শিল্প ও সাহিত্য

‘তর্ক’ নিয়ে তর্ক হোক 

সাম্প্রতিক বিশ্বের দিকে একটু দৃষ্টি ঘোরালেই উপলব্ধি করা সম্ভব কেমন অস্থির সময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি আমরা। গলায় উৎকণ্ঠার কাঁটা নিয়ে বসে আছে মানুষ। শূন্য হাঁড়িতে আগামীকাল পাথর নাকি ভাত রান্না হবে, অনেকেই জানেন না। শিশুকে স্কুলে পৌঁছে দিতে গিয়ে হয়তো লাশ হয়ে ফিরতে হতে পারে। এমন এক নিরাপত্তাহীনতার অস্ত্র হাতে অদৃশ্য কেউ আমাদের ধাওয়া করছে। আর আমরা একবার হোঁচট খেয়ে, আরেকবার ডিগবাজি খেয়ে প্রাণপ্রণে দৌড়াচ্ছি।

একবিংশ শতাব্দীর মানুষের মহামারি দেখার অভিজ্ঞতা হলো বেশিদিন হয়নি। যুদ্ধ তো এখন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া, ইউক্রেন—অস্ত্র ও মৃত্যু থেমে নেই। চারদিকে বাজছে যুদ্ধের দামামা। ধ্বংসস্তূপের মাঝেও শোনা যাচ্ছে শিশুর জন্মকান্না। পৃথিবী যেন এক জেগে ওঠা চর। দখল-বেদখলের মাঝেও তার কোথাও ভাঙছে তো কোথাও গড়ছে।

পৃথিবীতে এখনো একদিনে যতটা অস্ত্র বানানো হয় তার চেয়ে ঢের বেশি লেখা হয় কবিতা। কেননা এখনো মানুষ বাঁচতে ভালোবাসে। হৃদয়ের কথা জানতে চায়। শোনে অন্যের কথা। আর শিল্প-সাহিত্য সেই জীবনবোধের কথা বলে। তেমন জীবনবোধের সন্ধান নিয়ে হাজির ‘তর্ক’। অস্থির সময়ে; পোড়া দেশে কেউ কেউ তো এখনো আছেন যারা ‘ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ান’। যারা প্রথাগত জীবন-দর্শন নিয়ে আলোচনা ও তর্ক করতে ভালোবাসেন। সেই ভালোবাসার ধন ‘তর্ক’। 

পৃথিবী যখন মহামারির করালগ্রাসে, মৃত্যুর মিছিলে যাচ্ছেন আমাদের আপন ভাই তখন ছোট পরিসরে সাহিত্য-শিল্প-দর্শন ওয়েবজিন ‘তর্ক বাংলা’র যাত্রা। চলতি বছর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে বৃহৎ পরিসরে ছাপা অক্ষরে এলো ‘তর্ক’। নামেই হয়তো এতক্ষণে বুঝে গেছেন, কাগজটার চরিত্র। ‘সামাঝদার লোগকে লিয়ে ইশারা হি কাফি হ্যায়!’ ‘তর্ক’ নিয়ে তর্ক-বিতর্কের সুযোগ থাকছেই। কারণ এর কন্টেন্ট। যাকে বলে প্রথম সংখ্যাতেই বাজিমাত। বড় আকর্ষণ—দেশ ও পরদেশ মিলিয়ে আটটি সাক্ষাৎকার। 

প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তর্ক পত্রিকার সম্পাদক সাখাওয়াত টিপু। অবশ্য বৃহদায়তনের এই সাক্ষাৎকার এখানেই শেষ নয়। ধারাবাহিকভাবে আরও কয়েক সংখ্যায় থাকছে। ‘দ্য নিউ এইজ’ পত্রিকার সম্পাদক নুরুল কবির, বরেণ্য নাট্যনির্দেশক ও পরিচালক সৈয়দ জামিল আহমেদ, আলোকচিত্রী শহিদুল আলম ও বুদ্ধিজীবী ও প্রাবন্ধিক সলিমুল্লাহ খানের সাক্ষাৎকার আলোচনা-তর্ক-বিতর্কের খোরাক যোগাবে পাঠকদের। প্রয়াত কথাসাহিত্যিক মাহমুদুল হকের অপ্রকাশিত সাক্ষাৎকারে তাঁর জীবন ও তাঁর সময়ের লেখকদের বিভিন্ন দিক উঠে এসেছে। 

আকবর আলি খানের ‘অভিভাষণ’ শেষে পাওয়া যাবে গুরুত্বপূর্ণ তিন প্রবন্ধ। রয়েছে জগদ্বিখ্যাত দুই দার্শনিক লুইস আলথুসার ও আলাঁ বাদিয়ুর দর্শন নিয়ে আলোচনা। হোর্হে লুইস বোর্হেস ও উইলিয়াম ফকনারের গল্প ছাড়াও দেশের বেশ কয়েকজন নামী গল্পকারও স্থান করে নিয়েছেন। কবিতার পাশাপাশি আছে সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনা। আরেক আকর্ষণ—বাংলাদেশের প্রথম আদিবাসী চিত্রশিল্পী চুনিলাল দেওয়ানের ‘প্রকৃতির মায়া’ নামের একক চিত্রপ্রদর্শনী। এই হলো সংক্ষিপ্ত সূচি। 

আমাদের দেশের শিল্প-সাহিত্য তো বটে অন্যক্ষেত্রের ছোটকাগজও বেশ অপ্রতুল। যে কয়েকটা এখনো প্রকাশিত হয় তার অধিকাংশ বইমেলাকেন্দ্রিক। সেখান থেকে ‘তর্ক’ এলো বৈশাখে। আশা করি, অনেক বছর ধরে পুরো উদ্যমে থাকবে ‘তর্ক’। প্রথম বর্ষের প্রথম সংখ্যায় নির্ভুল বানান ও ঝকঝকে প্রিন্টের জন্য সত্যিই প্রশংসা প্রাপ্য প্রকাশক, সম্পাদক ও তার সহযোগীদের।

কার্ল মার্ক্সের ভাষায় বললে, পুঁজিবাদী পৃথিবী এখন ডুবে আছে একাধিপত্য ও ‘কাল্পনিক চাহিদা’র মধ্যে। আমাদের কাছে এখন জ্ঞান অর্জনের চেয়ে অর্থের প্রাধান্য বেশি। যে গ্যাজেট দরকার নেই, তাকেও এখন ‘প্রয়োজনীয়’ হিসেবে সামনে নিয়ে আসছে আধিপত্য বিস্তারে নামা বহুজাতিক কোম্পানিগুলো। কিন্তু বই কেবল এখন নয়, যুগে যুগেও খুব কম মানুষের কাল্পনিক চাহিদা। তারপরও তো মাঝেসাঝে ‘বুদ্ধি গোড়ায়’ শান দিতে হয়। 

‘তর্ক’ বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনায় আগ্রহীদের সংগ্রহের তালিকায় থাকবে নিশ্চিত। আলোচনাও হোক সাহিত্যের নবাগত এই পত্রিকাকে নিয়ে।  সম্পাদক: সাখাওয়াত টিপু প্রকাশকাল: বৈশাখ ১৪২৯  প্রকাশক: মাহবুব লিটন প্রচ্ছদ: রাজীব দত্ত মূল্য: ৬০০ টাকা।