ভ্রমণ

সিঙ্গাপুর কৃত্রিম আয়োজনে অতৃপ্তির শহর 

ভরপুর কৃত্রিম আয়োজন। চোখ এবং মন কোনোটাই ঠিক তৃপ্ত হতে পারছে না। তেমন কোনো কিছুর সন্ধানও কেউ দিতে পারছে না, যেখানে গেলে তৃপ্তি মিলবে বা স্বার্থকতা খুঁজে পাওয়া যাবে। দুই দিন পেরিয়ে গেল চোখ ঝলসানো এবং তাক লাগানো জিনিসপত্র দেখে।

লিটল ইন্ডিয়া দেখার পর শোনা গল্পের সিঙ্গাপুরকে মিথ্যা মনে হলো। নিয়ম-কানুনের বালাই কম। যে দেশে চুইংগাম চাবানো নিষিদ্ধ সে দেশে লিটল ইন্ডিয়া জঞ্জাল সমতুল্য। হোস্টেলে ঢুকলে অভিজ্ঞতা একটু ভিন্ন। আঠারো বিছানার ডরমেটরিতে একদিনের জন্যও একটা বিছানা ফাঁকা পড়ে রইল না। নানান দেশের পর্যটকের আনাগোনা, কেউ আসছে তো কেউ বিদায় হচ্ছে। তুর্কি ভদ্রলোকের শোরগোল পুরো হোস্টেলের অন্যতম অনুষঙ্গে রূপ নিয়েছে। মাসাধিক কাল অবস্থান করছেন। ফলে হোস্টেলটাকে নিজ বাড়ি বানিয়ে ফেলেছেন। ফ্রিজারের অর্ধেকটা কেবল তারই জিনিসপত্রে ভরা। ইংরেজি একেবারেই জানেন না, তবে নিজে যখন কথা বলেন, তখন তার প্রকাশভঙ্গীতে মনে হয় সকলেই বুঝতে পারছে তিনি কী বলছেন। বেশিরভাগ সময় একা কথা বলা তার অভ্যাস। ডাইনিং-এ রান্না সহযোগী প্রায় সব তৈজসপত্রই আছে। তিন বেলা তার রান্নার আয়োজন পাক্কা তিন ঘণ্টার বিষয়। অথচ, অন্যরা দশ মিনিটেই খাবার তৈরি করে চুপচাপ খেয়ে বিদায়। মাঝে মাঝে তার নিজ হাতে রান্না করা খাবার থেকে কিছুটা অন্যের পাতে তুলে দিতেও কার্পণ্য করেন না। আহ, মন মাতানো সুগন্ধে প্রাণটা জুড়িয়ে গেল! এমন একটা অভিব্যক্তি প্রকাশের দামস্বরূপ কোনো এক বেলায় তার পোলাও ভক্ষণের সুযোগ আমারও হলো। 

মোবাইল ফোনের পর্দায় এক চাপেই বেরিয়ে এল ঐতিহাসিক জায়গাসমূহের ঠিকানা। উপযুক্ত গন্তব্যের সন্ধানে সাবওয়ে বা ভূতল ট্রেনে চেপে বসলাম। চলতে চলতে ট্রেনটা এক পর্যায়ে মাটি ফুড়ে বেরিয়ে পড়ল। ট্রেনের ভিতর কৃত্রিম আলোর জায়গা দখল করে নিলো ঝকঝকে দিনের আলো। উপর দিয়ে ট্রেন আর নিচ দিয়ে অন্যান্য যানবাহনের পথ। পথের পরেই উঁচু দালানের সারি। ক্রমেই দালানের পরিবর্তে দুই ধার দখল করে নিলো বৃক্ষ সারি। দূরে আকাশ যেখানে মাটিতে মিশেছে সেখানেও বৃক্ষ। শোনা গল্পের সিঙ্গাপুরকে আবারও মিথ্যা মনে হলো। সিঙ্গাপুরে শুধু দালানই নয়, বৃক্ষরাজিও আছে!

দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম শহর ছাড়িয়ে দূরের ক্রানজি স্টেশনে। মানুষের আনাগোনা একেবারেই হাতে গোনা। মাত্র কয়েকজন যাত্রী। নিচে নেমে টিকিট কাউন্টার থেকে ক্রানজি ওয়ার মেমোরিয়ালের দিকনির্দেশনাটা ভালোভাবে বুঝে নিলাম। জুলাই মাস, রোদের তীব্রতা নেহায়েত কম নয়। মাথার উপর ছাতা মেলে ধরে পা চালালাম নতুন গন্তব্যের দিকে। চারটি বড় রাস্তার মিলনস্থলে গিয়ে সঠিক পথের হিসেব কষতে একটা ভুল হয়ে গেল। গুগল ম্যাপের নির্দেশনা ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না। তাছাড়া, আমি এই জিনিসটাতে খুব একটা অভ্যস্তও নই। ডান দিকের পথ ধরে কিছু দূর এগিয়ে আবারও ফিরে এলাম চৌরাস্তায়। এরপর সিগনাল পেরিয়ে হাঁটতে থাকলাম সোজা। গাড়ি-ঘোড়া চলছে তবে আশপাশে জনমানুষের চিহ্ন নেই। ফুটপাথের বাম পাশটায় এক সারি গাছ। ডান পাশে গড়ের মতো সামান্য উঁচু জঙ্গল রাস্তার সাথেই এগিয়ে যাচ্ছে। 

গাছ পরগাছায় ঠাসা। শীর্ষ বিন্দু স্পর্শের পর উপায়ন্তর না দেখে যে যেখান থেকে পেরেছে আপন ইচ্ছায় বট গাছের ঝুরির মতো ঝুলে পড়েছে। বাঁশ ঝাড়ের প্রতিটি কঞ্চি থেকেও বেরিয়ে পড়েছে আহ্লাদি লকলকে পাতা। নিরিবিলি জঙ্গলে বাঘ সিংহ না থাকলেও হুট করে সাপ-বেজির মতো প্রাণী যে কোনো সময় বেরিয়ে পড়তে পারে। এই আশঙ্কায় মনের মধ্যে সামান্য রোমাঞ্চ অনুভূত হলো। দালানকোঠা ছাড়িয়ে এক টুকরো জঙ্গলের বাসিন্দা হতে পেরে আমার ভীষণ ভালো লাগল। একা না হয়ে দুইজন হলে অথবা পথে মানুষজন থাকলে এই জঙ্গলপথ ধরে হয়তো সারাদিনই হাঁটা যেত! রাস্তার অপর পাশে বেশ কিছু অফিস ভবন তবে বাইরের চত্তরে একটা মানুষও নেই। ভাবলাম ওয়ার মেমোরিয়ালের দিকনির্দেশনা নিতে কোনো একটা অফিসেই ঢুকে পড়ব। কিন্তু এখানেও বিপত্তি, রাস্তার উভয়পাশ লোহার বেস্টনিতে আবদ্ধ। সুতরাং, একটা জেব্রা ক্রসিং-এর আশায় আরও প্রায় আধা কিলোমিটার এগিয়ে গেলাম। কাঙ্খিত জেব্রা ক্রসিং না পেয়ে একটা পর্যায়ে ফিরতি পথে পা বাড়াতে বাধ্য হলাম। অর্থাৎ আবারও চৌরাস্তায় ফিরে তারপর একটা বিহিত করতে হবে।  

চৌরাস্তায় ফেরার আগেই সামান্য উঁচুতে ঘন ঘাসের অবরণে ঢাকা বেশ বড় মাঠ। মাঠের অপর প্রান্ত দিয়ে যেন একটা পথ এগিয়ে গিয়েছে। পথের উপর দিয়ে এক সারি ঘন ডালপালা সমৃদ্ধ গাছ। দূর থেকে দেখে মনে হলো আমগাছজুড়ে অজস্র কুশি পাতা গজিয়েছে। জনমানব শূন্য জায়গায় কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া যতটা কঠিন ঠিক ততটাই সহজ। রাস্তা পার হওয়ার জন্য জেব্রা ক্রসিং অপরিহার্য কিন্তু মাঠ পার হওয়ার জন্য নয়। সারা দুনিয়া না ঘুরে আড়াআড়ি মাঠ পেরিয়ে সাত্যিই একটা পথ পেয়ে গেলাম। তবে সারি সারি গাছগুলো আমগাছ নয়। 

এদিকে সূর্য ঠিক মাথার উপর। সুতরাং, নিজের ছায়া বলতে যা আছে তার পুরোটাই পায়ের তলে। শরীর থেকে ঘাম ঝরে পড়ছে অবিরাম। পানির মজুদ শেষ হয়ে গিয়েছে অনেক আগেই। পথটা সামান্য বাঁক নিয়ে উঠে গেল একটা টিলার দিকে। এক পাশে গাছের সারি, অপর পাশে জঙ্গল। বাঁকের পরে রাস্তা যখন সোজা হয়ে গেল তখন তার শেষ প্রান্তে দেখা দিলো সাদা তোরণ। তোরণেরও উপর দিয়ে পিছন থেকে মাথা তুলে দিয়েছে একটা স্থাপনার সরু চূড়া। নিকটবর্তী হতে হতে জঙ্গলের সামান্য ফাঁক দিয়ে দৃশ্যমান হলো সেই পথ, দিশকূল না পেয়ে খানিক আগে যে পথে কেবল হাঁটছিলাম আর হাঁটছিলাম। অথচ, ফাঁকটুকুর মাঝ দিয়ে চলে এলে অনেকটা আগেই ওয়ার মেমোরিয়ালে উপস্থিত হতে পারতাম! 

তোরণ পেরিয়ে একটা চত্বর এবং তার ডান পাশে সুবিশাল মাঠ। মাঠের মাঝে খয়েরি রঙরে একাকি একটা সমাধি। সেদিকে মনোনিবেশ না করে চত্বর পেরিয়ে মূল প্রবেশদ্বার হয়ে ঢুকে পড়লাম ভিতরে। প্রবেশের পরই একটা বেদি, যাতে খোদাই করে লেখা ‘তাদের নাম চিরজীবী হোক!’ দূর থেকে দেখতে পাওয়া চূড়া সংবলিত সৌধটি সমাধিক্ষেত্রের শেষ প্রান্তে এবং সর্বাপেক্ষা উঁচু জায়গায় অবস্থিত। সৌধ থেকে চতুর্দিকে ঈষৎ ঢালু প্রাঙ্গনে হাজার হাজার সমাধি। প্রতিটির মাথার কাছে একটা করে স্মৃতিফলক। পুরো জায়গাটাকে ভীষণ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করে রাখা। ময়লা আবর্জনা জাতীয় কোনো কিছু দূরের কথা ফুলের একটা পাপড়িও পড়ে নেই। 

এত বড় জায়গা কিন্তু মানুষ নেই, বিরাজ করছে শুনশান নীরবতা। এতটাই নীরর যে, ঘাসের উপর আমার প্রতিটি পদক্ষেপেও যেন কেঁপে ওঠার মতো শব্দ উৎপন্ন হলো। ছবি তুলতে সংকোচ বোধ করলাম, কি না কি অনিয়ম হয়ে যায়। তাছাড়া কারও অনুমতি না নিয়ে ছবি তুলিই-বা কী করে? এত সমাধির মাঝে নিজেকে সম্পূর্ণ একা কল্পনা করতে সামান্য ভয় ভয় অনুভব হলো। পরিবেশটাকে স্বাভাবিক করতে কয়েক বার চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হলাম। একটু এগিয়ে বামে দিকে গেলে অদূরেই দেখা মিললো তিনজন পরিচ্ছন্নকর্মীর, মুখ বন্ধ করে আগাছা বাছাই করছে। কাছে গিয়ে কথা বলতে চাইলে তারা আগ্রহী হলো। সবাই দক্ষিণ ইন্ডিয়ার নাগরিক। আলাপের পর মনে হলো তারা যেন বহুদিন পর কারও সঙ্গে কথা বললো। তথ্য বলতে যতটুকু সরবারাহ করতে পারল তা হলো, এখানে বিশ্বযুদ্ধে নিহতদের সমাহিত করা আছে। এর বেশি এক লাইনও নয়। (চলবে)