মতামত

বাজেটে গরিবের কিছু যায় আসে কি?

‘কোভিডের অভিঘাত পেরিয়ে উন্নয়নের ধারাবাহিকতায়’ শীর্ষক ২০২২-২৩ অর্থ বছরের ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বাজেট পেশ করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। প্রস্তাবিত বাজেটের ঘাটতির পরিমাণ ২ লাখ ৪৫ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। যা মেটানো হবে আভ্যন্তরীণ বৈদেশিক উৎস থেকে। নতুন অর্থ বছরের জন্য মোট রাজস্ব আয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে ৩ লাখ ৭০ কোটি টাকা। 

অর্থমন্ত্রীর মনে করেন, আগামী অর্থ বছরে মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৬ শতাংশ হবে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের মূল কৌশল হবে বিদ্যমান চাহিদার প্রবৃদ্ধি কমিয়ে সরবরাহ বাড়ানো।  সরকার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে অগ্রাধিকার দিয়ে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য বাজেটে বরাদ্দ সুচিন্তিতভাবে নির্ধারণ করেছে।

বাজেট কি কেবলই একটা রুটিন ওয়ার্ক? নানা তথ্য-উপাত্ত আর প্রতিশ্রুতির ঠাস বুনটে ভরা গালবুলি? পক্ষে-বিপক্ষে নানা যুক্তি তর্ক হাজির করার রঙ্গমঞ্চ? ক্ষমতাবলয়ের চৌহদ্দিতে থাকা ব্যক্তিদের আখের গোছানোর ফি-বছরের মওকা বিশেষ? বাজেট মানে কি কারও পৌষ মাস কারও সর্বনাশের সাপলুডু খেলা? 

নিশ্চয়ই না। এ রকম অলক্ষুণে কথা মুখে আনতে নেই, মুখ ফসকেও বলতে নেই, এতে গৃহস্থের অকল্যাণ হয়। সাধারণ মানুষ অর্থাৎ আমজনতা বাজেট বুঝেন না। বাজেট কী, বাজেট মানে কী—এসব কেতাবি কথা-বিশেষজ্ঞদের কায়কারবার তারা বুঝবেন কীভাবে? সুতরাং প্রত্যেক অর্থবছরের শুরুতে যে বাজেট পেশ ও পাস করা হয়, তাতে সাধারণ মানুষের কিছু যায় আসে কি এই প্রশ্নের উত্তর তালাশ করা দরকার।

আধুনিক সরকার ব্যবস্থায় প্রতি বছর বাজেট পেশ করা একটা স্বতঃসিদ্ধ রেওয়াজ। এ দেশেও স্বাধীনতার পর থেকে বাজেট পেশ করা হচ্ছে, আগামীতেও হবে। বাজেটের মধ্যে দিয়ে সরকার সারা বছরের সম্ভাব্য একটা চালচিত্র পেশ করে। বিশেষ করে অর্থনীতির হিসাব-নিকাশটা জানিয়ে দেওয়া হয়। অর্থ কোথা থেকে, কোন কোন খাত থেকে আসবে আর কোথায় কোথায় খরচ করা হবে তার খাতওয়ারি একটা ফিরিস্তি দেওয়া হলো বাজেটের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। এভাবেই বাজেট আসে বাজেট যায়। এবং এই আসা-যাওয়ার মধ্যে দিয়ে কিছু মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তনেও বাজেট আশ্চর্য চেরাগের ভূমিকা পালন করে। বাজেট কেবল তাদের জন্যই পোয়াবারো হয়ে দেখা দেয় যারা ক্ষমতা বলয়ের সঙ্গে যুক্ত থাকেন এবং ক্ষমতার চারপাশে জায়গা করে নেওয়ার মতো যেসব শ্রেণী-পেশার মানুষের ক্ষমতা আছে তারাই বাজেটের সুবিধাভোগী হন। তারাই জানেন-বোঝেন বাজেট কী, বাজেট মানে কী। 

বাজেটের সঙ্গে সাধারণ মানুষের সম্পর্ক একেবারে শূন্যের কোঠায়। কারণ বাজেটে যাই-ই থাক তার ভাগ্যের কোনো হেরফের হয় না। জীবন মানেই যন্ত্রণার যে আগুনে পুড়ে খাক হওয়া তার নিয়তি, সেখানে বাজেটের আগে-পরে কোনো পরিবর্তন দেখতে পায় না সাধারণ মানুষ। সেটা আগেও ঘটেছে, বর্তমানেও ঘটছে, বড়ো রকমের পরিবর্তন না হলে ভবিষ্যতেও ঘটবে বলে ধরে নেওয়া যায়। এ কারণে ক্ষমতা কাঠামোয় যারাই থাকুক বাজেট স্বার্থ দেখে কেবল উপরতলার মানুষের। বাজেটের কাঠামোটাই বোধকরি এমনভাবে বানানো যে, সে চোখে দেখে উপরতলার মানুষদেরই সবচেয়ে বেশি। নিচের দিকে তাকাতেই পারে না, জোর করে তাকাতে গেলে ঘাড়ে ব্যথা হয়। এবারের বাজেটও যে পূর্বতন ঐতিহ্য বজায় রেখেছে তা স্পষ্ট হয়েছে বাজেট পেশের দিনই। তার চোখ গেছে হেলিকপ্টারের দিকে। তাই হেলিকপ্টারের সুবিধা যারা ভোগ করবে তাদের যেন মোটেই কোনো কষ্ট পেতে না হয়, এ জন্য হেলিকপ্টারের জিনিসপত্রের দাম কমানো হয়েছে। এর চেয়ে গোত্রপ্রেম, শ্রেণীস্বার্থের নজির আর কিছুতে মিলবে কি?

বিপরীতে, বাজেট যে নিচের দিকে তাকাতেই পারে না তারও প্রমাণ মিলেছে। বাড়ানো হয়েছে ভোজ্যতেলের দাম; পুনরায় আরেক দফা! ভোজ্যতেলের দাম বাড়তে বাড়তে এমন অবস্থায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে যে, ভোজ্যতেলকে চুলার পাশ থেকে ঝেটিয়ে বিদায় করতে পারলেই স্বস্তি। সেই ভোজ্যতেলের দাম কমানো তো দূরের বাদ্যি, রীতিমতো বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বোঝার ওপর শাকের আঁটির ভার যে কতো কঠিন-কষ্টের ও দুঃসহ বেদনার, যারা বোঝা বহন করছেন তারাই বুঝবেন, অন্যদের কাছে বিষয়টা ‘জোকস’ বলে মনে হতে পারে। 

বাজেটে যে সাধারণ মানুষের কিছু যায় আসে না, সেটা বোঝার জন্য অর্থনীতিতে বিশেষ ডিগ্রীধারী হওয়ার দরকার নেই, বাজেট বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই। বাজেটের দিকে একটু মনোযোগ দিলেই বিষয়টা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার ও স্বচ্ছরূপে বোঝা যায়। অবশ্য গরিবের মুড়ির দিকে নেক নজর দেওয়া হয়েছে। সুতরাং, চাইলেই যে কেউ গরিবের পক্ষ থেকে আওয়াজ দেয়ার মতো সুযোগ পাবেন না। 

বাজেট নিয়ে ফি-বছর গরিবের সঙ্গে উপরতলার মানুষেরা রঙ্গতামাশা করে কেবল। এ কারণেই বলা, মুখ ফসকে নয়, সাহস নিয়েই সত্য বলা—বাজেটে গরিবের কিছুই যায় আসে না। কারণ এই বাজেট তার প্রতিদিনকার জীবনকে কোনোভাবেই প্রভাবিত করে না, ইতিবাচক আশাবাদের সুযোগ দেয় না। তার চালের দাম কমে না। নিত্যপণ্যের বাজারে আগুন নেভে না। তার প্রতিদিনের চাহিদার সঙ্গে যে পানি বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সম্পর্ক, সেগুলোর দাম কমানোর কোনো কথা নেই। 

উল্টো গ্যাসের দাম বেড়েছে। সুতরাং বাকী দুটোরও দাম বাড়লো বলে। এসব ব্যাপারে কোনো সুখবর নেই বাজেটে। ফলে স্বস্তির প্রত্যাশা নেই গরিবের ললাটে। গরিবকে এখানে-ওখানে যাতায়াতের জন্য, উৎপাদিত পণ্য বিক্রয়ের জন্য যে পরিবহণের দ্বারস্থ হতে হয় সেই পরিবহণ খরচ কমানোরও কোনো বার্তা নেই বাজেটে। জ্বালানি তেলের দাম কমানোর ব্যাপারে উল্লিখিত হয়নি কিছুই। হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে যে ফসল ফলায় কৃষক, যে পণ্য উৎপাদন করে, তা সংরক্ষণের জন্য কোনো আশার কথা নেই। বলা হয়নি ন্যায্য মূল্য নিশ্চিতের ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণের কথা। যে কৃষক বুকে পাথর বেঁধে সন্তানকে লেখাপড়া শেখাচ্ছে, সেই সন্তানের কর্মসংস্থানের চ্যালেঞ্জ গ্রহণের সক্ষমতার কথা নেই বাজেটে। সামাজিক নিরাপত্তাকে কীভাবে সাধারণ মানুষের জন্য, দুবেলা খাওয়া মানুষের পক্ষে কাজে লাগানো হবে সে ব্যাপারেও কোনো কথা নেই বাজেটে। ‘নিরাপত্তা’ শব্দটি যেন কেবলই কতিপয় মানুষের জন্য।

এই বাজেট যেসব জিনিসের দাম বেড়ে চলেছে, সেসবের ব্যাপারে কী পদক্ষেপ নেবে তার কোনো পূর্বাভাস কিংবা রোডম্যাপ কিছুই জানায়নি। গরিবের সিঙ্গারার আকৃতি যে আরো ছোট হয়ে গেল, সয়াবিনের দাম বাড়ায় তেল ছাড়া পরোটাও যে ছোট হয়ে গেল। চালের দাম বাড়ায় হোটেলের প্লেটে যে পাখির খাবারের মাপে ভাত দেওয়ার ট্রেন্ড চালু হয়ে গেল—এসব সমস্যা সমাধানের কোনো কথা নেই বাজেটে। এক মুড়িতে কি এসব সমস্যা যাবে, নাকি আদৌ যাওয়া সম্ভব কোনো দিন? 

তবে হ্যাঁ, বাজেটে রাজস্ব-প্রবৃদ্ধি-ঘাটতি-প্রাক্কলন ব্যয়ের মতো ভারি ভারি কথাগুলো রয়েছে। তবে তাদের সম্পর্ক বাজেটের সঙ্গে নয়, চাঁদের বুড়ির সঙ্গে। ওই বুড়ি আগেও চরকা কাটতো, এখনও কাটে। মানুষ চাঁদে গেল, তবুও গরিবের চাঁদের বুড়ির গল্প ফুরোল না। এ কারণেই বলা—বাজেটের গল্পটা বেশ বড়ো শোনালেও, সাধারণ মানুষের কাছে আজও পূর্ণিমার চাঁদ ঝলসানো রুটি হয়েই আছে। অথচ কবি সুকান্ত এ কথা বলেছিলেন পরাধীন স্বদেশে, যখন ক্ষমতার তখতে ছিল ব্রিটিশ বেনিয়া।

লেখক: সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও গবেষক