মতামত

নতুন প্রত্যাশা নিয়ে পৃথিবী নতুন পথে হাঁটবে

একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক শেষ হতে না-হতেই একের পর এক সংকট এসে হাজির হচ্ছে বিশ্ববাসীর সামনে। কোভিড-১৯ এর ভয়াবহ বিপর্যয় কাটিয়ে মানুষ যখন একটু একটু করে সোজা হয়ে দাঁড়াচ্ছিল, তখন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পৃথিবীর হিসাব-নিকাশ বদলে ফেলতে চাচ্ছে। আফ্রিকা মহাদেশ দুর্ভিক্ষে হাহাকার করছে, ইউরোপ পুঁজিবাদ টিকিয়ে রাখতে উন্মাদনার শেষ সীমানায় পৌঁছেছে, এশিয়ার একের পর এক দেশ রাজনৈতিক কারণে সর্বস্বান্ত হয়ে আত্মকলহে লিপ্ত। ওদিকে আমেরিকা তার মোড়লগিরি টিকিয়ে রাখতে পারবে কিনা তা নিয়ে দেখা দিয়েছে তীব্র সংশয়।

এই যখন সারা দুনিয়ার চিত্র, তখন হতাশায় ডুবে যাওয়াই মানুষের নিয়তি হয়ে উঠছে। কিন্তু আমার কাছে মনে হয় হতাশ হওয়ার কিছু নেই। কাজী নজরুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘ধ্বংস দেখে ভয় কেন তোর, প্রলয় নূতন সৃজন বেদন’। আমি বিদ্রোহী কবির কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বলতে চাই- চারদিকে ধ্বংসলীলা শুরু হয়েছে মানে-  নতুন কিছু সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। মানুষের সমাজ যখন স্থবির হয়ে যায়, এক রৈখিক শাসনে জীবন যখন একঘেয়ে হয়ে ওঠে তখন নতুন উদ্যমে জেগে ওঠে মানুষ। নতুন স্বপ্নে, নতুন পথে হাঁটতে থাকে সে, পৃথিবী এখন নতুন পথে হাঁটছে। এই নতুন পথে আজ আমাদেরও হাঁটা অভ্যাস করতে হবে। প্রাচীন প্রথা, প্রাচীন দুঃশাসনের শিকল ছিঁড়ে আমাদের যেতে হবে মুক্তির পথে। যে পথে গেলে নিরন্ন মানুষ অন্ন পাবে, আশ্রয়হীন মানুষ আশ্রয় পাবে, কর্মঠ মানুষ পাবে কাঙ্ক্ষিত কাজ- সে পথের আহ্বান যদি আসে আমি মনে করি সেই আহ্বানে আমাদের সাড়া দিতে হবে। বিশ্বকে নিঃস্ব করে যারা পুঁজির পাহাড় গড়েছে, সময় এসেছে সেই পুঁজির সুষম বন্টন করে সব মানুষের মাঝে ভাগ করে দেওয়ার।

সম্পদলোভীরা সহজেই সম্পদের মালিকানা ছাড়তে চায় না। তাদের মালিকানা জোর করে কেড়ে নিতে হবে। জোর করেই আঁধারের বুক চিরে আলোর ভোর ছিনিয়ে আনতে হবে। আজ পৃথিবীর সর্বত্রই হাহাকার আর মৃত্যুর আতঙ্ক বিরাজ করছে। আধুনিক সভ্য মানুষ কখনোই এমন আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাতে চায় নি, কিন্তু আতঙ্ক আর হাতের মুঠোয় জীবন নিয়ে স্বদেশ ছেড়ে অন্য দেশে শরণার্থী হওয়াই যেন আজকের পৃথিবীতে নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই পৃথিবীতে গুটিকয়েক ধনলোভী মানুষ পৃথিবীকে তাদের হাতের পুতুল বানিয়ে ফেলতে চাচ্ছে। শ্রমিকের শ্রম, কৃষকের কষ্টে উৎপাদিত ফসল, মেহনতি মানুষের মেহনত আজ মুনাফাখোরেরা লুটপাট করে খাচ্ছে। তাদের অসীম ক্ষুধার শিকার হয়ে সবকিছু ওই সর্বগ্রাসী দানবদের পেটের ভেতর চলে যাচ্ছে। সেই প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করতেই বিশ্বজুড়ে শান্তিকামী মানুষ জোটবদ্ধ হয়ে সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। 

তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আজ কোনো কিছুই নির্ভুলভাবে বলা সম্ভব নয়। ক্ষমতাবান আমেরিকা তার ক্ষমতা হারানোর আগে মরণ কামড় দেবে এতে কোনো সংশয় নেই, তবে তাকে কিভাবে মোকাবিলা করা হবে, সেই কৌশল আবিষ্কার করাই এখন প্রধান কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আমেরিকা মূলত একটি শোষক দেশ। এই দেশের মূল উদ্দেশ্য পৃথিবীর সর্বত্র শোষণ জারি রেখে নিজের দেশের সম্পদ বৃদ্ধি করা। সব দেশের অস্ত্র উৎপাদন বন্ধ করে নিজের দেশে অস্ত্র উৎপাদন  ও বিক্রি অব্যাহত রাখা। এশিয়ার বেশ কিছু দেশ যেমন ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া, মিশর আমেরিকা কূটচাল দিয়ে ধ্বংস করে দিয়েছে। এশিয়ায় লুণ্ঠন করার মতো তার আর তেমন কিছু নেই। এখন সে নজর দিয়েছে ইউরোপের উন্নত দেশগুলোর দিকে। ইউরোপকে ধোকা দিয়ে বোকা বানিয়ে ন্যাটো নামের যুদ্ধবাজ জোটের দোহাই দিয়ে অর্থ উপার্জনের নতুন কৌশল এঁটেছে আমেরিকা। ন্যাটো’র মতো সামরিক জোটের খরচ বহন করতে ইউরোপের অনেক দেশ অনাগ্রহী হয়ে পড়েছে। এই মুহূর্তে ন্যাটো’র ক্ষমতা হ্রাস করা হলে আমেরিকা অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়বে। তার মোড়লগিরি প্রশ্নের সম্মুখীন হবে। আমেরিকা ন্যাটোকে টিকিয়ে রাখতে মরিয়া হয়ে পড়েছে। 

সম্প্রতি রাশিয়ার প্রতিবেশী দেশ ইউক্রেনকে ন্যাটোভুক্ত করতে গিয়ে আমেরিকা নতুনভাবে ইউরোপে যুদ্ধ বাঁধানোর কৌশল নিয়েছে। আমেরিকা জানে রাশিয়ার পার্শ্ববর্তী দেশ ন্যাটোভুক্ত হলে রাশিয়া প্রতিরোধ গড়ে তুলবে, সেই সুযোগে ইউরোপের সব দেশকে চাপ প্রয়োগ করে আমেরিকা অস্ত্র বিক্রি করে তার ভঙ্গুর অর্থনীতি চাঙ্গা করতে পারবে। ইতোমধ্যে আমরা দেখেছি ইউরোপের অনেক দেশ ইউক্রেনকে সাহায্য করার জন্য আমেরিকার কাছ থেকে অস্ত্র কিনতে বাধ্য হয়েছে।

আমেরিকা তার অস্ত্র বিক্রি অব্যাহত রাখতে পারলে নিশ্চয়ই তার অর্থনীতি চাঙ্গা হবে। কিন্তু রাশিয়ার হুমকির কারণে অনেক দেশ এখন দোটানায় পড়ে গেছে। ইউক্রেনকে সামরিক শক্তি দিয়ে কোনো দেশ সহযোগিতা করলে তাকে কঠোর শাস্তি দেওয়া হবে বলে রাশিয়ার ঘোষণার পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ভিন্ন দিকে মোড় নেয়। এউ যুদ্ধে রাশিয়ার বিজয় হবে। পরাজিত হবে আমেরিকার কূটকৌশল ও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির অকারণ দম্ভ।

আমেরিকা, পেন্টাগন, সিআইএ ও ন্যাটো আস্তে আস্তে দুর্বল হয়ে পড়ছে রাশিয়ার কাছে। নানামুখী নিষেধাজ্ঞা জারি করেও রাশিয়াকে কাবু করতে পারছে না আমেরিকা। কথায় কথায় কোনো দেশকে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে সেই দেশকে একঘরে করা আমেরিকার পুরাতন স্বভাব। অতীতে তাদের খামখেয়ালি নিষেধাজ্ঞার শিকার হয়ে পৃথিবীর অনেক দেশ সর্বস্বান্ত হয়ে গেছে। আমেরিকা চেয়েছিল ইউরোপকে সঙ্গে নিয়ে যদি রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করা যায়, তাহলে রাশিয়া দুর্বল হয়ে পড়বে- সারা বিশ্বে আমেরিকা আবার দাপটের সঙ্গে শোষণ-পীড়ন চালিয়ে নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র বজায় রাখতে পারবে। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে আমেরিকা সবচেয়ে বিব্রতকর পরিস্থির মুখোমুখি হয়েছে। তার অস্থির আচরণ ও লজ্জিত মুখ দেখে আজ আর কারো বুঝতে বাকি নেই ক্ষমতা ও দম্ভ দেখানোর দিন শেষ হয়ে আসছে আমেরিকার। 

পৃথিবী একটি মানবিক বিশ্ব ব্যবস্থা ও আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট প্রত্যাশা করছে। পুঁজিবাদী কাঠামো ভেঙে ফেলে সম্পদের সুষমবণ্টন প্রত্যাশা করছে শোষিত মানুষের দল। অস্ত্র ব্যবসা বন্ধ করে মানব কল্যাণের জন্য নতুন নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবি হয়ে উঠেছে। আজকের পৃথিবীতে খাদ্য সংকট, জলবায়ুর বৈরী আচরণসহ অনেক প্রাকৃতিক দুর্যোগ মানুষের জীবন বিষিয়ে দিচ্ছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের পাশাপাশি মানবসৃষ্ট কৃত্রিম দুর্যোগ মানুষকে আরো বিপর্যস্ত করে তুলেছে। আজ মানুষকে খাদ্য উৎপাদনের দিকে মনোযোগ দেওয়া দরকার, পরিবেশের ভারসাম্য যাতে বজায় থাকে সে বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করা দরকার। বিশ্বের ধনী ও ক্ষমতাবান দেশগুলো যদি মানবকল্যাণের পথে না হেঁটে মানববিধ্বসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকে, তাহলে মানুষের কোনো সান্ত্বনা থাকবে না। 

পৃথিবীর দেশে দেশে যুদ্ধবিরোধী ও শোষণ-নিপীড়নবিরোধী মনোভাব শক্তিশালী হচ্ছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে পৃথিবীতে একটি সুপরিবর্তন দেখা যাবে বলে আশা করার অনেক কারণ আছে। আজ একটি জোটের বিকল্প হিসেবে আরেকটি পাল্টা জোট গঠিত হচ্ছে। এক মেরু বিশ্ব থেকে সরে গিয়ে মানুষ এখন দুই মেরুর বিশ্বে বসবাস করতে আগ্রহী হচ্ছে। বিশ্বের অনেক দেশই এখন প্রকাশ্যে আমেরিকার বিরুদ্ধে কথা বলার স্পর্ধা দেখাচ্ছে। আমেরিকার ঘনিষ্ঠ বন্ধুরাষ্ট্রগুলোও আজ আর তার নিয়ন্ত্রণে নেই। কোনো ভয়-ভীতি আরোপ করেই আমেরিকা কোনো সুবিধা করতে পারছে না। 

এই মুহূর্তে দ্বিধা বিভক্ত হয়ে পড়ছে পুরো পৃথিবী। গভীর সংকটের ভেতর দিয়ে এখন বিশ্ববাসী সন্মুখে ধাবমান, সেই সংকট অচিরেই কেটে যাবে এমন আশা আমি করি না। তবে একটি নতুন আশা বুকে লালন করছি, সেটা হলো- অনেক রক্ত, অনেক মৃত্যু, অনেক শক্তি ক্ষয়ের পর আমাদের এই পৃথিবী নতুন পথে হাঁটবে, সেই পথ হবে কল্যাণের পথ, মানব মুক্তির পথ। সে পথে হাঁটতে গিয়ে সাহস হারানোর যাবে না- নতুন উদ্যমে নতুন স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে নতুন দিনকে অভ্যর্থনা জানাতে।                                       

১৪ জুন, ২০২২ লেখক: রাজনীতিবিদ, লেখক, কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক, গীতিকার ও মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ