিল না।

আদনান আজাদ বলেন, বাঘ সাধারণ একটু কম আলোতে শিকার করতে পছন্দ করে। তাই সে হয়তো গাছের ডালে বসে শিকারের অপেক্ষায় ছিল। আমাদের দেখা বাঘটি খুব বেশি হলে তিন থেকে সাড়ে তিন বছরের একটি পুরুষ বাঘ। খুব অল্প দিন হয়েছে সে তার পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে। এখন তার একা একা শিকার করে বেঁচে থাকতে হবে। নিজের আবাসভূমি নির্ধারণ করতে হবে। বড় বাঘেদের সঙ্গে যুদ্ধ করে তাকে টিকে থাকতে হবে। এই বয়সের বাঘ অনেক সময় মারা পড়ার আশঙ্কা থাকে, ফলে বাঘের সংখ্যা কমে যাওয়ার ভয় থাকে।  

সুন্দরবনে প্রায় ৩৩৪ প্রজাতির উদ্ভিদ এবং ৩৭৫ প্রজাতির নানা বন্যপ্রাণীর বাস। সুন্দরবনের নোনা পানির কুমির, গুইসাপ, শূকর, সামুদ্রিক মাছ, কচ্ছপ, বিভিন্ন প্রজাতির সাপ এবং সরীসৃপ জাতীয় উভচর এবং জলচর প্রাণী যেমন রয়েছে, একইভাবে পুরোবন চষে বেড়াচ্ছে চিত্রা হরিণ। আকাশে উড়ে চলা হরেক রকম পাখি, গাছের শাখায় দাপট দেখানো বানর কিংবা ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা সুন্দরীর শ্বাসমূল, গেওয়া, গরান এবং কেওড়া- এই সব কিছুই যেন সুন্দরবনের অলঙ্কার। আর প্রায় ৬ হাজার বর্গ কিলোমিটার বনের রাজা বেঙ্গল টাইগার। সে ছাড়া সুন্দরবনের সৌন্দর্য অনেকটাই অর্থহীন।

বলা হয়ে থাকে ভারতীয় উপমহাদেশে যত ধরনের বাঘের দেখা মেলে, তাদের মধ্যে আকারে বড়, ক্ষিপ্রগতিসম্পন্ন এবং হিংস্রতার দিক থেকে বেঙ্গল টাইগারের জুড়ি নেই। শুধু উপমহাদেশ নয়, বিশ্বের বাঘ পরিবারের সিংহভাগ সদস্য বেঙ্গল টাইগার গোত্রের অন্তর্ভুক্ত। বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল এবং ভুটানের বনাঞ্চলে বেঙ্গল টাইগার দেখা যায়। যারা সুন্দরবনে যাননি কিংবা গেলেও রয়েল বেঙ্গল টাইগার দেখতে পাননি, তাদের কাছে বাঘ একটি বিস্ময়কর প্রাণী। যারা বাঘ দেখেছেন তাদের কাছে বাঘ অসম্ভব সুন্দর! এবং যাদের খুব কাছে থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে তাদের কাছে বাঘ ‘ভয়ঙ্কর সুন্দর’। সাহিত্যের পাতার ‘ভয়ঙ্কর সুন্দর’ কথাটির অর্থ বুঝতে হলে আপনাকে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে থাকিতে হবে।

সেই অনিন্দ্য সুন্দর মুহূর্তের কথা মনে হলে এখনও গা ছমছম করে। মোটা পা, মজবুত দাঁত ও চোয়াল এবং দেহজুড়ে রঙের বাহারি নকশাখচিত ডোরাকাটা একটি প্রাণী। বাঘটির গায়ের রঙ পেটের দিকে হলুদ থেকে হালকা কমলা রঙের ছিল। পায়ের ভেতরের দিকে সাদা। গায়ের কমলা রঙের উপর লম্বালম্বি কালো, ধূসর বা বাদামি ডোরাকাটা দাগ। লেজের দিকে এ দাগ গোলাকৃতি। বাঘটির চোখের রঙ ছিল হলদেটে। বারবার লেজ নাড়ছিল। তবে আমাদের দিকে তার নজর ছিল তীক্ষ্ম। 

রয়েল বেঙ্গল টাইগার নিয়ে বিভিন্ন গবেষণাপত্র থেকে জানা যায়, পৃথিবীর প্রতিটি বাঘের গায়ের ডোরাকাটা দাগের ধরন একে অপরের থেকে আলাদা। অর্থাৎ দুটো বাঘের ডোরাকাটা দাগ কখনও এক হবে না। অনেকটা মানুষের চেহারা বা আঙুলের ছাপের মতো। মূলত এ বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে বাঘ গণনা করা হয়। একটি বাঘ গড়ে ১০-১৫ বছর পর্যন্ত বাঁচে। পুরুষ বাঘের ওজন গড়ে ২২৫ কেজি এবং বাঘিনীদের গড় ওজন ১৩৫ কেজি। এদের দেহের দৈর্ঘ্য প্রায় নয় ফুট। এদের দাঁত খুব শক্ত হয়। আকারে প্রায় ১০ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্যের এই দাঁতের কামড় থেকে শিকার সহজে বের হতে পারে না।

মাংসাশী প্রাণী হওয়ার কারণে বাঘ মাঝারি থেকে বড় আকারের বিভিন্ন স্তন্যপায়ী প্রাণী শিকার করে। বনাঞ্চল ধ্বংসের ফলে খাবারে ঘাটতি দেখা দিলে এরা বনের পার্শ্ববর্তী মানুষের বসতিতেও আক্রমণ করে। এরা একেবারে ৬০ কেজি পর্যন্ত খাদ্যগ্রহণ করতে পারে। তবে সাধারণত একটি শিকার একবারে না খেয়ে ২/৩ দিন ধরে খায়। বাঘ সাধারণত মানুষের সামনে পড়তে চায় না। কিন্তু কিছু কিছু বাঘের মানুষখেকো হয়ে ওঠার প্রমাণও পাওয়া গেছে।

বাঘের কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। বিশেষ করে বেশি দূরত্ব পর্যন্ত শিকারকে তাড়া করতে না পারা। এজন্য এরা ঝোপঝাড়ে লুকিয়ে থেকে শিকার করে। বাঘ কারো চেহারা একবার দেখলে ভোলে না। স্মৃতিশক্তি মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীর চেয়ে তুলনামূলক বেশি। আমরাও সেদিন যে স্মৃতি নিয়ে সুন্দরবন থেকে ফিরে এলাম মনে থাকবে সারাজীবন। ‘ভয়ঙ্কর সুন্দর’ সুন্দরবনে হঠাৎ বাঘের মুখোমুখি- ভাবা যায়!