শিল্প ও সাহিত্য

বাংলা সনের জন্মকথা

আমাদের দৈনন্দিন জীবনে বাংলা বর্ষপঞ্জির গুরুত্ব দিন দিন কমছে। অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ সবকিছুই পরিচালিত হয় গ্রেগরিয়ান বা খ্রিস্টীয় ক্যালেন্ডার অনুযায়ী। এ কথা ঠিক আধুনিক বিশ্বের সব বাণিজ্যিক, অর্থনৈতিক তথা জাগতিক কর্মকাণ্ড গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী পরিচালিত হয়। আমাদের দেশে এই ক্যালেন্ডার প্রবর্তন করে ইংরেজ শাসকরা। তাই আমরা অনেক সময় এই ক্যালেন্ডারকে ইংরেজি বর্ষপঞ্জি বলি।

তবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এই খিস্ট্রীয় ক্যালেন্ডারের পাশাপাশি তাদের নিজস্ব বর্ষপঞ্জিও মেনে চলে। সেটা তারা করে নিজেদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে ভালোবেসে। যেমন পারস্যের নওরোজ উৎসব তাদের নিজস্ব পারসিক বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী হয়। চীনে দেখেছি তাদের লুনার ক্যালেন্ডার বা ঐতিহ্যবাহী চান্দ্র পঞ্জিকা মেনে চলতে। চীনের দাপ্তরিক, বাণিজ্যিক, শিক্ষা সম্বন্ধীয় সব কাজ খ্রিস্টীয় বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী চলে। কিন্তু তারা ঠিকই তাদের লুনার ক্যালেন্ডারটি অনুসরণ করে নানা রকম উৎসব পার্বণ উদযাপনে এবং লোকজ সংস্কৃতির নানা অনুষঙ্গে। তাদের নববর্ষ, মধ্য শরৎ উৎসব, ড্রাগন বোট ফেস্টিভ্যাল ইত্যাদি উৎসবগুলো চান্দ্র বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী হয়। 

আমাদের বাংলা বর্ষপঞ্জির সুদীর্ঘ এবং গৌরবময় ঐতিহ্য রয়েছে। আবহমান কাল থেকেই বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণসহ বারো মাস বাঙালির নিজস্ব ছিল। এই মাসগুলো ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যান্য স্থানেও প্রচলিত। তবে মাসগুলোর নামের উচ্চারণে কিছু কিছু পার্থক্য রয়েছে। যেমন শ্রাবণকে কোথাও কোথাও শাওয়ান, শাওয়ারিয়া, সাভারিয়া ইত্যাদি উচ্চারণ করা হয়। সেদিক থেকে এই মাসগুলোকে ভারতীয় উপমহাদেশের বা দক্ষিণ এশিয়ার নিজস্ব বলেও অভিহিত করা যেতে পারে। মাসগুলোর নাম অধিকাংশই এসেছে সংস্কৃত থেকে। তাহলে ভাবা যেতে পারে, বর্তমানে যে মাসগুলো প্রচলিত তা আর্যসভ্যতার অবদান। 

বাংলাসহ ভারতীয় ভূখণ্ডে শকাব্দ, লক্ষণাব্দ ইত্যাদি যে বর্ষপঞ্জি প্রচলিত ছিল তাতে এই মাসগুলোই ছিল। বস্তুত বিভিন্ন প্রদেশের বা অঞ্চলের রাজা, সম্রাট বা সামন্ত নৃপতি ভিন্ন ভিন্ন অব্দ বা সন চালু করেছিলেন। তবে মাসগুলোর নাম মোটামুটি কাছাকাছি বা একই ছিল। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সনগুলো ছিল চান্দ্র-সৌর মিশ্র সন। এর মানে হলো, মাস গণনা করা হতো চান্দ্র পদ্ধতিতে আর বছর গণনা করা হতো সৌর পদ্ধতিতে। ব্যাকরণ অনুযায়ী অগ্রহায়ণ মানে অগ্র+ হায়ণ(বৎসর)। অর্থাৎ বছরের প্রথম। অগ্রহায়ণ মাসে সে সময় নতুন ফসল উঠতো। এ থেকে ধারণা করা যেতে পারে প্রাচীন বাংলায় হয়তো বছরের প্রথম মাস ছিল অগ্রহায়ণ। এমনটি হতে পারে যে, ভারতের অনেক স্থানেই অগ্রহায়ণ মাসেই বছর শুরু হতো। এর সঙ্গে ফসল তোলার প্রাচীন উৎসব এবং বাংলার নবান্ন উৎসবেরও যোগ ছিল। 

চান্দ্র মাস আর সৌর বৎসরের মধ্যে সমন্বয় করার জন্য তিন বছর পরপর একটি অতিরিক্ত চান্দ্র মাস গণনার রীতি ছিল। এই অতিরিক্ত মাসটিকে বলা হতো মলো মাস। মলো মাসে পূজাপার্বণ নিষিদ্ধ ছিল। চাঁদের বিভিন্ন তিথির সঙ্গে মাসগুলোর নাম জড়িয়ে আছে। যে মাসে চাঁদ যে নক্ষত্রে পূর্ণিমা দেখায় সেই নক্ষত্রের নাম অনুসারেই মাসের নাম। বৈশাখে চাঁদ বিশাখা নক্ষত্রে পূর্ণিমা দেখায়। তাই মাসের নাম বৈশাখ। 

ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ও ড. মুহম্মদ তকীয়ূল্লাহ

এদিকে ১২০১ সালে বখতিয়ার খিলজির বাংলাজয়ের পর বিভিন্ন অঞ্চলে হিজরি সনেরও প্রচলন শুরু হয়। বিশেষ করে দরবারের কাজকর্মে। ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশ সুবা বাংলা নামে মোগল সাম্রাজ্যের অন্তর্গত হয়। সে সময় পুরো সুবাতে খাজনা আদায়ের জন্য একটা সমন্বিত বর্ষপঞ্জির প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হতে থাকে। মোগল সম্রাট আকবরের নির্দেশে আমির ফতেহউল্লাহ সিরাজি মলমাস বাদ দিয়ে সৌর বর্ষের বৈশিষ্ট্য নিয়ে একটি বর্ষপঞ্জি প্রণয়ন করেন। মূলত হিজরি সনকে ফসলী সনে রূপান্তরিত করা হয়। তবে মাসের নামের ক্ষেত্রে বাংলা(বা সংস্কৃত) নামগুলোই রাখা হয়। সে সময় থেকে বৈশাখকে প্রথম মাস হিসেবে গণনা করা হয়। বাংলা সনের জন্ম ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে একথা মোটামুটিভাবে অধিকাংশ পঞ্জিকা বিশারদ মেনে নিয়েছেন। 

বাংলা মাস কখনো ৩০, ৩১ এমনকি ৩২ দিনেও হতো। কালের বিবর্তনে বাংলা বর্ষপঞ্জিতে বেশ কিছু জটিলতা ও সমস্যা দেখা দিতে থাকে। পঞ্জিকা প্রণেতা ও জ্যোতির্বিদদের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে বাংলা বর্ষপঞ্জি। কবে কোন মাস শুরু হবে, কবে কোন বছর শুরু হবে তা আগে থেকে বলার উপায় হয়ে পড়ে অত্যন্ত জটিল। বাংলা ক্যালেন্ডার প্রণয়ন করাও প্রায় দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। এই অবস্থায় ১৯৬৩ সালে বাংলা একাডেমি ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে সুদক্ষ ও খ্যাতনামা পণ্ডিত ও জ্যোতির্বিদদের সমন্বয়ে একটি বাংলা পঞ্জিকা সংস্কার উপসংঘ গঠন করে। এই উপসংঘের সদস্য ছিলেন অধ্যাপক আবুল কাশেম, পণ্ডিত তারাপদ ভট্টাচার্য, কাব্য-ব্যাকরণ-পুরাণ স্মৃতিতীর্থ ভাগবত শাস্ত্রী, সাহিত্যোপাধ্যায় স্মৃতি-পুরাণ রত্ন জ্যোতিঃ শাস্ত্রী; পণ্ডিত অবিনাশ চন্দ্র কাব্য জ্যোতিস্তীর্থ, পণ্ডিত সতীশচন্দ্র শিরোমণি জ্যোর্তিভূষণ এবং বাংলা একাডেমির তৎকালীন পরিচালক সৈয়দ আলী আহসান। ১৯৬৬ সালে ১৭ ফেব্রুয়ারি কমিটি চূড়ান্ত রিপোর্ট পেশ করে। অধ্যক্ষ এম এ হামিদ এই সভায় নিয়মিত অতিথি হিসেবে যোগ দেন।

এই বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী ষাটের দশকের শেষদিকে বাংলা নববর্ষ উদযাপন হতে থাকে। বাংলা ক্যালেন্ডার এবং বাংলা নববর্ষ তখন কেবল সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ অংশই ছিল না সেটি ছিল পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক প্রতিবাদও। ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম হয়। স্বাধীন দেশে নতুনভাবে বাঙালি জাতিসত্তার পরিচয়বাহী বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রয়োজন অনুভূত হয়। সেময় মুহম্মদ তকীয়ূল্লাহ ১৯৭২ সাল থেকে বাংলা প্রচলিত বর্ষপঞ্জি সংস্কারের জন্য গবেষণা শুরু করেন। কারণ শহীদুল্লাহ কমিটি প্রণীত বর্ষপঞ্জিতে কিছু কিছু দুর্বলতা ছিল। আর চিরাচরিত বাংলা পঞ্জিকার সবচেয়ে বড় ত্রুটি ছিল যে এর লিপ ইয়ার গণনার পদ্ধতি সুনির্দিষ্ট ছিল না এবং বর্ষ গণনায় বর্ষমানের পরিমাপের সঙ্গে লিপ ইয়ার গণনা সঙ্গতিপূর্ণ নয়। চারশ বছর পরে পহেলা বৈশাখ তিনদিন সরে যাওয়ার আশঙ্কাও ছিল। মুহম্মদ তকীয়ূল্লাহ (১৯২৬-২০১৭) ছিলেন ভাষা আন্দোলনের অন্যতম নেতা, সংগঠক এবং এ দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম নেতা ও সক্রিয় কর্মী। তিনি ভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর পুত্র। তাঁর পুরো নাম আবুল জামাল মুহম্মদ তকীয়ূল্লাহ। অনেকেই জানেন এখন যে সরকারি বাংলা বর্ষপঞ্জি বাংলাদেশে চালু রয়েছে তা খুবই সহজ। এতে খ্রিস্টীয় সন ও বঙ্গাব্দের মাসগুলোর তারিখ সব সময়ের জন্য স্থির রয়েছে। ফলে প্রতিবছরই ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ হবে। একইভাবে অন্যান্য মাসের তারিখও স্থির থাকছে। এই বর্ষপঞ্জিটির মূল প্রণেতা মুহম্মদ তকীয়ূল্লাহ। ১৯৯৬ সাল থেকে এই বর্ষপঞ্জি বাংলাদেশে চলছে। তবে সম্প্রতি এই বর্ষপঞ্জির আরও কিছু সংস্কার করা হয়েছে। এটিকে বাংলা একাডেমি প্রণীত বর্ষপঞ্জি নামেই পরিচয় করানো হয়। 

১৯৮৮-৮৯ সালে ১৩৯৫ বঙ্গাব্দে বাংলাদেশে একটি সমন্বিত বিজ্ঞানসম্মত বর্ষপঞ্জি প্রবর্তনের কথা মুহম্মদ তকীয়ূল্লাহ ও অন্যান্য লেখকরা বিভিন্ন পত্রিকায় লিখতে থাকেন। ফলে বিষয়টি বিবেচনার জন্য বাংলা একাডেমি একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে। তকীয়ূল্লাহ এবং অন্যান্যদের দেওয়া প্রস্তাব বিবেচনা করে। পরে তার প্রস্তাব গ্রহণ করে শহীদুল্লাহ কমিটির লিপ ইয়ার সংক্রান্ত প্রস্তাবের সংস্কার করা হয়।

বাংলাদেশ সরকার বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশ অনুমোদন করে ১৯৯৬ সালে বঙ্গাব্দ ১৪০২-১৪০৩ বর্ষপঞ্জি প্রকাশ করে। এর নাম দেওয়া হয় শহীদুল্লাহ পঞ্জিকা। এই ক্যালেন্ডার ভবিষ্যতেও কোনোদিন পরিবর্তন হওয়ার আশঙ্কা নেই। এই ক্যালেন্ডারের প্রস্তাব পেশ করার সময় মুহম্মদ তকীয়ূল্লাহ ১ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৩৭৯৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ক্যালেন্ডার তৈরি করেন এবং তা বাংলা একাডেমির বিশেষজ্ঞ কমিটিতে পেশ করে দেখিয়েছিলেন যে এর কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না। নতুন নিয়মে যে বাংলা পঞ্জিকা চলছে তা ঋতুনিষ্ঠ সায়ন (ট্রপিকাল) পঞ্জিকা।

বাংলা বর্ষপঞ্জি আমাদের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমাদের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে এর ব্যবহার আরও বাড়ানো প্রয়োজন। আমাদের জাতীয় দিবসগুলো বিশেষ করে বর্ষবরণ, পহেলা ফাল্গুন (বসন্ত উৎসব), নবান্ন উৎসব, বর্ষাবরণ (পহেলা আষাঢ়), পিঠা উৎসব এবং ২৫শে বৈশাখে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন, ১১ জ্যৈষ্ঠ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিন ইত্যাদি দিবসগুলো আমরা যত বেশি বাংলা ক্যালেন্ডার অনুযায়ী করতে পারি ততোই ভালো।  নতুন প্রজন্মের কাছে আমাদের গৌরবময় সংস্কৃতি তুলে ধরা, বাংলা মাসের নামগুলো তাদের শিক্ষা দেওয়া প্রয়োজন। বাংলা কত সাল প্রশ্ন করলে আমরা অনেক সময়ই সঠিক উত্তর দিতে পারি না। এটা লজ্জার বিষয়। 

বাংলা ১৪২৯ সন সকলের জন্য শুভ ও কল্যাণকর হোক। শুভ নববর্ষ। 

লেখক: কবি ও সাংবাদিক