ভ্রমণ

মেঘের দেশের ছোট্ট শহর পুনাখা 

এমাদাসি কেওয়াদাসি: শেষ পর্ব 

সকাল আটটা বাজার আগেই টার্মিনালে গিয়ে উপস্থিত হলাম। কাউন্টার থেকে জানানো হলো, বাস ছাড়তে এক মিনিটও এদিক-সেদিক হবে না। সুতরাং এত আগে আসার কোনো দরকারই ছিল না। 

ঠিক তাই, সঠিক সময়ে শুরু হলো পুনাখা যাত্রা। কিছুদূর যাওয়ার পর বিদেশি পর্যটকদের অনুমতিপত্র পরীক্ষা করা হলো। মূলত এর পরই মূল যাত্রা শুরু। পথের বড় একটা অংশ মেঘের মাঝ দিয়ে পেরিয়ে গিয়েছে। দোচুলা বা দোচালা এ পথের অন্যতম আকর্ষণ। পথের ঠিক মাঝখানে ধর্মীয় স্থাপনা সংবলিত অপেক্ষাকৃত উঁচু জায়গাটাই দোচুলা। তার চতুর্দিক দিয়ে পথ। বাস না দাঁড়িয়ে কয়েক সেকেন্ডে একটা চক্কর মেরে পুনরায় চলতে শুরু করল। কিছু দূর এগিয়ে যাওয়ার পর চোখ জুড়ানো জুমের ধারে একটি মাত্র রেস্টুরেন্ট। সেখানেই আধা ঘণ্টার মধ্য বিরতি। 

পাহাড়ের শীর্ষ পর্যন্ত উঠে গিয়েছে জুমের শিখর। তারই মাঝে সাদা খয়েরি রঙের একগুচ্ছ ঘরবড়ি নিয়ে ছোট ছোট বসতি। উপত্যকার বুক চিড়ে বয়ে যাচ্ছে নদী। তার পাড়ে ছোট্ট শহর পুনাখা। শহর ছাড়িয়ে খানিক দূরে পুনাখার মূল পর্যটন কেন্দ্র। পুনাতাংচু নদীর কিনারে পুনাখা জো নামক সুরম্য ভবনটিই তার প্রধান আকর্ষণ। আগের রাতে বৃষ্টির কারণে নদীর বুকে প্রবল স্রোতের ঘোলা পানি। তার উপর দিয়ে আদিম ধাচের একটা কাঠের সেতু। সেতু পেরিয়ে ভবনের ভিতরে প্রবেশ করতে হয়। পরনে হাফপ্যান্ট থাকায় প্রবেশের অযোগ্য বিবেচিত হলে কর্তব্যরত পুলিশ সদস্য জনাব সনম দর্জির আন্তরিক সহযোগিতায় অন্তত সেতুর শেষ প্রান্ত পর্যন্ত যাওয়ার অনুমতি পেলাম। 

এরপর আশপাশ ঘুরে দেখা শুরু করলাম। স্কুল ছুটি হলে শিক্ষার্থীর দল হুড়মুড় করে বেরিয়ে পড়ল। প্রত্যেকের পরনে ঐতিহ্যের পোশাক ঘো। ঘো পরা শিক্ষার্থীরাই আমার এই পর্বের সারথি। বসতির শুরুতে দুই তিনটা দোকান। পিছনে বসবাসের ঘর আর সম্মুখের অংশ নিয়ে দোকান। দোকানের ভিতরে বসে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা। নানা বয়সী কয়েকজন মিলে জমিয়ে তুলেছে গল্পের আসর। আমার চোখ চলে গেল মাথার উপর, বাঁশের আঁড়ে ঝুলছে পেঁচানো সসেজ। ঠিক যেন কতকগুলো কালো সাপ। গল্পে গল্পে বেশ খানিকটা সময় পেরিয়ে গেল। শিক্ষার্থীদের মাঝ থেকে কয়েকজন ইতোমধ্যেই বাড়ি গিয়ে বইপত্র রেখে ফিরে এসেছে। নদীর পাশ দিয়ে পাকা রাস্তা। তাদের সাথে হেঁটে গেলাম উজানের দিকে। নদীর কূলজুড়ে বিস্তির্ণ ফসলের ক্ষেত উঠে গিয়েছে পাহাড়ের গায়ে। তার ফাঁকে ফাঁকে হাতে গোনা দুই একটা ঘর। এত সুন্দর দৃশ্য রেখে উঠে আসতে ইচ্ছা হলো না। কিন্তু লাঞ্চের সময় হয়ে এসেছে, সুতরাং উঠতেই হবে। 

জো’র সামনে চত্বরের সঙ্গে টিলা। তার উপর উন্মুক্ত দোকানে বিক্রি হচ্ছে মরিচ আর মশলার ভর্তায় মাখানো লাল নুডুলস। গালের মধ্যে পান আর খাবারে মরিচ ভর্তা, ভুটানের সংস্কৃতিতে এ দুটোর উপস্থিতি খুব বেশি। মরিচের সংযুক্তি ব্যতিরেকে খাবার কল্পনা করা যায় না। পানের কথা বলতে গেলে কমবেশি সকলেই অভ্যস্ত। পানকে বলা হয় পানে, দুমা হলো সুপারি এবং চুনকে বলা হয় চুনে। তারা মজা করে বলে ‘পানে, দুমা, চুনে এই তিনে হলো সবচেয়ে শক্ত বন্ধুত্ব।’

যাই হোক, দোকানের অন্যান্য খাবারের মধ্যে জুমা এবং লাউ অন্যতম। অর্থাৎ প্রথমটা সসেজ এবং দ্বিতীয়টা গরুর কলিজা। বড় টুকরো করা কলিজা এবং সসেজ উভয় পদেই পর্যাপ্ত মরিচের ফ্লেক্স মিশানো। আমি বরং নুডুলস খেতেই বেশি আগ্রহী হলাম। অন্যরা খেলো সাবালে। অর্থাৎ সমুচা। জো থেকে বেরিয়ে আসা এক কর্মকর্তা বেছে বেছে বড় এক টুকরো লাউ নিয়ে খাওয়া শুরু করলেন। বিক্রেতা আমাকে একটা লাউ খাওয়ার জন্য খুব করে বললেন কিন্তু পর্যাপ্ত নুডুলস খাওয়ার ফলে তার কথা রাখা সম্ভব হলো না। পুনাখার দুই থেকে তিন ঘণ্টা সময় অতি সাধারণভাবে কেটে গেল। কিন্তু মনের মধ্যে তা মূল্যবান স্মৃতি হয়ে রইলো। পথে পাওয়া সারথিদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফিরতি বাসে উঠে পড়লাম। 

দেখতে দেখতে থিম্ফুতে আমার শেষ দিন সমাগত। শহরটাতে পা রাখার পর থেকে সেই একই রেস্টুরেন্টে খাবার খেয়ে যাচ্ছি। একেক বেলায় একেক পদের খাবার। রেস্টুরেন্টের নাম পাসাং লামো। সহকারী লোকটির বয়স ৫০ থেকে ৫৫ বছর। বাক প্রতিবন্ধী এবং কানেও কম শোনেন। আমি যাওয়ার সাথে সাথে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কাঁচা মরিচ, মরিচের চাটনি, পেঁয়াজসহ অন্যান্য জিনিস এগিয়ে দিতে থাকেন। খাবার শেষ হওয়ার আগেই ইশারায় জানতে চান আর কিছু লাগবে কিনা।

শেষ বেলার খাবার খেতে একটু তাড়াতাড়ি গিয়ে উপস্থিত হলাম। ভিতরে বেশ কয়েকজন মানুষ। কেউ সসেজ, কেউ গরুর মাংস তো কেউ ভুরি চিবিয়ে খাচ্ছে। সাথে কাঁচের মোটা মোটা মগ ভর্তি বিয়ার। চলছে হাস্যরসাত্মক গল্পগুজব। কয়েকটা পদের সাথে রান্না হয়েছে এমাদাসি এবং পূর্বের দেওয়া কথা রাখতে সামনে বসিয়ে রেখে রান্না করা হলো আরেক জনপ্রিয় তরকারী কেওয়াদাসি। আমি বরং ভাতের সাথে দুটোই বেছে নিলাম। প্রতি বেলার মতো অতিরিক্ত পদ হিসেবে পরিবেশিত হলো দুই টুকরো গরুর মাংস। শুকনো খটখটে আর কালো রঙের টুকরো দুটোর গায়ে শুধু মরিচের প্রলেপ। স্বাদে অনন্য নয়, তবে তা যে বিশেষ সেটা বলতে দ্বিধা নেই। 

কোথায় কোথায় ঘুরলাম আর কী দেখলাম, এসব নিয়ে কথা হলো বেশ কিছুক্ষণ। বিদায়ের সময় ভদ্রমহিলা তার স্বামী এবং সন্তানকে সাথে নিয়ে কাছে এগিয়ে এলেন এবং আমার হতে কাগজের ছোট্ট একটা মোড়ক তুলে দিলেন। লজে ফিরে ফ্রেশ হওয়ার পর প্যাকেট খুলে দেখি তাদের প্রথম রাজার ছবি সংবলিত একটা কোর্টপিন। যে কোনো উপহারের মান ও ধরন ছাপিয়ে প্রধান বিবেচনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায় তার সাথে জড়িয়ে থাকা আবেগ আর সম্মান। পড়শি দেশ হওয়ার সুবাদে ভুটানের রাজতন্ত্র ও রাজনীতির ইতিহাস মোটা দাগে আমাদের জানা। এবার তার বাস্তবতার সাক্ষী হলাম। অদ্ভুত রাজতন্ত্র ভুটানের! এ যেন শুধু একজন বিদেশিকে দেওয়া উপহার নয় বরং ভুটানের জনগণের রাজভক্তির নমুনা। (শেষ)  

পড়ুন চতুর্থ পর্ব : পাহাড়ঘেরা অপরূপ পারো