মতামত

রাইজিংবিডি’র রাতদিন

এক.

ছবিটা দেখেই চমকে ওঠা!

জোয়াল কাঁধে বাবা ও ছেলে। পেছন থেকে হাল ঠেলছেন আরেক ছেলে। গরুর অভাবে ফসলি জমিতে এভাবেই হালচাষ করছেন হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলার শিবপাশা গ্রামের আজগর আলী।

হবিগঞ্জ প্রতিনিধি মামুন চৌধুরীর পাঠানো সেই রিপোর্ট ও ছবি দেখে নিউজরুমে ঝটপট মিটিং।  চটজলদি সিদ্ধান্ত হয়, আমরা এই নিউজটা ভালোভাবে উপস্থাপন করবো। প্রতিনিধিকে বলা হয়, আজগর আলীর বাড়ি গিয়ে পুরো রিপোর্ট নিয়ে ভিডিও স্টোরি করতে। স্টোরিটা আমরা লিড করি। শিরোনাম-‘গরু নেই, দুই ছেলেকে নিয়েই হালচাষ!’

বর্গা নিয়ে পরের জমিতে চাষাবাদ করেন আজগর আলী। তাও আবার ছেলের কাঁধে জোয়াল চাপিয়ে। আজগর আলীর সেই কঠিন জীবন সংগ্রামের তথ্যচিত্র তুলে ধরে রাইজিংবিডি।

হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসকের নজরে আসে নিউজটি। তিনি তাৎক্ষণিকভাবে ইউএনওকে নির্দেশ দেন, আজগর আলীকে সহায়তা করার জন্য। গরু কেনার জন্য আর্থিক সহায়তা পান কৃষক আজগর আলী।

আজগর আলীর মুখে সেদিনের আনন্দের হাসিটাই রাইজিংবিডির বড় সাফল্য।

দুই.

গাইবান্ধার উত্তর আনালেরতাড়ি গ্রাম। উন্মুক্ত খোলা প্রান্তরে ভেঙে পড়া একটি টিনের চালার দুপাশে দুটি গাছের সঙ্গে শিকল-তালায় বেঁধে রাখা হয়েছে দুজনকে। পায়ে শিকল দিয়ে বাঁধা ব্যক্তির নাম মোহাম্মদ আলী। পাশেই আরেকটি গাছের সঙ্গে একইভাবে শিকলে বাঁধা তার মেয়ে রেহানা আখতার টুলি।

এক-দু’দিন নয়।  সাত বছর ধরে এভাবে শিকলবন্দি জীবন বাবা-মেয়ের! বাবা মানসিক প্রতিবন্ধী। মেয়েও তাই। পায়ে লম্বা শিকলের বেড়ি। কোথাও যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু কী আশ্চর্য, টুলি হাসছে! নির্মল, স্বর্গীয় হাসি। সেই হাসিতে কোনো অভিযোগ নেই।  নেই কোনো অনুযোগ।

এ নিয়ে রাইজিংবিডির গাইবান্ধা সংবাদদাতা সিদ্দিক আলম দয়ালের বিস্তারিত রিপোর্ট প্রকাশের পর সমাজসেবা বিভাগ থেকে তাদের দুজনকে প্রতিবন্ধী ভাতার কার্ড দেওয়া হয়। পরিবারের জন্য আর্থিক সহায়তা ও খাদ্যদ্রব্য পৌঁছানো হলো। জেলা প্রশাসকের উদ্যোগে বাবা-মেয়ের চিকিৎসাও হচ্ছে পাবনার মানসিক হাসপাতালে।

বাবা-মেয়ের শিকলবন্দি জীবনের মুক্তি আনন্দের সঙ্গী রাইজিংবিডি ডটকম।

তিন .

তার বয়স ছয়।  কালো রঙের একটি বালতির ভেতরে বসা। মুখ বের করা। অপার আনন্দ নিয়ে আশপাশের সবকিছু দেখছে ছয় বছরের রমজান। তবে বালতি থেকে বের হওয়ার উপায় নেই তার। হাত-পা থেকেও যে নেই রমজানের। প্রতিবন্ধী, কথাও বলতে পারে না। রমজানের বাবা-মায়ের সাধ্য নেই প্রতিবন্ধী ছেলের জন্য হুইল চেয়ার কেনার। তাই বাধ্য হয়ে তাকে বালতির মধ্যে রেখেছেন। বালতির হ্যান্ডেল ধরে তাকে বয়ে নিয়ে চলেন।

রমজানের মা জেসমিন আক্তার বলছিলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ, হুইল চেয়ার কিনবো কেমন করে? কেউ যদি ছেলেটারে হুইল চেয়ার কিন্না দিত।’

রমজানের এই বালতি জীবনের দুঃখগাঁথা তুলে ধরে রাইজিংবিডি- ‘৬ বছর ধরে রমজানের হাসি-কান্নার সঙ্গী বালতি।’ কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর উপজেলার প্রশাসনের নজরে আসে রমজানের এই বালতি জীবনের কষ্ট কাহিনি। প্রশাসন রমজানের পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। রমজানকে একটি হুইল চেয়ার উপহার দেওয়া হয়।

শেষ হয় রমজানের ‘বালতি জীবন।’

কালো গোল বালতিতে আটকে থাকা রমজান এখন হুইল চেয়ারে বসে জীবন আনন্দ উপভোগ করছে।

শিশু রমজানের এমন সব সহজ ও স্বাভাবিক আনন্দভুবনই দেখতে চায় রাইজিংবিডি।

সংবাদ, সাংবাদিকতার সঙ্গে দায়বদ্ধতার সম্পর্ক নিবিড়। সেই দায়বদ্ধতার সামান্য প্রচেষ্টায় যদি কারো মুখে এক চিলতে হাসি ফোটানো যায়—তবে সেটাই সংবাদের সবচেয়ে সুখকর অংশ। রাইজিংবিডি রাতদিন সেই ‘সুখী সাংবাদিকতার’ অংশ হয়েই থাকতে চায়। সেই দায় মেটাতেই সাংবাদিক এবং সাংবাদিকতার কাজ কখনই সকাল ৯টায় শুরু এবং বিকেল ৫টায় ছুটি— এই ব্র্যাকেটে চলে না।

বাসায় ফিরেও তাই অনলাইন সাংবাদিককে বিশ্রাম নেওয়ার আগে ল্যাপটপ খুলে বসতে হয়। অথবা আড্ডা-আনন্দের ফাঁকেও মোবাইলে নিউজ লেখার অভ্যাসের সঙ্গে রপ্ত হতে হয়। রাত দুটোয় ঘটা বড় কোনো ঘটনার নিউজ আপনি নিশ্চয়ই পরদিন সকালে পোস্ট করার জন্য অপেক্ষায় থাকতে পারেন না। বলতে পারবেন না, এখন আমার ঘুমের সময়।  কাজের সময় না।

সাংবাদিকতা তাই চব্বিশ ঘণ্টার, সপ্তাহের সাত দিনের এবং বছরের ৩৬৫ দিনেরই কাজ। তবে সেই সঙ্গে এমন ব্যস্ততার ফাঁকেই পরিবার, বিশ্রাম, ঘুমকেও বাস্তবতা মানতে হয়।

রাইজিংবিডির নবম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে সবাইকে ফুলেল শুভেচ্ছা এবং চব্বিশ ঘণ্টা সংবাদের ব্যস্ত জগতে স্বাগত।

লেখক: ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, রাইজিংবিডি ডটকম