ভ্রমণ

পাহাড়ঘেরা অপরূপ পারো  

এমাদাসি কেওয়াদাসি: চতুর্থ পর্ব 

খটখটে শুকনো পনির, মুখে দিলে প্রথম দশ মিনিট স্বাদ অনুভূত হয় না। যেন গালের মধ্যে পাথর টুকরো ধরে রাখা। তাড়াহুড়ো বা জোরাজুরি করলে পরিণাম আরও খারাপ! ধৌর্য ধরে একটু অপেক্ষা করলে মুখের মধ্যে দুধের স্বাদ ছড়িয়ে পড়ে। 

পরিকল্পনামাফিক পারো যাওয়ার জন্য রওনা হলাম সকাল নয়টায়। বাসে আরোহণের আগে আবারও দেখা হলো সেই পনির বিক্রেতার সঙ্গে। সে আমাকে ঠিকই মনে রেখেছে। আগের দিন সকালে দুটো কিনেছিলাম বিশ গুলট্রাম দিয়ে। এ দিন ছয়টা দিলো পঞ্চাশে। দূরের পথ তাই একরূপ অধিকার খাটিয়েই এতগুলো দেওয়া। তার অধিকার খাটানোর বিষয়টা আমার কেন জানি ভালো লাগল। পনিরগুলো আকারে একটু লম্বাটে, দাঁত দিয়ে ভাঙা বড়ই কঠিন, তাই স্বউদ্যোগে ভেঙে প্রতিটি দুই টুকরো করে দিলো। পনির ভাঙার মতো সামান্য কাজের মধ্যেও যে চমৎকার একটা শিল্প লুকিয়ে থাকতে পারে তা না দেখলে আন্দাজ করা সম্ভব নয়। 

তিন আঙুলের ফাঁকে বসিয়ে ট্রলির পাইপে খুট করে ছোট্ট এক আঘাতেই ভেঙে দুই টুকরো। কাজ শেষে পা থেকে মাথা পর্যন্ত পুরো শরীর তাতে যুক্ত হয়ে যায়। অর্থাৎ চোখ, মুখ, ঘার এবং কোমরসহ প্রতিটি অঙ্গে এক বিশেষ ভঙ্গিমার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। বিক্রেতা যুবকটি শারীরিক প্রতিবন্ধী। এক পা পলিও আক্রান্ত। ট্রলির মত ছোট্ট একটা চার চাকার যন্ত্রে সুতায় গাঁথা পনির মালা ঝুলিয়ে বাস টার্মিনালে ও তার আশপাশে বিক্রি করে। মূলত বিভিন্ন গন্তব্যের যাত্রীরাই তার খদ্দের। সদা হাস্যজ্জ্বল যুবক ইংরেজি বলতে পারে খুব সুন্দর করে। বিদায়ের সময় জানালার কাছে এসে বললো- হ্যাভ এ সেফ জার্নি! 

পাহাড় পর্বতের দেশ ভুটান। সমতল আশা করা অমুলক কিন্তু পথ বানানো হয়েছে চমৎকার করে। পাহাড়ের ফাঁক দিয়ে প্রবাহমান নদী। নদীর সাথে সাথেই পথ। জড়াজড়ি করে সখার মত এগিয়েছে মাইলের পর মাইল। জনবসতি নিতান্তই কম। বহু দূর পর পাহাড়ের গায়ে হঠাৎ দুই একটা ঘর-বাড়ি দেখা যায়। গাছে গাছে টসটসে পাকা আপেল। চলতি পথে এমন মনজুড়ানো দৃশ্য আর হতেই পারে না। শহরের আগেই অত্যন্ত সাদামাটা একটা বিমানবন্দর। বলা যায় শহরের শুরুই হয়েছে ওটা দিয়ে। বন্দরের পাশ দিয়ে পথ। পথ আর বিমানবন্দরের মাঝ দিয়ে প্রবল স্রোতে বয়ে গিয়েছে একটা নদী। নদীর নাম কি তা জানি না তবে তার রূপ দেখে মনে হলো- এত সুন্দর নদীর নাম না হলেও ক্ষতি নেই। বাস থেকে নেমে আগে ফিরতি বাসের টিকিট সংগ্রহ করলাম তারপর ছুটলাম পারো দেখতে। হাতে সময় সাড়ে তিন ঘণ্টা।  

পাহাড় ঘেরা উপত্যকায় লকলকে ধান ক্ষেতের সবুজ মাঠ, তার মাঝে ছোট্ট শহর পারো। পর্যটকদের কাছে পারোর প্রধান আকর্ষণ উঁচু পাহাড়ের গায়ে একটা মঠ। টাইগার’স নেস্ট বলে পরিচিত জায়গাটা আমার তালিকার বাইরে। পারো যাওয়া-আসায় পথের দৃশ্য এবং শহরটা ঘুরে দেখা আমার একমাত্র উদ্দেশ্য। মাথার উপর পাহাড়, নিরিবিলি রাস্তা এবং রাস্তার দুই পাশে সাদা খয়েরি রঙের দুই সারি অনুচ্চ ভবন, সব মিলিয়ে একটা ছবি যেন। 

সকাল থেকে তেমন কিছুই খাওয়া হয়নি। সঙ্গে যে কটা আপেল ছিল তা অনেক আগেই শেষ করে ফেলেছি। খুঁজে বের করলাম কাঁচাবাজার। পাশেই হাতে গোনা দুই একটা ছোট ছোট রেস্টুরেন্ট। পর্যটনের মৌসুম না হওয়ায় রেস্টুরেন্ট থেকে শুরু করে কোন কিছুতেই তেমন বৈচিত্র নেই। এক বাটি ছোলা সিদ্ধ চল্লিশ গুলট্রাম। খাদ্য হিসেবে এই জিনিসে আমি ভীষণ অভ্যস্ত। সুতরাং, নুডুলস এর সাথে মিলিয়ে তা সুন্দর পেটে চালান করে দিলাম। ভরপেট নাস্তার পর পা বাড়ালাম বাজারের দিকে। দোকানগুলোয় নীল পলিথিনের ছাউনি। তার উপর রোদ পড়ে সে আলো ছড়িয়ে পড়ল বাজারের কোণায় কোণায়। পণ্য সম্ভারে পরিপূর্ণ বাজার পলিথিনের কুৎসিত রঙে বিবর্ণ আর অসুন্দর হয়ে উঠল। যার কারণে আর এক মুহূর্তও ভালো লাগল না কিন্তু চলতি পথের রসদ হিসেবে কিছু ফল সংগ্রহ না করলেই নয়। আপেলের কেজি মাত্র পঞ্চাশ গুলট্রাম। এক কেজি আপেল কিনেই বিদায়, যেন হাফ ছেড়ে বাঁচা। 

পারোর পর্যটক শূন্য পথ ধরে হাঁটছি, লক্ষ্য করলাম শহরের সাথে একটা বড় খেলার মাঠ আর সেখানে কিছু মানুষের জমায়েত। মাঠের এক পাশে সুদৃশ্য বৃক্ষ ঘেরা স্থায়ী আর্চারী গ্রাউন্ড। হৈ চৈ শুনে নিকটে গিয়ে দেখি দুই প্রান্তে দুই দল তীরন্দাজের জটলা এবং বৃক্ষ সারির মনোরম ছায়াতলে দর্শকদের জন্য বসার ব্যবস্থা। দর্শক অধির হয়ে বসে আছে কখন তীর নিক্ষেপ শুরু হবে। খেলোয়াড়সহ উপস্থিত প্রায় সকলের পরনে ভুটানের ঐতিহ্যবাহী পোশাক ‘ঘো’। সমবেত সঙ্গীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে শুরু হলো তীর নিক্ষেপ প্রতিযোগিতা। 

এত চমৎকার একটা আয়োজনের দর্শক হতে পারাটা নিজের কাছে পারো ভ্রমণে প্রথম স্বার্থকতা হিসেবে গণ্য হলো। পেরিয়ে গেল অনেকটা সময়। শহরের প্রাণকেন্দ্রে উন্মুক্ত মঞ্চ, গ্যালারী ফাঁকা পড়ে আছে, একটা কাকপক্ষীও নেই। মৌসুমে নিশ্চই কানায় কানায় পূর্ণ থাকে। পথের ধারে শুধু স্মারক জিনিসপত্র এবং উপহার সামগ্রীর দোকান। প্রতিটি দোকানের প্রণ্য হস্তশিল্পজাত। প্রায় সমস্ত পণ্যেই ধর্মীয় ভাবাবেগের বহিঃপ্রকাশ। সামান্য দুই চারটা জিনিস কেনা এবং দোকানগুলো ঘুরে দেখতে দেখতে কখন যে সময় ফুরিয়ে এল তা একদম টের পেলাম না। 

থিম্ফু ফিরে আগেভাগে টিকিট কেটে রাখলাম। পুনাখা যাওয়ার বাস পর দিন সকাল সাড়ে আটটায়। আসন নম্বর এক, একেবারে সামনে। শুধু দেখা আর যাওয়া। সন্ধ্যার আগ দিয়ে বের হলাম শহরময় পায়াচারী করার জন্য। আকাশে হালকা মেঘ। নদী ক্ষিপ্র হয়ে উঠেছে। পাহাড়ে পাহাড়ে যেন এখনই বর্ষা নামবে। অতি যত্নে গড়ে ওঠা শহরকে ভীষণ সুন্দর দেখাল। ক্লক টাওয়ার মঞ্চের কাছাকাছি যেতেই কানে ভেসে এলো শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের এক সুদীর্ঘ টান। গ্যালারীতে সমবেত হয়েছে স্থানীয় ও বিদেশি মিলে কয়েকশ শ্রোতা দর্শক। দর্শক সারিতে পিনপতন নীরবতা। 

একটু পর শুরু হলো কুয়াশার মত ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। সেদিকে কারও খেয়াল নেই। ওদিকে গায়িকার কণ্ঠে মেঘমল্লার। প্রকৃতির এ কিরূপ যুগলবন্দি! পরিবেশনা শেষ হলে আমন্ত্রিত ইন্ডিয়ান গায়িকা মঞ্চ থেকে নেমে গেলেন কিন্তু যন্ত্রীগণ থামতে নারাজ। চললো আরও কিছুক্ষণ। বৃষ্টির বেগ বাড়তে শুরু করায় অনুষ্ঠান এবার পণ্ড হয়ে গেল। বৃষ্টি থামলে আধা ঘণ্টার মধ্যে সব ঠিক হয়ে গেলে দর্শক সারি আগের মত আবারও কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে গেল। এর পরের পরিবেশনা মূলত ভুটানের লোকগীতি। একে একে পরিবেশিত হলো মঞ্চ কাঁপানো গান। গানের কথার বিন্দুবিসর্গ কিছুই বুঝতে পারলাম না কিন্তু সুর বাদ্যের মূর্ছণায় কেটে গেল মনমুগ্ধকর সময়। (চলবে)

পড়ুন তৃতীয় পর্ব: ভুটানের পাঠকশূন্য জাতীয় গ্রন্থাগারে