ভ্রমণ

গগণটিলা হয়ে কালা পাহাড়

১ সে তিন যুগ আগের কথা। ঢাকা থেকে এসে বিল্টু মামা নেমেছেন কুলাউড়া জংশন স্টেশনে। তখন সাত সকাল। এটা-সেটা কেনার পর তিনি ভাবলেন, খালাতো বোনের বাসায় যেহেতু উঠবেন, তো সকালের নাস্তার জন্য ব্রেড সাথে নিয়ে গেলে কিরকম হয়? সেমতো কনফেকশনারি বা বেকারি খুঁজে চলেছেন হন্যে হয়ে, কিন্তু আরাধ্য ব্রেডের আর দেখা নাই। দোকানিরা বেমালুম অস্বীকার অথবা চেপে যাচ্ছে। সবাই বলছে, ব্রেড নাই। অবশেষে ব্যর্থ মনোরথে শেষ দোকান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগমুহূর্তে চোখ পড়ল তাকে সাজিয়ে রাখা ব্রেডের ওপর। বললেন, এটা কী? দোকানি জবাব দিলো, এটা লুফ। আগন্তুক বললেন, এই লুফই খুঁজছি, এটা দিন। নিজের অজ্ঞানতার জন্য বিহ্বল দোকানি অবশেষে হেসেই দিলো। আর এই হাসির সঙ্গে প্রথম দর্শনে নয়নাভিরাম গুছানো শহরটি দেখে বিল্টু মামার চোখে লেপ্টে রইলো মুগ্ধতার আয়েশি রেণু। চিৎকার দিয়ে রিকশা ডাকলেন।

কিন্তু রিকশাওয়ালা স্থানের নাম শুনেই মুখ ঘুরিয়ে নিলো। পাত্তা দিলো না! চেহারায় ইম্প্রেসিভ না হওয়ায় জীবনভর তাকে মেয়েরা পাত্তা দেয়নি। কিন্তু এ আজব শহরে এক্ষণে মনে হচ্ছে, রিকশাওয়ালারাও সেই নারীদের সমপর্যায়ভুক্ত। শেষমেশ দরদাম করে একটাতে চড়ে বসলেন। রিকশাওয়ালার সাথেও অল্পতেই ভাব জমিয়ে ফেললেন। রিকশাওয়ালা জানালেন, তার বাড়ি নেত্রকোনা। বেশি ইনকাম করার উদ্দেশ্যে এখানে চলে এসেছেন। জানালেন, তিনি একাই নন। তার মতো এরকম বিভিন্ন জেলার অসংখ্য লোকজন এখানে থিতু হয়েছেন মূলত ব্যবসা-বাণিজ্য বা জীবনসংগ্রামের সূত্রে। রিকশা এসে থামলো শহরের ব্যস্ততম টিটিডিসি এরিয়ায়। ভাড়া মেটাতে গিয়ে বিল্টু মামার দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো কয়েকটি দেয়ালের দিকে। সূর্য আলোয় চিকচিক করছে কাঠ- কয়লায় অংকিত শৈল্পিক রাজনৈতিক চিকাগুলো। তা যেন এখানকার মানুষের রাজনৈতিক সচেতনতাবোধকেও প্রখরভাবে ফুটিয়ে তুলেছে।

বিল্টু মামা রাতের আহারপর্বে মজে প্লেট ছাড়া কোনোদিকেই তাকাচ্ছেন না। বিরইন চাল দিয়ে তৈরি বাঁশের ব্যবহারে চুঙ্গা পিঠার মাদকতায় তিনি যারপরনাই আচ্ছন্ন। সাথে চিকেন টিক্কা মাসালার স্বাদ নিতে নিতে বোনের কাছে আব্দার করে বসলেন, পরের দিন কারি হিসেবে আতপ চালের সঙ্গে হাঁস-বাঁশ মেনুতে চান। হাঁস দিয়ে বাঁশ রান্না কুলাউড়ার একটি ঐতিহ্যবাহী খাবার। বোন হেসে দিয়ে বললেন, শুধু হাঁস-বাঁশই নয়, এর পরের দিন তিনি সাতকড়া দিয়ে গরুর মাংস ভুনার আইটেমও রাখছেন। বিল্টু মামার জিভে জল লিকলিক করছে দেখে আমি খুব মজা পেলাম।

রাতের খাবার সেরে বেতের সোফার কুশনে খানিকটা গা এলিয়ে, দুলাভাইয়ের কাছে পলকা মুহূর্তের অভিজ্ঞতাগুলো বর্ণনা করলেন। দুলাভাই জানালেন, আঞ্চলিক শব্দের প্রতি এহেন দুর্বলতার কারণ হচ্ছে একদা সিলেটের নাগরিলিপি সাহিত্যের প্রাণকেন্দ্র ছিল কুলাউড়া। সকল  জনপ্রিয় নাগরি পুঁথিকাররা ছিলেন এ কুলাউড়ার অধিবাসী। এই সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্রের বলয় এতই সুদৃঢ় যে, কুলাউড়া ছাড়াও বৃহত্তর সিলেট, ভারতের গৌহাটি, শিলচর, শিলং, কাছাড়, বরাক উপত্যকা, করিমগঞ্জ, আগরতলা, যুক্তরাজ্য, মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ অভিবাসী মিলিয়ে বিশ্বের কয়েক কোটি লোক সিলেটি উপভাষায় কথা বলে নিরন্তর প্রাণের আকুতি মেলে ধরেন।

উত্তরে ফেঞ্চুগঞ্জ, দক্ষিণে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য, পূর্বে আসাম, পশ্চিমে রাজনগর উপজেলা আর এর মাঝ ভূখণ্ডের কুলাউড়ার রেলওয়ে জংশনকে একসময় বলা হতো আসাম প্রদেশের ইস্টার্ন গেট। অনেকটা বাধ্য হয়েই কিনা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেও তাই ১৯১৯ সালের নভেম্বর মাসে ভারতের করিমগঞ্জ থেকে ট্রেনযোগে সিলেট যাত্রাপথে কুলাউড়া রেলওয়ে জংশন স্টেশনে  রাত্রিযাপন করতে হয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার এই সুবিধাকে কাজে লাগাতে দেশভাগের পর থেকেই এখানে তাই আসাম, ত্রিপুরার লোকজনও এসে বসতবাড়ি করেছেন। জ্ঞানমাধুর্য ভরপুর দুলাভাইয়ের বিজ্ঞচিত কথাবার্তার ফাঁকে হাস্যরসও উপচে পড়ল। সেই হাসিতে দুলাভাইয়ের ঠোঁটের ডগায় রস গড়িয়ে পড়া দেখতে দেখতে কুলাউড়ার খাসিয়া পানের ঝাঁঝ ঠিকই আন্দাজ করলেন বিল্টু মামা। সেই রাতে টিমটিমে হারিকেনের আলোয় ঝোলা থেকে বিল্টু মামা কাজী আনোয়ার হোসেনের  মাসুদ রানা সিরিজের ‘অকস্মাৎ সীমান্ত’ বইটি মেলে ধরলেন। কিছুক্ষণ পর দেখি, বিল্টু মামা সদর দরজা পেরিয়ে বাথরুমে যাচ্ছেন। এই ফাঁকে কয়েকটি পেপারব্যাক বইয়ের গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে বুকটা কিরকম জানি সটান হয়ে উঠল। রঙচঙা প্রচ্ছদ দেখে একটি বই বিছানায় নিয়ে যেতে চাইলে বিল্টু মামার কাছে ধরা পড়ে গেলাম।

আমার কাছ থেকে পছন্দের বইটা রীতিমতো কেড়েই নিলেন। গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, ওটা প্রাপ্তবয়স্কদের বই, তোমার না। এক নিমিষেই হৃদস্পন্দন যেন পাঁজরের ভেতর দুমড়ে-মুচড়ে দিলো। তখন নিজের শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণে নিয়ে কোনোমতে রাগ সংবরণ করে ভাবলাম, আমি তাহলে কবে বড় হবো?

বাউণ্ডুলে বিল্টু মামার সাথে পরদিন হাওরে নৌকাবাইচ শেষ করে ঘুরতে ঘুরতে একটি রিকশা নিয়ে এসেছি ৬ কিলোমিটার দূরের ইস্পাহানি টি এস্টেইট। ওখানকার ম্যানেজার সাহেব বিল্টু মামার পূর্বপরিচিত। খাতির-ঘত্নের অভাব হলো না। ঘুরে ঘুরে দেখলাম ইস্পাহানি-মির্জাপুর চা বাগান এবং এর মনভোলানো বৈচিত্র্য। ম্যানেজার সাহেব জানালেন, অ্যাডভেঞ্চারের স্বাদ নিতে হলে এখানকার গগণটিলার চূড়ায় উঠতে হবে। চূড়ায় উঠলে কুলাউড়া শহরটা খুব ছোট মনে হবে আর কাছাকাছি থাকা ভারতীয় পাহাড়গুলো দৃশ্যপটে ধরা দেবে। হাতে সময় থাকলে লংলা পাহাড় বা কালা পাহাড়টিও পরিদর্শন করার অনুরোধ করলেন। সময়স্বল্পতা হেতু মামা আর আমার এর কোনোটিই চর্মচক্ষুতে ধারণ করা সম্ভব হলো না। মধ্যবয়স্ক ম্যানেজার সাহেব ভীষণ সদালাপী এবং বন্ধুবৎসল। জানালেন, কর্মসূত্রে এখানেই একটানা ১৫ বছর। নাগরিক বিজ্ঞাপনের জনারণ্য থেকে সৌন্দর্য়ের আড়ালে থাকা প্রাচুর্যহীন এই অরণ্যজীবন তার কাছে ভীষণ উপভোগ্য। পকেটে হাত দিয়ে ট্রিপল ফাইভ সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটি নিজ মুখে পুরে নিলেন, অন্যটি বাড়িয়ে দিলেন বিল্টু মামার দিকে, সঙ্গে লাইটার। ড্রাইভারকে আদেশ দিলেন বাংলো থেকে দ্রুত গাড়ি বের করতে।

জঙ্গল পাহাড়ের ঝোপ-ঝাড়, ঘন সবুজ আদিমতা, বুনো গন্ধ, পাহাড়ের নেশা ধরানো থমকে থাকা পেছনে ফেলে আমাদের জিপ গাড়িটি এগিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ শহরের দিকে। সন্ধ্যা সমাগত। চার ব্যাটারির টর্চলাইট জ্বেলে দূরের মিটিমিটি আলোর দিকে ইঙ্গিত করে সহসা ম্যানেজার সাহেব বলে ওঠলেন, ইউরেকা! ইউরেকা! এই যে সিলেটি ঘর! এখনো হঠাৎ হঠাৎ চোখে পড়ে ফাঁকেফুঁকে। ছিটেফোঁটা হাতেগোনা গুটিকয় এখনো আছে, বসতবাড়ি বা টি গার্ডেনের বাংলো হিসেবে। এ অঞ্চলে এগুলোকে বলা হয় ‘আসামিজ টাইপ ঘর।’ নির্মাণ ও স্থাপত্য জগতেও এই বৈশিষ্ট্যের ঘরগুলোর পরিচিতি সিলেটি বা আসামিজ টাইপ ঘর। দূর থেকে দেখলেও একটি মিল চোখে পড়ে—প্রতিটির ছাদের রঙ গাঢ় লাল। কালের আবর্তে হারিয়ে যাওয়া এই সিলেটি ঘরগুলো কুলাউড়া ছাড়া একমাত্র সিলেট শহরেই দেখা যায়। সিলেটের বাইরে আসামের শিলং, গৌহাটিতে প্রায়শ দেখা মিলে। কালো কাঠের ব্লক, ব্লক ফ্রেমে সাদা দেয়াল, ঢেউ টিনের। কোনটির সমুখে, কোনটির তিন দিকে বা চতুর্দিকে বারান্দার মতো ছাদ টানা। এ ধরনের ঘরবাড়ির মূল আকর্ষণ চার, ছয়, আট চালা ছাদ।

গাড়ি এসে থামলো আজম বোর্ডিংয়ে। গরম লুচি, বুন্দিয়া সঙ্গে গরুর দুধের চা খেয়ে পরিতৃপ্ত ম্যানেজার সাহেব করমর্দন করে বিদায় নিলেন। এবার আমাকে বাসায় পাঠিয়ে বিল্টু মামা চলে গেলেন ভাষাসৈনিক রওশন আরা বাচ্চুর সাথে নিভৃতে খোশগল্প করতে।

বাসায় এসে খাওয়া-দাওয়া সাঙ্গ করে, বাক্স-পেটরা গুছিয়ে বিল্টু মামা রওয়ানা দিলেন রাতের মেইল ট্রেন ধরে ঢাকার উদ্দেশে। আমার কিশোর মনটার উড়ুউড়ু ভাব দমে গেল। আসলে মন খারাপের কোনো নির্দিষ্ট ধরনের সাথে এর আগে পরিচিত ছিলাম না। কিন্তু বিল্টু মামার বিদায় মুহূর্তে কেন জানি হৃদয়ে একাকিত্বের রক্তক্ষরণ হলো। একেই কি বলে শূন্যতার রক্তক্ষরণ?

২  ২৬ বছর পর জীবন যখন অতিমারিতে অবরুদ্ধ। অবরুদ্ধ জীবনের ধূসর প্রেক্ষাপট নিয়ে বিচিত্র শহরটিও দেখি কিরকম অবিশ্বাসী! বাইরের ল্যাম্পপোস্টের আলো থেকেও মানুষের জন্য বিচ্ছুরিত হচ্ছে সহানুভূতি নাকি করুণা বুঝে ওঠতে পারি না। সর্বশেষ সংযোজন-বিয়োজন নিয়ে শুনতে হচ্ছে সান্ত্বনাহীন কোভিড মহামারির নানা ধরনের খবর। লকডাউনের ফ্ল্যাটে বসে কাটছে পারিবারিক গল্পময় যাপিত জীবন। সবাই যার যার ঝাঁপ ফেলে গুমোট মুখে বাসায় বসে থাকে। বিরক্তিরা তড়পায়। পাশের বাসা থেকে এক বৃদ্ধ কেশে উঠছেন ঘনঘন। বোধহয় কাশির সাথেই চলমান পৃথিবীটার ওপর প্রচুর ক্ষোভও ঝেড়ে দিচ্ছেন। তুলনামূলক বাইরের পৃথিবীটাই বরং অনেক শান্ত। নিঃসঙ্গতা শব্দটি বায়বীয়। প্রকৃতিপ্রেমিক আমার কাছে নির্জনতাই আরাধ্য। তাই রবী ঠাকুরের কবিতা কানে বাজলো খুব—‘বহুদিন ধরে বহু ক্রোশ দূরে/বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে/দেখিতে গিয়েছি পর্বতমালা/দেখিতে গিয়াছি সিন্ধু/দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া/ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া/একটি ধানের শীষের উপরে একটি শিশিরবিন্দু।’

সাধারণ একটি টিলা কিভাবে মানুষের আগ্রহ এবং কৌতূহলের কেন্দ্রবিন্দুতে স্থান পেতে পারে, তা কুলাউড়ার গগণটিলায় আসা দর্শনার্থীদের সাথে কথা না বললে বোঝা যাবে না। পাহাড়ি সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে ট্রেকিং ট্রেইলের মাধ্যমে এই চূড়ায় যারা আরোহন করছেন; দেখলাম তারা বেশিরভাগই স্থানীয় মানুষ। মনে হলো, ছুটির দিনে কোথাও কোয়ালিটি টাইম বিনিয়োগ করতে চাইলে এ জায়গার জুড়ি দেশের অন্য কোথাও পাওয়া যাবে না। কেউ কেউ সপরিবারে এসেছেন, কেউ কেউ বন্ধুবান্ধবসহ। অনেকে সিঙ্গেল। এদের কেউ চা বাগানের বিশালত্বে হারাবার বিপুল আনন্দে আত্মহারা। কেউ ভিডিওগ্রাফিতে মগ্ন। আবার কেউ হয়তো উঁচু গগণটিলায় উঠে সমতল দেখার আনন্দে নিজেকে ভাবছেন গৌরবান্বিত আবার পরক্ষণেই হয়ত ভাবছেন প্রকৃতির ঐশ্বর্য়ের কাছে নিজে কতটাই না ক্ষুদ্র। প্রকৃতির কাছে হারিয়ে যেতে যেতে মানুষ ভাঙছে তার নিজেরই হাতে গড়া শহুরে যন্ত্রজীবন। অমোঘ নিয়তির গলা জড়িয়ে প্রকৃতিতে শেষমেশ লীন হতে চায় মানুষ। মানুষের শেকড় যেহেতু লেপ্টে আছে প্রকৃতির সঙ্গে; ভাবি, এ শেকড় ছিঁড়ে পালানোর কি কোনো মন্ত্র জানা আছে? আইনস্টাইন একবার বলেছিলেন, মানুষ সেই সমগ্রেরই অংশ যাকে আমরা মহাবিশ্ব বলে থাকি। এই অংশটি সময় এবং স্থানের মধ্যে সীমাবদ্ধ। যখন কোনো ব্যক্তি নিজেকে এর থেকে আলাদা কিছু মনে করে, তখন তা হয় আত্মপ্রতারণা।

আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ, মাথার ওপরে সুনীল আকাশ। একটু এগিয়ে গেলেই যেখানে সবুজ জঙ্গল সেখানেই দেখা হয়ে যায় শিক্ষক ও সাংবাদিক সঞ্জয় দেবনাথের সাথে। গগণটিলা থেকে নেমে অপার্থিব আনন্দে বাগান অভ্যন্তরের তাজা পাতায় সিক্ত লিকার চায়ে চুমুক দিতে দিতে, হাস্যরসে হুটোপুটি খাওয়া এক নববিবাহিত দম্পতির দিকে তাকিয়ে সঞ্জয় আনমনে বলে ওঠেন, বাঁচো, বাঁচো এবং বাঁচো। আনন্দ নিয়ে জীবনভর বাঁচো! বিকেলের নরম রোদে তখন জমে উঠেছে দিগ্বিজয়ী বাতাসের হিল্লোল। ঘুমিয়ে পড়ার আগে যেন কুমারী মেয়েদের মতো কচি কচি সবুজ পাতারাও তুমুল আনন্দে বাতাসের বিছানায় এপাশ-ওপাশ একটু গড়াগড়ি খেয়ে নিচ্ছে!

৯৬০ ফিট উচ্চতার গগণটিলা মৌলভীবাজার জেলার সর্বোচ্চ টিলা। টিলাটি ইস্পাহানি গ্রুপের গাজীপুর বাগান কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে রয়েছে। টিলার ওপরে দাঁড়িয়ে থাকা বাংলোটিও পর্যটকদের জন্য অফুরান মুগ্ধতার উৎস। জানা গেল, বেসরকারিভাবে বাংলোটি ব্যবহারের অনুমতি না থাকলেও চাইলে সিনেমার শুটিংয়ের জন্য এটাকে ব্যবহার করা যায়। এছাড়া, শীর্ষ রাজনীতিক এবং আমলারা গগণটিলার দৃষ্টিনন্দন বাংলোতে অবকাশযাপনে যখন-তখন চলে আসেন। কুলাউড়া শহর থেকে মাত্র ৬ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত এই টিলা।

সারি সারি নানা প্রজাতির ফুলের গাছ, বন্যপ্রাণীর কিচিরমিচির শব্দ, শান্ত-সৌম্য ছায়াঘেরা এক নির্জনতা ভেদ করে লোকালয়ের দিকে এগোতে এগোতে সঞ্জয় বলছিলেন, কুলাউড়ার আরেকটি ঐতিহ্য রাজার দিঘির গল্প। সেখানে ফি বছর বড়শি উৎসবের আয়োজন হয়। সিলেট মুলুকের সৌখিন মৎস্যশিকারীর দল সেই শিকারে মত্ত হয়ে ওঠেন। ভালো বড়শি এবং আদার নিয়ে তুমুল হর্ষধ্বনিতে দক্ষ শিকারীরা সুনিপুণভাবে দিঘি থেকে বড় আকৃতির মাছ ধরে দর্শকদের কাছে নিজেদের হাতযশ প্রমাণ করে থাকেন। তবে, কিছুটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে জানালেন, ছায়াতরুসমৃদ্ধ কালিটি চা বাগানের ঐতিহ্যবাহী পদ্মপুকুরটি আর আগের অবস্থায় নেই। অতীতে একসময় ফুলে ফুলে শোভিত পদ্মপুকুরের নয়নাভিরাম দৃশ্য অবলোকনের জন্য যেখানে হাজার হাজার মানুষের পদচারণা ছিল, সেখানে আজ কচুরিপানার সমাহার!

মোটামুটি দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা লাগল। উঠতে-নামতে মোট  সারে পাঁচ ঘণ্টা। জয় করলাম কুলাউড়ার কালা পাহাড়ের চূড়া। তার আগে অবশ্য এই পাহাড়ের আরণ্যক পরিবেশে উপরে ওঠার জন্য যথেষ্ট কসরৎ করতে হলো। কুলাউড়ার গ্রেট আইকনের অবস্থান সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১১০০ ফুট ওপরে। চূড়ায় ওঠার পর মনটা বিষণ্নতায় ভরে উঠলো। সুখকর অনুভূতির জন্ম হলো না। আকর্ষণীয় ভিউ এখানে যে দুরাশা। এক্সট্রিম অ্যাডভেঞ্চারাস ট্রেকিং ট্রেইলে আরোহীদের জন্য এটা হতে পারে আদর্শ জায়গা। কালা পাহাড়ের ট্রেকিং পথটি অনেক সুন্দর। পাহাড়ে ওঠার পথ একটা, যার নাম পাহাড়ি পথ। কিন্তু নামার পথ দুইটা, ঝিরি পথ ও পাহাড়ি পথ। ঝিরি পথে গেলেও পাহাড়ি পথ ভ্রমণ করেই তবে যেতে হবে। কালা পাহাড়কে এখানকার স্থানীয়রা ‘লংলা পাহাড়’ নামেও সম্বোধন করেন। এই পাহাড়ের ৬০ ভাগ বাংলাদেশের ভূ-সীমায় থাকলেও ৪০ ভাগ ভারতীয় সীমানায়। উত্তর ত্রিপুরায় এই পাহাড়ের বাকি অংশকে রঘুনন্দন পাহাড় নামে ডাকা হয়।

চুল অকিঞ্চিত, মুখমণ্ডল গোলাকার, নাক চ্যাপ্টা, গণ্ডদেশ উন্নত। দেহের আকার মধ্যম। দেখেই বোঝা গেল উনি প্রাচীন মঙ্গোলিয়ান মহাজাতির উত্তরসূরী। বাংলাদেশের দুর্লভ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠি খাসিয়া সম্প্রদায়ের সদস্য, নাম রাজেশ সুচিয়াং। তাকে দেখে আমার চোখে কৌতুহল। নিবৃত্ত করতে গিয়েই কি না তিনি কথার তুবড়ি ফুটিয়ে  বলতে থাকেন, ভারতীয় সীমান্তসংলগ্ন গভীর অরণ্যই খাসিয়াদের আবাসের জন্য পছন্দনীয় স্থান। খাসিয়ারা মূলত মাতৃতান্ত্রিক সম্প্রদায়। এদের পরিবারের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন নারীরা। নারীরা কনেযাত্রী নিয়ে বিয়ে করে বর নিয়ে আসেন নিজ নিজ পানপুঞ্জিতে। এ কারণে কোনো খাসিয়া পরিবারে তিন ভাই থাকলে বিয়ে করে তিন পুঞ্জিতে চলে যান। আর নারীরা নিজেদের বাড়িতেই পিতা-মাতার সঙ্গে স্বামী-সন্তানসহ বসবাস করে থাকেন। এদের পরিবারে নারীদের ভূমিকাই মুখ্য। কুলাউড়ার খাসিয়ারা সিনতেং গোত্রভুক্ত জাতি। স্থাবর-অস্থাবর সব সম্পদের মালিক হন নারীরা। পুরুষদের বিয়ে হলে তারা গিয়ে ওঠেন শ্বশুরবাড়ি অর্থাৎ স্ত্রীর বাড়িতে। তারা বাড়ির কাজে ও পানের জুমে কাজ করে পরিবারকে সহায়তা করেন। স্ত্রীর বাড়িতে পুরুষরা কাটিয়ে দেন জীবনের বাকি দিনগুলো।

বেগুনছড়া, পুঁটিছড়া, লবণছড়া পুঞ্জিগুলোর নামও বেশ সুন্দর! রাজেশের সাথে গল্প করতে করতেই সামনে এগিয়ে এলো ওর মেয়ে এথিনিয়া। দেবশিশুর মতোই দেখতে এথিনিয়া গায়ে জড়িয়েছে তার শরীরে মানানসই বৈচিত্র্যময় নকশার ‘রাঙাখাদি’ যা সূক্ষ্ম সুতো ও তাঁতের বুননে তৈরি। ট্রাউজারের জায়গায় আবার ‘পিনন’। যা আমাদের সেলাইবিহীন লুঙ্গির মতোই। মিষ্টি হাসিতে এথিনিয়া বললো, ওখানে হ্রদের ধারে আমাদের বেগুনছড়া পুঞ্জি। আঙ্কেল, যাবেন নাকি আমাদের কুটিরে? প্রায় ৩০০ ফুট দূরে তাকিয়ে দেখলাম, মাটির চাতাল। সাদা ধবধবে। এর ৩-৪ ফুট উঁচুতে বিশেষভাবে তৈরি খাসিয়াদের ঘর, সঙ্গে প্রতিটি বাড়ির শোভাবর্ধক হিসেবেই যেন কাজ করছে পানবরজ। পকেটে থাকা চকলেট ধরিয়ে দিয়ে বললাম, আজ নয়, অন্য কোনোদিন। লাফাতে লাফাতে এ পাথর সে পাথর ডিঙ্গিয়ে পথ চলে এথিনিয়া। ওর পায়ের ঝিনুকের নূপুর ছুমছুম বাজে। আমি ওর চলে যাওয়াটা দেখতে দেখতে ভাবি, কিছু কিছু সম্পর্ক আছে বেশ অদ্ভুত। জীবনে ক্ষণিকের জন্য দেখা হলেও তাদের প্রভাব থাকে সারাজীবন। শুধু এথিনিয়া নয়, মনে হলো এখানকার সবুজ পাতা, রঙিন ফুল, ডালপালাও দুলে দুলে বলছে, এসো, এসো, এসো…। ভাবছিলাম, শতাব্দীর পর শতাব্দী, ধৈর্য পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কিভাবে ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছে এই কালা পাহাড়ের চূড়া? যার ওপরে ভেসে বেড়াচ্ছে এখন শরতের টুকরো টুকরো মেঘ। দেখছি, পথের ধারে ফুটে আছে নাম না জানা অসংখ্য বুনোফুল। দূরে যেমন শোনা যাচ্ছে হাতির ডাক…। তেমনি পায়ের সন্নিকটে ঘাসঝোপে পাখিদের সেকি বাহাস! স্নায়ুকোষগুলো জেগে ওঠে!

নেই গাড়ি-ঘোড়ার শব্দ। বড় পাহাড় আর আশপাশে ছড়িয়ে থাকা ছোট পাহাড়, ছোট টিলার পাশে সবুজ ঘাসের বন, সব টাটকা সবুজ যেন এক্ষুণি বৃষ্টিতে ভিজে যাবতীয় মলিনতা ধুয়েছে। অতঃপর পাহাড়ের ঢালে জঙ্গলের ঝোপ-ঝাড়ের লাল পাতায় নিয়ে এসেছে এক প্রবল অনৈসর্গিক সৌন্দর্য। রাজেশ সুদূরের দিকে ইঙ্গিত করে জানাচ্ছেন, যেখানে কিনা রঙ আর বিন্যাস উৎকর্ষতার চরম মাত্রায় পৌঁছেছে। একবারে ন্যাচারাল ফ্লেভার। সামনে পা ফেলছি, অথচ পা যেন এগুচ্ছে না! শ্রদ্ধায়-সভ্রমে-বিস্ময়ে আমি বারবার রহস্যময় পাহাড়টার দিকে ফিরে ফিরে তাকাই। শিল্পের ধ্রুপদী সৌন্দর্যবোধ কি একেই বলে? একটু আনমনা হয়ে সুনীল আওড়াই: আমার নিজস্ব একটা নদী আছে, সেটা দিয়ে দিতাম পাহাড়টার বদলে। কে না জানে পাহাড়ের চেয়ে নদীর দামই বেশি। পাহাড় স্থানু, নদী বহমান। তবু আমি নদীর বদলে পাহাড়ই কিনতাম। কারণ আমি ঠকতে চাই। (পাহাড় চূড়ায়- সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়)