ভ্রমণ

ভুটানের পাঠকশূন্য জাতীয় গ্রন্থাগারে  

এমাদাসি কেওয়াদাসি: ৩য় পর্ব

ভোরে রওনা দিলাম বুদ্ধা পয়েন্টের দিকে। সারাদিন যে মূর্তি স্বর্ণের মতো চকচক করতে থাকে আজ তার সমস্তটাই অদৃশ্য। এক খণ্ড মেঘের পেছনে আড়াল হয়ে গিয়েছে। 

শহর ছাড়িয়ে ক্রমেই উঠে গেলাম উপরের দিকে। এক পর্যায়ে থিম্ফুকে পায়ের নিচে মনে হলো। মূর্তিটা আমার লজের সামনে থেকে স্পষ্ট দেখা গেলেও পৌঁছতে অনেক সময় লেগে যায়। দৃষ্টিনন্দন প্রশস্ত রাস্তা, উঠে গেছে একেবারে পাহাড় চূড়ায়। মাঝে একাধিক জায়গায় জঙ্গল মাড়িয়ে পথ খানিকটা সংক্ষিপ্ত করে নিলাম। তাতে শরীরের উপর অধিক চাপ পড়লেও ভ্রমণটা অভিযাত্রায় রূপ নিলো। 

পথের শেষ প্রান্তে সুরম্য তোরণ। তোরণের পর থেকে প্রায় তিনশো সুপ্রশস্ত সিঁড়ির উপর বুদ্ধা পয়েন্ট। সকাল সোয়া আটটা নাগাদ গিয়ে উপস্থিত হলাম সিদ্ধার্থ গৌতম বুদ্ধের সামনে। কোণায় একটা দুই-তিনতলা ভবন কিন্তু মানুষের চিহ্ন নেই। এত বড় জায়গায় একজন মানুষও কি থাকা উচিত ছিল না! গেরুয়া পোশাকের একজনকে ঘুরতে দেখলাম কিন্তু অল্পক্ষণের মধ্যেই সে যেন হাওয়ায় মিলে গেল! ফুটবল মাঠের সমান ফাঁকা চত্বর। পাথর বিছানো ধূসর চত্বরটার শেষ প্রান্তে বৃহদাকার মূর্তি। সুপ্রশস্ত মঞ্চের উপর মূল বেদি। মঞ্চের চতুর্দিকের কিনার দিয়ে একই আদলের একদল অঙ্গসৌষ্ঠব নারী মূর্তির বেষ্টনী। বেদির উচ্চতা তিন-চারতলা দালানের সমান। তার উপর পদ্ম ফুলের আসনে ঘটি হাতে গৌতম বুদ্ধ। সম্পূর্ণ স্থাপনা সোনালি পাতে মোড়ানো। বেছে বেছে এমন জায়গায় মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে যে, রাজধানী থিম্ফুর পুরোটাই বুদ্ধের দৃষ্টির আওতায়। 

বুদ্ধা পয়েন্ট থেকে ফিরে আসার পর দেড় ঘণ্টার একটা ঘুম শেষে রওনা হলাম অভিবাসন কার্যালয়ের দিকে। লাঞ্চের সময় হয়ে যাওয়ায় আবেদনপত্র গ্রহণ করে বলা হলো- অনুমতিপত্র প্রস্তুত থাকবে, আধা ঘণ্টা পর এসে নিয়ে যাবেন। এই সময়টুকুর মধ্যে সরকারি গণগ্রন্থাগারে একটা ঢুঁ মারলাম। ছোট গ্রন্থাগার। বই যা আছে তার সবই ইংরেজি ভাষায় রচিত। বিদেশি বইয়ের পাশাপাশি ভুটানের নিজস্ব বইও আছে। দুই কি তিনটা টেবিল ঘিরে সাত-আটটা চেয়ার, যার সবই ফাঁকা পড়ে আছে। মাত্র একজন নারী কর্মী গ্রন্থাগার সামলান। কথা বলতে চাইলে সাদরে আমন্ত্রণ জানালেন। মনে হলো এমন করে বহুদিন কেউ তার সঙ্গে কথা বলতে আসেনি। পাঠকসংখ্যা খুবই সীমিত। দিনে দিনে তা আরও পড়তির দিকে। এমন দিন যায় একজন পাঠকও আসে না। কথা শেষে তার ভেতর থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। 

ভুটানের ইতিহাস জানতে যদি কোনো বই সংগ্রহ করতে চাই তাহলে কোনটা কেনা উচিৎ বলে মনে করেন? প্রশ্ন শেষ হওয়ার আগেই চেয়ার থেকে উঠে একটা বই নিয়ে এলেন। হিস্টোরি অব ভুটান, লেখক কারমা ফুন্টশো। মলাটের ঠিক উপরের অংশে লেখা- অবশ্য পাঠ্য। কোথায় পাওয়া যাবে, মূল্য কত সব ভালো করে বুঝিয়ে দিলেন। অতিরিক্ত যে তথ্য দিয়ে তিনি বড় উপকার করলেন তা হলো, অনতিদূরেই জাতীয় গ্রন্থাগার ও মহাফেজখানা। সেখানে গেলে এক নজরে ভুটানের সাহিত্য সম্ভার দেখার সুযোগ মিলবে। 

ঠিক আড়াইটায় গিয়ে দেখি আমার অনুমতিপত্র প্রস্তুত হয়ে আছে। এত সহজ আর সরল প্রক্রিয়ায় কোনো দাপ্তরিক কাজ সমাধা করতে পারার অভিজ্ঞতা বিরল। ভয়াবহ রকমের আমলাতান্ত্রিক জালে আটকানো সমাজের একজন মানুষ হওয়ায় এমন সেবাপ্রাপ্তির পর থ বনে গেলাম। দিনের বাকি সময় সুনির্দিষ্ট কাজ নেই, শুধু ঘোরাঘুরি। গ্রন্থাগারকর্মীর দেওয়া তথ্য মোতাবেক জাতীয় গ্রন্থাগার ও মহাফেজখানার দিকে পা বাড়ালাম। 

ক্লক টাওয়ার রোডের সর্বোচ্চ প্রান্তের পর থেকে পথ চলে গিয়েছে এক নিরিবিলি এলাকার মধ্যে। কিছু দূর পরপর একটা বা দুইটা দপ্তর ছাড়া অন্য কিছু নেই। সামান্য ভুল হয়ে যাওয়ায় চলে গেলাম গ্রন্থাগারের প্রায় পিছনের দিকটায়। এক স্কুল ফেরত শিক্ষার্থীর সঙ্গে দেখা হলে বললো, আমিও একই পথের পথিক, আসুন আমার সঙ্গে। অনেকটা পথ না ঘুরে নিরাপত্তা বেষ্টনীর সামান্য ফাঁক গলে চোরাগুপ্তা পথে ঢুকে পড়লাম। চত্বরের এক প্রাশে সংস্কৃতি বিষয়ক বিভাগের কার্যালয় এবং অপর পাশে গ্রন্থাগার ও মহাফেজখানা। পাথরের তৈরি তিনতলা ভবন। 

প্রবেশ করতে হলো জুতা খুলে। নিচতলায় একটা চক্কর দিয়ে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলাম। কাঁচ দিয়ে আটকানো প্রতিটি শেলফে কাপড়ে পেঁচিয়ে রাখা প্রচুর বই। একেক শেলফের বই একেক রঙের  কাপড়ে পেঁচানো। একটু পর ধীর কদমে লাইব্রেরিয়ান ইয়েশি উঠে এলেন। তেরো-চৌদ্দ ইঞ্চি লম্বা এবং আড়াই কি তিন ইঞ্চি প্রশস্ত একেকটা কাগজের টুকরো মিলিয়ে বই। বাঁধাই করা নয় বরং প্রতিটি পাতা আলাদা। একটার উপর একটা, এমন করে গুছিয়ে কাপড়ে পেঁচিয়ে রাখা। ইয়েশির সাথে উঠে গেলাম তিন তলায়। সেখানকার আয়োজনও একই। দুই এবং তিনতলাজুড়ে অনেক বই দেখলাম কিন্তু তাতে কেমন করে লেখা আছে, কী লেখা আছে? তাছাড়া বইয়ের  পাতাগুলোই বা দেখতে কেমন? আমার এমন কৌতূহলের পরিপ্রেক্ষিতে ইয়েশি তার নিজ কক্ষে নিয়ে গেলেন। হলুদ কাপড়ে পেঁচানো তার একটা ব্যক্তিগত বই বের করে আমাকে দেখতে দিলেন। দেখেই অনুমান করতে পারলাম বেশ পুরনো। তিনি জানালেন, বইটির বয়স চার থেকে পাঁচশ বছর এবং তারই কোনো পূর্বপুরুষের লেখা। বেশ পুরনো বলতে এতটা হবে তা ভাবতে পারিনি। 

‘দ্রুক শ’ কাগজে লেখা বইটির বিষয়বস্তু সামাজিক এবং ধর্মীয় আচার। স্পর্শ করে দেখতে চাইলে; সে স্বাধীনতা যে আমাকে আগেই দিয়েছেন তা স্মরণ করিয়ে দিলেন। কয়েকটা পাতা উল্টেপাল্টে দেখলাম। একটা বর্ণও বুঝতে পারলাম না তবে এত পুরনো একটা বই স্পর্শ করে দেখতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে হলো। ইয়েশি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বইটি জাতীয় মহাফেজখানায় দান করবেন। তার এই মহৎ উদ্যোগকে সাধুবাদ না জানিয়ে পারলাম না। পাঠাগারে পাঠক নেই কেন? কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে তিনি যা বললেন তাতে সরকারি গণগ্রন্থাগারকর্মীর ভাষ্যই প্রতিধ্বনিত হলো। (চলবে)

পড়ুন দ্বিতীয় পর্ব: মানুষগুলোর সঙ্গে আর কোনো দিন দেখা হবে না