রাইজিংবিডি স্পেশাল

বৃদ্ধাশ্রমে মায়েদের গল্প

মা আমাদের শ্রেষ্ঠ ভালোবাসা আর নির্ভরতার ঠিকানা। পৃথিবীর কোনো বাটখারায় কি পরিমাপ করা যায় মায়ের ভালোবাসা! মায়ের পরম স্নেহের ওজন দেওয়া কোনো মেশিন ধরাধামে সৃষ্টি হয়নি। তবুও জীবন সায়াহৃে এসে মায়ের ঠিকানা কেন বৃদ্ধাশ্রম? 

মা-বাবা না থাকলে আমরা পৃথিবীর আলোই দেখতে পেতাম না। যে মা পরম স্নেহে শত কষ্ট, যন্ত্রণা সহ্য করে দশ মাস দশ দিন গর্ভে ধারণ করলেন। আবার জন্মের পর থেকে লালনপালন করলেন এবং পড়ালেখা শেখানো থেকে শুরু করে জীবনের প্রতিটি ধাপে ত্যাগ স্বীকার করলেন। আজ নিজেদের একটু ভালো থাকার জন্য সেই বাবা-মায়ের ঠাঁই করে দিয়েছেন বৃদ্ধাশ্রমে।  

তিলে তিলে গড়ে তোলা সংসারে বঞ্চনার নিদারুণ দুঃখবোধে বৃদ্ধ বয়সে মায়েরা কেমন আছেন, কোথায় আছেন। মা দিবসে সেই অপ্রিয় সত্যর মুখোমুখি হতে কিছুসময় গাজীপুর সদর উপজেলার বিশিয়া কুড়িবাড়ি এলাকার বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রে। এখানে স্নেহের ছায়া বঞ্চিত হয়ে সন্তানের স্মৃতিচারণ, অভিমান আর বেদনায় বিধুর হয়ে আছেন ৮৫ জন মা। এখানে বসবাসরত প্রতিটি মা বেদনার অশ্রুজলে সিক্ত। 

যন্ত্রণা আর অবহেলার তিক্ত হয়ে অনেকেই নিজ ইচ্ছায় ঠাঁই নিয়েছেন এই বৃদ্ধাশ্রমে। আবার কাউকে স্নেহের সন্তানেরা বোঝা মনে করে সযত্নে রেখে গেছেন। অনেক সন্তানের অর্থসম্পদের অভাব নেই, কিন্তু পিতা-মাতাকে নিজের কাছে রাখার প্রয়োজন বোধ না করে নিজেই পাঠিয়ে দিয়েছেন বৃদ্ধাশ্রমে।

চার সন্তানের জননী গোপালগঞ্জ জেলার মমতাজ বেগম। মেয়ে দুটির বিয়ে হয়েছে অনেক আগেই। স্নেহের ছেলে সন্তানেরা কথা দিয়েছিল প্রয়োজনে রক্ত বিক্রি করে কিংবা রিকশা চালিয়ে খাওয়াবে মাকে। কেউ কথা রাখেনি। ৮ বছর আগে ছোট সন্তান এসে রেখে গেছেন বৃদ্ধাশ্রমে। রক্ত বিক্রি করে খাওয়ানোর কথা বলা ছেলেটি ব্যবসা করে খাচ্ছেন। প্রয়োজনে রিকশা চালিয়ে খাওয়াবে বলে কথা দেওয়া ছেলেটি এখন বাবার রেখে যাওয়া ব্যাংকে জমানো টাকা খাচ্ছেন। ৮ বছরে একবারও মাকে দেখতে আসেননি। বৃদ্ধাশ্রমের বারান্দায় বসে কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানি ফুরিয়ে যাচ্ছে মায়ের। অথচ কেউ কথা রাখেনি। 

কথা রেখেছে মুন্সিগঞ্জের রাবেয়া খাতুনের (৭০) দুই মেয়ে। বয়সের ভারে ভাঁজ হয়ে গেছেন।  ২০ বছর ধরে পড়ে আছেন এই বৃদ্ধাশ্রমে। লাঠির সাহায্য ছাড়া চলতে পারেন না তিনি, কথাও বলেন খুব আস্তে আস্তে। বারান্দায় বসে ফ্যালফেলিয়ে তাকিয়ে থাকেন। তার করুণ চাহনি যেন বলছে এই বয়সে এসে একটু প্রিয়জনের সংস্পর্শ দরকার। মাঝেমধ্যে ছোট মেয়ে খোঁজখবর নেন। তবে ২০ বছরে দেখা হয়েছে মাত্র কয়েকবার। জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে এসে মেয়েদের ভালোবাসাটা যেন অতিব জরুরি। কিন্তু ভালোবাসাটা এখানে বড্ড সেকেলে, প্রিয়জন থাকলেও খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজন নেই কারোই। 

স্কুল শিক্ষিকা গুলনাহার। ১২ বছর আগে মারা গেছেন স্বামী। স্বামীর মৃত্যুর পর দুই সন্তানের কাছেই থাকেন ৬ বছর। এরপর আর জায়গা হয়নি সন্তানদের ঘরে। ৬ বছর আগে এমনি মেঘাচ্ছন্ন বিকেলে দুই সন্তান তাকে রেখে যান বৃদ্ধাশ্রমে। তিনি বলেন, ঢাকার একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলাম। যতদিন চাকরি করেছি সমাদরেই ছিলাম ছেলেদের সংসারে। চাকরি ছেড়ে দেওয়ার পরেই আমার গুরুত্ব কমে যায় সংসারে। দুটি কিডনি নষ্ট হয়ে গেছে, মৃত্যুর আশায় দিন গুণছি। অন্যের সন্তানদের শিক্ষা দিলাম অথচ আমার সন্তানগুলো মানুষ করতে পারলাম না। ওদের মানুষ করার ক্ষেত্রে আমার হয়তো কোনো ভুল ছিল।

অশ্রুসিক্ত নয়নে অনিমা চৌধুরী বলেন, জীবন আমার সাথে বড্ড লুকোচুরি খেলেছে। জীবনভর হারিয়েছি আর এখন নিঃসঙ্গতায় কাটছে। ৪০ বছর আগে স্বামী মারা গেছেন। এরপর চট্রগ্রামের বহদ্দারহাটে সন্তানের সাথে থাকতাম। এরপর ছেলেটি মারা যায়। দিশেহারা হয়ে একমাত্র মেয়ের বাড়িতে থাকতে শুরু করি। কিন্তু মেয়ের শ্বশুর বাড়ি থাকছি মেয়েকে যদি কেউ কটু কথা বলে, ভেবে ৭ বছর আগে এখানে চলে এসেছি। এরপর আর মেয়ের সাথে দেখা হয়নি। মাঝেমধ্যে স্বপ্নে দেখি মেয়ে আমাকে মা বলে ডাকছে। কিন্তু সেই স্বপ্ন ৭ বছরেও পূর্ণ হলো না। 

এই বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রে ৮৫ জন মায়ের সাথে ৯০ জন বাবারও ঠাঁই হয়েছে। তাদের সবার জন্য আমৃত্যু খাদ্য বস্ত্র বাসস্থান ও বিনোদনের সংস্থান করেছেন গিভেন্সি গ্রুপ। 

৮৯ বছর বয়সী চাঁদপুরের কফিল উদ্দিনের ৬ সন্তান। প্রত্যেকেই প্রতিষ্ঠিত। দুইজন প্রবাসী, একজন ঢাকায় ব্যবসা করেন। বাকিদের চাঁদপুরে ব্যবসা আছে কিন্তু তাদের একজনের পক্ষেও বাবার ভার বহন করার সাহস হয়নি। তাইতো সব থেকেও সব হারিয়ে বৃদ্ধাশ্রমের নিচতলায় ৩ নম্বর কক্ষের একটি ছোট্ট বিছানা বরাদ্দ হয়েছে কফিল উদ্দিনের জন্য । 

বৃদ্ধাশ্রমের ব্যবস্থাপক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, গিভেন্সি গ্রুপের মালিক খতিব আব্দুল জাহিদ মুকুলের তত্ত্বাবধানে ১৯৯৫ সালের ২১ এপ্রিল এই পুনর্বাসন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়। এখানে আশ্রিত প্রত্যকেই যেন তাদের দুঃখগুলোকে ভুলে থাকতে পারে এজন্য সব ধরনের ব্যবস্থা করা হয়। এখানে আশ্রয় নেওয়া প্রত্যেকেই যেন আমার মা। আমি তাদের সবাইকে মায়ের মতোই আদর-যত্ন করি। 

এখানে বসবাসরত মায়েরা জীবনের দুঃখ ভুলে সুখ হাতড়ে বেড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন। সন্তানের এত অবহেলা বঞ্চনার পরেও ব্যথাতুর মায়ের মন তবু সন্তানের মঙ্গল কামনাতেই প্রার্থনায় বিভোর। তাইতো মা দিবসের স্লোগান হোক, জীবন সায়াহ্নে পরিবারে মায়ের বাস, সমাজ থেকে মুক্ত হোক বৃদ্ধাশ্রমের অভিশাপ। 

আরও পড়ুন

আজ বিশ্ব মা দিবস 

মায়ের শাড়ির আঁচলে লুকানো সুখ