শিল্প ও সাহিত্য

আমার সাহিত্য-বোধের গল্প

আমার সাহিত্যবোধ নাই। এই সোজা কথাটা পণ্ডিত স্যার শুরুতেই ধরেছিলেন। মাথা নেড়ে বলেছিলেন, তোমার কিছুই হইবে নারে মনু। জেবন বেরথা। শুনে আমার ঠাকুরদা খুব চিন্তিত হয়ে পড়লেন। শহরের প্রবীণ বিজিতেন ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন। তিনি আমার জিব বের করে, চোখের পাতা টেনে দেখলেন। বুকেপিঠে স্টেটিস্কোপ বসিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিতে বললেন। জিজ্ঞেস করলেন, রাতে ঘুম হয়?

আমার বদলে ঠাকুরদাই উত্তর দিলেন, হয় মানে— একবার ঘুমোলে আর উঠতে চায় না। ডাক্তার পেট টিপে বললেন, ঘুমাইলে স্বপ্পন দেখো? ঠাকুদাই উত্তর দিলেন, স্বপ্পন একটু বেশিই দেখে। এবার ডাক্তার বাবু আমার বদলে ঠাকুরদার দিকে সন্দেহজনকভাবে তাকালেন। বললেন, আপনার স্বপ্পনের কথা না। আপনার নাতির স্বপ্পনের কথা বলছি। —ওই হলো, আমার আর আমার নাতির মধ্যে কোনো পার্থক্য নাই। নাতি আমার স্বপ্পন ঘুমাইয়া ঘুমাইয়া তো দেখেই—আবার জাইগা জাইগাও দেখে। —কি কইরা বুঝলেন? —ঘুমের মইদ্যে দাঁত কিড়মিড় করে।

এরপর বিজিতেন ডাক্তার কি মনে আমার দাঁত দেখলেন। আর কোনো কথা বললেন না। তার অন্য রোগী আছে। এরপর তিনি নদীর ঘাটে যাবেন। সেখানে টাবুরে নৌকায় গাঁও-গেরামের রোগী দেখবেন। ঠাকুরদা নাছোড়বান্দা। ডাক্তারের কাছ থেকে ওষুদ যোগাড় করবেন। ডাক্তার মাথা নেড়ে বললেন, এই রোগের চিকিৎসা নাই।

ঠাকুরদা বললেন, তাইলে আপনে আছেন ক্যান? চিকিৎসায় না থাকতে পারে, আপনের না থাইকা যায় কুনহানে। এরপরে কথা নাই। বিজিতেন ডাক্তার আমাকে দুটো কৃমির বড়ি দিলেন।

এতেও আমার সাহিত্যবোধের কোনো উন্নতি হলো না। বিজিতেন ডাক্তার খুব হতাশ গলায় বললেন, বাবারে, এই অসুখ সারানোর বিদ্যা এ জগতে কারো জানা নাই। জানা থাকলে আমার নিজেরও কাজে লাগত। আমার সংসারটা ভাঙ্গত না।

তিনি সেদিন আর রোগী দেখলেন না। সবাইকে বিদায় করে দিলেন। ঘরের মধ্যে তার তরুণ কালের স্ত্রীর ছবির নিচে মাথা নিচু করে বসে রইলেন। তার স্ত্রী কবিতা লিখতেন। সেকালে কলকাতার পত্রিকার পাতায় ছাপাও হতো। তার কবিতা বুঝতে পারেননি বলে ডাক্তার স্বামীকে প্রথম জীবনেই ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। আজ সেই কথা মনে পড়ে তার চোখ থেকে জল পড়তে লাগল।

ঠাকুরদা এরপর এলাকার বিশিষ্ট গুণীন সায়েম কবিরাজের কাছে আমাকে নিয়ে গেলেন। তিনি দেখেশুনে নট করে দিলেন। বললেন, এইটা ভূতের কেস না। আমি ভূতের চিকিৎসা করি। সাহিত্যের না।

শেষ চিকিৎসা হিসেবে ঠাকুরদাকে পণ্ডিত স্যার পরামর্শ দিলেন কাশেম রেজার কাছে যেতে। তিনি থাকেন কালীবাড়ির পাশে। বড় পুকুরের উপর তার ঘর। দক্ষিণ পাশটিতে বারান্দা। সেখান থেকে বড়শি পেতে মাছ ধরা যায়।

কাশেম রেজা এ এলাকার বিশিষ্ট কবি। এবং লেখক। তার উজ্জ্বল দুটি চোখ। মুখে কাঁচাপাকা দাড়ি। আর বাহারী চুল। গলায় রিঠার মালা। খাদির পাঞ্জাবী পরা। তার পায়ের কাছে ঘুমিয়ে আছে একটা বিড়াল। কাশেম রেজা টেবিলে ঝুঁকে একটা জবেদা খাতায় কিছু লিখছিলেন।

আমাদেরকে দেখে লেখা থামালেন। ঠাকুরদাকে শুধালেন, কী মনে করে বিধুবাবু? ঠাকুরদা বললেন, আমার নাতিরে সাহিত্যবোধ দেন। কবি কাশেম রেজা হাসলেন হা হা করে। সে হাসি শুনে ঘরের ভেতর থেকে কবির চার মেয়ে ছুটে এল। এই চার মেয়ে—আমাদের কচি আপা, কোকো আপা, সেকো আপা আর রেখা আপা। তারা বলল, বাবা, কী হইছে? কবি বললেন, কিছু হয় নাই মা। আমাকে দেখিয়ে বললেন, এই ছেলেটার সাহিত্যবোধ লাগবে। কচি আপা ছুটে গিয়ে ভেতর থেকে একটি গামলা নিয়ে এল। গামলার খোলা মুখটি একটা থালা দিয়ে ঢাকা। ভিতরে কি আছে দেখা যায় না। রেখা আপা আমাকে বলল, কওতো খোকন, গামলার মধ্যে কী? ঢাকনা না খুললে বলা যাবে না। সেকো আপা বলল, গামলার মধ্যে সাহিত্য আছে। গামলার মধ্যে কইরা তোমার জন্য সাহিত্যবোধ আনছি। কাইটা দিচ্ছি। খাও।

চার চারটি পরীর মতো আপা হি হি করে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ল। বিড়ালটি একবার ঘাড় তুলে মিউ মিউ করে উঠল। কাশেম রেজা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। আদর পেয়ে বিড়ালটি আবার চোখ বুজল। তার আরেকটু ঘুমাতে ইচ্ছে হচ্ছে। গামলা এসেছে। গামলার মধ্যে সাহিত্যবোধও এসেছে। তার চেহারা আমরা কেউ দেখিনি। সাহিত্যেবোধের চেহারা দেখার জন্য আমার চেয়ে ঠাকুরদাই বেশী উদ্গ্রীব হয়েছিলেন। উত্তেজনায় তার শ্বাস ঘন হয়ে উঠেছে। এ জিনিস তিনি কখনো দেখেন নাই। তার বাবাও দেখেন নাই। তার ঠাকুরদারও দেখার কথা নয়। কবি মুচকি মুচকি হাসছেন। ঠাকুরদা বললেন, দেরী করেন ক্যান! ঢাকনা তোলেন।

কাশেম রেজা গামলার মুখ থেকে থালাটি তুলে নিলেন। ভেতরে একটা হলুদ রঙের ফল দেখা গেল। ঠাকুরদার উত্তেজনা কমে গেল। অনেকটা হতাশ হয়ে বললেন, এইটা দেখছি ফাইয়া। কাঁচা ফাইয়া। ফাইয়া কী কইরা সাহিত্য হয়? কবি সাহেব বললেন, হয় হয়। ফাইয়া যখন পেঁপে হয়ে যায়—তখন সেটা সাহিত্যও হয়। জানতে পারলে সবই হয়। জানাটাই আসল। কাশেম রেজা একটা ছুরি দিয়ে কাঁচা পেঁপেই কাটলেন। ঠাকুরদাকে এক ফালি দিলেন। ঠাকুরদা অনিচ্ছা সত্বেও মুখে দিলেন। তার মুখটা একটু কুঁচকে গেছে। কাশেম রেজা আমাকেও দিলেন। মুখে দিয়ে দেখি—স্বাদহীন। খানিকটা কষা। ফেলে দেব কিনা ভাবছি—এ সময় কোকো আপা ঘর থেকে একটি প্লেটে মধু নিয়ে এল। আমাকে বলল, পেঁপেতে স্বাদ না পাইলে মধু দিয়া খাও। মজা পাইবা। এই মধু কবি কাশেম রেজার নিজের ঘরের মধু। বসন্তে বারান্দায় চাক পড়ে। মৌমাছিরা ফুল থেকে মধু এনে চাকে রাখে। এই মধুতে কোনো ভেজাল নাই।

এই খাওয়া দাওয়ার মধ্যেই চার আপা আমাকে বেশ সাজিয়ে গুজিয়ে দিলো। চুলে দিলো কলম্বো নারিকেল তেল। চিরুনী দিয়ে চুলটা আচঁড়ে দিলো। বাম পাশে সিঁথি। মুখে একটু স্নো দিলো কোকো আপা। রেখা আপার ইচ্ছে মাথায় একটা ময়ূরের পালক দেবে। চুল নষ্ট হবে বলে কচি আপা দিতে দিলো না¬; পালকটা হাতে দিলো। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে বলল—বাবা, দেখতো, খোকনকে ঠিক কেষ্ট ঠাকুরের মতো লাগছে না? কাশেম রেজা হেসে বললেন, কেষ্ট ঠাকুর নয়, শিশু কৃষ্ণ। তিনি একটি কাগজে লিখলেন, পেঁপে। বাঁকা অক্ষরে পেঁপে লেখা কাগজটি তিনি এই শিশু কৃষ্ণের পকেটে পুরে দিলেন। বললেন, যত্ন কইরা রাইখো। ফেলে দিও না। সেদিন আসার সময় কচি আপা আমার হাতে দিলো আরেকটি পেঁপে। কাঁচা নয়—গাছ পাকা। বর্ণ হলুদ। মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ভাই, চিন্তা কইরো না। তোমার সাহিত্যবোধ হবে। আমার আব্বাজান কখনো মিথ্যে কথা কয় না। মিথ্যে কথা দিয়ে সাহিত্য হয় না। বিড়ালটি কবির পায়ের কাছ থেকে উঠে তার টেবিলে উঠল। আড়মোড়া ভেঙ্গে লেজটা তুলে ডেকে উঠল, মিয়াও।

ঠাকুরদা সাহিত্যবোধের বদলে পেঁপে পেয়ে খুব হতাশ হয়েছেন। জীবনে প্রথম বারের মতো তিনি আমাকে বাড়ির দোরগোড়ায় ছেড়ে দিলেন। বাড়িতে ঢুকলেন না। বললেন, একা যাও। একা যাওয়া শেখো। বলে ঠাকুরদা তেঁতুলিয়ার হাঁটে চলে গেলেন। নতুন কোনো মুশকিল আসানের সন্ধান করবেন। কিন্তু আমার মা জননী বড় ভক্তিমতি। অপেক্ষা করছিল আমার জন্য। আমার সাজানো গোছানো চেহারা দেখে খুব খুশী। কোলের কাছে টেনে নিয়ে বলল, কি রে বাবা, তোরে দেখি চেনাই যায় না! কি, সাহিত্যবোধ পাইছিস নাকি? কই, দেখি?

মায়ের দিকে পাকা পেঁপেটি তুলে দিলাম। মা কপালে ঠকিয়ে বলল, দুগগা দুগগা। আর চিন্তা নাই। ঠাকুর দিছে। মা পেঁপেটি ধুয়ে কাটল। একটা পূজার থালায় সাজিয়ে তুলসি তলায় রেখে ধুপ ধুনো জ্বালল। প্রণাম করে বলল, আশা পূর্ণ করো হে ঠাকুর। পেঁপে তখন ঠাকুরের প্রসাদ। সবার হাতে হাতে মা প্রসাদ তুলে দিলো। প্রতিবেশীরাও বাদ গেলো না। সবাই খেয়ে বলল, অমৃত। এই পেঁপের খোসা বীজ আর শাঁস মা আমাকে দিয়ে বলল, পুকুর পাড়ে গর্ত করে ফেলে দিয়া আয়। ঠাকুরের পেসাদ এখানে সেখানে ফেলা ঠিক নয়। পুকুর পাড়ে নিয়ে যাব, তখন আমাদের ধ্বলি গাইটা গোপাট থেকে ফিরছিল। বিকেল ফুরিয়ে আসছে। পেয়ারা গাছের মাথায় বাঁদুড় উড়ছে। গাইটা হাম্বা রবে ডাক দিয়ে আমার কাছে এলো। হাত থেকে বীজ সমেত পাকা পেঁপের খোসা খুব পরিতৃপ্তির সঙ্গে খেয়ে ফেলল। মাটিতে পুঁতে রাখার মতো কিছুই রাখল না।

আমি মা অন্তঃ ছেলে। মায়ের বাক্যির বাইরে যেতে পারি না। কিন্তু মাটিতে পুতে ফেলার মতো আর কিছু নেই দেখে আমার কান্না পেল। মা ছুটে এসে বলল, দুঃখ পাস নে খোকা। তোর কোনো দোষ নাই। ঠাকুর সব দেখছেন। তিনি রাগ করবেন না। এ সময় আমার পকেট থেকে কবির লেখা কাগজটি সামান্য বের হয়ে ছিল। সেটা বের করে মা বলল, এটা কিরে বাবা? —কবি লিখে দিয়েছেন। —কী লিখছেন? — পেঁপে। মার মুখ এবার উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, এইতো পাইছি। এটারে তুই মাটিতে রাইখা দে।

পুকুর পাড়ে ঝুরঝুরে মাটি। সহজেই মাঠি সরিয়ে একটা গর্ত করলাম। কাগজটি পুতে গর্তে রেখে দিলাম। মাটি দিয়ে ভরাট করা হলো। আজলা করে জল এনে মা সেই মাটি ভিজিয়ে দিলো। তখন সন্ধ্যে নামল।

কিছুদিনের মধ্যেই পুকুরপাড়ের মাটি ফুঁড়ে একটি শিশু গাছ বের হলো। তার সবুজ পাতা। খাড়া খাড়া ডগা। দেখে ঠাকুরদা খুব খুশি হয়েছেন। নিয়মিত মাটি খুঁড়ে দিতে লাগলেন। আগাছা তুলে গোড়া সাফ করলেন। মা সকাল-সন্ধ্যায় জলদান করল। ডগডগিয়ে গাছটি বেড়ে উঠল। হাওয়ায় হাওয়ায় তার পাতা কাপে। ফুল আসে।  

কবি কাশেম রেজা আমাদের বাড়িতে এলেন। সঙ্গে তাঁর চার মেয়ে আমাদের কচি আপা, কোকো আপা, সেকো আপা আর রেখা আপা। তারা সেদিন সারা বাড়ি ঘুরে বেড়াতে লাগল। টগর ফুল তুলে চুলে পরল। মা তাদের জন্য লক্ষ্মীদীঘা চালের পায়েস রাঁধল। রূপেশ্বর ধানের মুড়ি ভেজে দিল; সঙ্গে নারকেলের নাড়ু।  খেয়ে দেয়ে পুকুর পাড়ে গাছটির নিচে পাটি পেতে বসল চার বোন। গান গাইল— আয় তবে সহচরি হাতে হাতেধরি ধরি নাচিবি ঘিরি ঘিরি, গাহিবি গান।।

ঠাকুরদা একটু বিষণ্ন হয়ে ছিলেন। তার শরীরটা ভালো যাচ্ছিল না। মাথার চুল দ্রুত পড়ে যাচ্ছে। ওজন কমে যাচ্ছে। চোখে কম দেখতে শুরু করছেন। এক ফাঁকে কবি কাশেম রেজাকে একটু তফাতে ডেকে নিয়ে বললেন, আমার নাতিডা যে মূর্খ রইয়া গেল। তার কী এ জীবনে সাহিত্যবোধ হবে না? কবি তার হাত ধরে বললেন, হবে হবে। এই গাছে সাহিত্য ধরবে। চিন্তা কইরেন না।

কিন্তু ঠাকুরদার চিন্তা শেষ হয় না। চিন্তা বেড়ে চলে। ফুল থেকে ফল হতে অনেকটা সময় লেগে যায়। গুটি থেকে বড় হতে আরো সময়। ঠাকুরদা শেষদিকে লাঠিতে ভর দিয়ে পুকুর পাড়ে যেতেন। হাঁ করে তাকিয়ে থাকতেন। তার সময় দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে। গাছটি তখন সামান্য দুলত। বাতাসে ফরফর শব্দ হতো।

ঠাকুরদা লাঠি ভর দিয়ে যাওয়ার শক্তিও হারালেন। তাকে কিছুদিন ধরে ধরে আমরা পুকুর পাড়ে নিয়ে যেতাম। ফলে বর্ণ ধরা শুরু করল—গাঢ় সবুজ থেকে হালকা সবুজ। তারপর হালকা হলুদ। ঠাকুরদা তখন বিছানা ছেড়ে উঠতে পারেন না। বারান্দায় শুয়ে শুয়ে গাছটির দিকে তাকিয়ে থাকেন। থেকে থেকে হট হট করে শব্দ করেন। পাখি তাড়ান। বলেন, ও পাখি, ফলটা খাইস না। মাফ দে। আমার বাসনা পূর্ণ করতে দে।

গাছটাকে ভালো করে দেখার জন্য ঠাকুরদার জীবনে প্রথম বারের মতো চশমা এলো। গাছটি পুরোটা দেখতে অসুবিধা হচ্ছে দেখে সামনে থাকা দুটো কুল বরই গাছের ডাল কেটে দেওয়া হলো। বিজিতেন ডাক্তারও একদিন এসে ঠাকুরদাকে জবাব দিয়ে গেলেন। সায়েম কবিরাজ কোনো তাবিজ দিতে পারলেন না। শুধু বলে গেলেন, আল্লা সাফি। আল্লা মাফি। তার স্মরণ নেন। ঠাকুর ঠাকুর করেন।  

সেদিন ভোর বেলায় উঠোনে রোদ পড়েছে সবে। ছোটো পিসি ঘনঘন চোখ মুছছে। বড় পিসি ঠাকুরদার শিয়রে বসে লক্ষ্মীর পাঁচালী পড়ছে। এর বাইরে আর কিছু পড়তে জানে না। ঠাকুরদা ঘোলা চোখে পুকুর পাড়ের গাছটির দিকে তাকিয়ে আছেন। খবর পেয়ে কাশেম রেজা এলেন। গাছটি থেকে ফল পাড়লেন নিজের হাতে। ফল পুরো হলুদ বর্ণ হয়ে গেছে। সেটা নিয়ে ঠাকুরদার কাছে এলেন। বললেন, এখন আর বাসনা রাইখেন না। ঠাকুরদা অনেক কষ্টে তাকে বললেন, কবিসাব, আমার নাতিডারে সাহিত্যবোধ দ্যান। এইটাই আমার শেষ বাসনা। কবি ছুরি দিয়ে ফলটি কাটলেন। থেতলে ফলের রস বের করলেন। চামচে করে ঠাকুরদার মুখের দিকে এগিয়ে দিলেন। বললেন, বিধুবাবু, সাহিত্য বোধ দিচ্ছি। হাঁ করেন—খান। ঠাকুরদা হাঁ করলেন। তার মুখের ভিতরে কবি ফলের রস দিলেন। তিনি গভীর তৃপ্তিতে বলে উঠলেন, আহ। তার বাসনা পূর্ণ হয়েছে। তার চোখ থেকে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। কারা কারা উঠোনে জয়ধ্বনি করতে লাগল। মা জুকাড় দিচ্ছে। এবার ঠাকুরদা মহালোকে যাত্রা করবেন।

আমাদের সবার মুখে তখন সেই ফল। আমি খাচ্ছি। আমার বোনেরা খাচ্ছে। বাবা খাচ্ছে। কাকা খাচ্ছে। জেঠা খাচ্ছে। মা খাচ্ছে। খেতে খেতে কবি কাসেম রেজা একটি সাদা কাগজ আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, লেখো তো বৎস। —কী লিখব? —সাহিত্য লেখো।

আমি তখন তদগত। লিখলাম, পেঁপে ফল পাকিলে মিঠা লাগে। কাঁচা হইলে আনাজ। কবি আমার মাথায় হাত রেখে বললেন, তথাস্তু। বাঁইচা থাকো।