দেহঘড়ি

ডায়াবেটিক ফুট: সচেতন নাহলে কাটা পড়বে পা!

ডায়াবেটিস ও সেই রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখার উপায় নিয়ে সচেতনতা অল্পবিস্তর সবারই জানা আছে। কিন্তু ডায়াবেটিসের কারণে আপনার শরীরে ধীরে ধীরে বহু সমস্যার সৃষ্টি হয়। এসব নিয়ে অনেকেরই তেমন সম্যক ধারণা নেই। 

ডায়াবেটিসের অনেকগুলো জটিলতার মধ্যে একটি মারাত্মক জটিলতা হলো, পেরিফেরাল নিউরোপ্যাথি বা ডায়াবেটিক ফুট। এর ফলে পায়ে অসাড়তা, ঝিনঝিনানি ও ব্যথা হয় অথবা অনুভূতি হারিয়ে যায়। পায়ে রক্ত চলাচল কমে যায় বলে ক্ষত শুকাতে দেরি হয়। পা ও পায়ের আঙুলের আকৃতিতে পরিবর্তনও হতে পারে।

দ্য ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটি ওয়েক্সনার মেডিক্যাল সেন্টারের পোডিয়াট্রিস্ট কেভিন স্প্রিঞ্জার বলেন, ‘ডায়াবেটিক ফুট একটি ভয়াবহ সমস্যায় রূপ নিতে পারে। এটি পায়ের ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে যাওয়ার হার বাড়ায়, ব্যথায় ভোগায় এবং জীবনের মান কমিয়ে দেয়।’

ডায়াবেটিক ফুটের অবস্থা স্থিতিশীল নয়। সময় পরিক্রমায় আরো খারাপের দিকে যায় এবং একসময় পা কেটে ফেলার প্রয়োজন হতে পারে।তবে শুরু থেকে সচেতন জীবনযাপন করলে পা কেটে ফেলার মতো গুরুতর পরিস্থিতি এড়ানো সম্ভব হবে। ডায়াবেটিস রোগীদের পায়ের সুরক্ষায় ডায়াবেটিক ফুটের উপসর্গসমূহ জানা থাকতে হবে এবং যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসা করতে হবে।

ডায়াবেটিক ফুটের কারণ

ডায়াবেটিস রোগীদের ঠিক কি কারণে ডায়াবেটিক ফুট হয় তা সম্পর্কে সম্পূর্ণ জানা যায়নি। গবেষকরা প্রকৃত কারণ অনুসন্ধানে কাজ করে যাচ্ছেন। তবে কিছু ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়ের দিকে অভিযোগের তীর ছোঁড়া গেছে।

ডায়াবেটিক ফুটের অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ বিষয় হলো- উচ্চ রক্ত শর্করা। এটা হলো অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের প্রধান উপসর্গ। এটা সংবহন সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে, কারণ রক্তনালিতে প্রদাহ হয় ও ধমনী সরু হয়ে যায়। শরীরের অন্যান্য অংশের তুলনায় পায়ের রক্ত চলাচল সহজেই কমে যেতে পারে, অর্থাৎ পায়ের ধমনীতে সংবহন সমস্যার ঝুঁকি বেশি।

আমেরিকান ডায়াবেটিস অ্যাসোসিয়েশনের নর্থইস্ট লিডারশিপ বোর্ডের মেম্বার ডা. ডেভিড আলপার বলেন, ‘ডায়াবেটিক ফুট নিয়ে পায়ে ক্ষত হলে তা ধীরে ধীরে শুকায়, কারণ নিরাময়ের জন্য টিস্যু পর্যাপ্ত রক্তপ্রবাহ পায় না।’ এই ক্ষতে সংক্রমণ হয়ে ডায়াবেটিক আলসারের মতো মারাত্মক জটিলতা তৈরি হতে পারে। ডায়াবেটিক আলসার হলো পা কেটে ফেলার একটি প্রধান কারণ।

একই সময়ে ডায়াবেটিস স্নায়ুও ধ্বংস করতে পারে। এটাকে নিউরোপ্যাথি বলে। এটা পায়েই বেশি ঘটে। ডা. আলপার বলেন, ‘নিউরোপ্যাথি পায়ে চাপ বা ব্যথার অনুভূতি কমিয়ে ফেলে, এর ফলে অগোচরে ক্ষতের অবনতি হতে থাকে। এটা এমন সংক্রমণ ও জটিলতার দিকে নিয়ে যায়, যেখানে পা কাটার প্রয়োজন পড়তে পারে।’

সকল ডায়াবেটিস রোগীর পায়ে ডায়াবেটিক ফুট হতে পারে, তবে এসব মানুষদের ঝুঁকি বেশি-

* যারা রক্ত শর্করা নিয়ন্ত্রণে সচেতন নন অথবা উচ্চ এ১সি আছে।

* যাদের বয়স ৪০ এর বেশি।

* যাদের শরীরের ওজন বেশি।

* যাদের উচ্চ রক্তচাপ বা উচ্চ কোলেস্টেরল রয়েছে।

* যাদের ভাস্কুলার ডিজিজের ঝুঁকিপূর্ণ বিষয় রয়েছে, যেমন- ধূমপান, করোনারি আর্টারি ডিজিজ ও স্ট্রোকের ইতিহাস।

ডায়াবেটিক ফুটের লক্ষণ ও উপসর্গ

পায়ের সুরক্ষায় ডায়াবেটিক ফুটের প্রাথমিক লক্ষণ শনাক্ত করা গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু এটা কঠিন হতে পারে। ডা. স্প্রিঞ্জার বলেন, ‘ডায়াবেটিক ফুটের প্রাথমিক সতর্ককারী লক্ষণ অস্পষ্ট হতে পারে অথবা অলক্ষ্যে থেকে যেতে পারে। কারণ লক্ষণগুলো সূক্ষ্ম অথবা স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলে অনুভূত হয় না।’

ডা. স্প্রিঞ্জারের মতে, ডায়াবেটিক ফুটের উপসর্গসমূহ রাতে বেশি লক্ষ্য করা যেতে পারে। সাধারণত দুই পায়েই উপসর্গ উপস্থিত হয়।ডায়াবেটিক ফুটের উল্লেখযোগ্য উপসর্গ হলো- পায়ের তলা খুবই শুকিয়ে ফাটল তৈরি হওয়া, পায়ে ঝিনঝিন করা বা সূঁচালো যন্ত্রণা হওয়া, পায়ের তলার অংশবিশেষ শক্ত হয়ে যাওয়া, পায়ের আঙুল অবশ হওয়া বা পা নড়াচড়ার অনুভূতি না পাওয়া, পায়ের হাড়ের অংশের ত্বক লাল হওয়া ও পায়ে জ্বালাপোড়া করা।

ডায়াবেটিক ফুটের লক্ষণ ও উপসর্গকে নিরীহ মনে হলেও চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলা উচিত। ডা. আলপার বলেন, ‘ডায়াবেটিক ফুটের প্রাথমিক অবস্থায় চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চললে জটিলতা এড়ানো সম্ভব হবে অথবা উপসর্গের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকবে।’ ডায়াবেটিক ফুটের চিকিৎসা না করলে আরো তীব্র উপসর্গ লক্ষ্য করতে পারেন- পায়ের নখের পুরুত্ব বেড়ে যাওয়া ও হলুদ বর্ণ ধারণ করা, গরম বা ঠান্ডা তাপমাত্রার প্রতি পায়ের সংবেদনশীলতা হারানো, শরীরচর্চার সময় পায়ে পেশি সংকোচন জনিত ব্যথা, ত্বকের বর্ণ বা তাপমাত্রায় পরিবর্তন, পায়ের আঙুলের ফাঁকে ছত্রাক সংক্রমণ ও পায়ের ফোসকা-কাটাছেঁড়া-ক্ষত কিছুদিনে সেরে না ওঠা।

ডায়াবেটিক ফুটের চিকিৎসা

ডায়াবেটিক ফুটের উপসর্গ থাকলে চিকিৎসকের সান্নিধ্য দরকার হতে পারে। এ প্রসঙ্গে ডা. স্প্রিঞ্জার বলেন, ‘ডায়াবেটিক ফুটের চিকিৎসার উদ্দেশ্য হলো ব্যথা কমানো, অবনতি ধীর করা এবং জটিলতার ঝুঁকি কমানো।’

ডায়াবেটিক ফুটের সবচেয়ে তীব্র জটিলতা হলো উন্মুক্ত ক্ষত হওয়া, যাকে ডায়াবেটিক ফুট আলসার বলা হয়। এটা সংক্রমণ প্রবণ। চিকিৎসকদের মতে, সময়মতো চিকিৎসা করালে ডায়াবেটিসজনিত পায়ের ঘা নিয়ন্ত্রতযোগ্য। অর্থাৎ সময়মতো সঠিক চিকিৎসা নিলে পা না কেটে চিকিৎসা দিয়ে রক্ষা করা যায়। অনেক সময় হয়তো একটা আঙুল কেটে ফেলতে হয় অথবা সব আঙুল কেটে ফেলতে হয়। এতে পা রক্ষা করা সম্ভব হলে রোগী হাঁটতে পারে। কিন্তু বিলম্বের কারণে ঘা বিস্তৃতি লাভ করে অনেক সময় হাঁটু পর্যন্ত উঠে যায়। তখন হাঁটুর ওপর থেকে পা কেটে ফেলে দিতে হয় রোগীকে বাঁচানোর জন্য।

তীব্র ডায়াবেটিক ফুটের চূড়ান্ত পরিণতিতে পা কেটে ফেলতে হয়, কিন্তু সচেতন জীবনযাপনে এটা এড়ানো যেতে পারে।

ডায়াবেটিক ফুট প্রতিরোধে করণীয়

ডা. স্প্রিঞ্জার বলেন, ‘ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি এড়ানোর সর্বোত্তম উপায় হলো- রক্ত শর্করা নিয়ন্ত্রণ করা। যদি এড়ানো না যায়, অন্তত বিলম্বিত করা যাবে।’ ডায়াবেটিক ফুট প্রতিরোধের জন্য ডায়াবেটিস ম্যানেজমেন্টের বেসিক অনুসরণ করতে হবে-

* ধূমপান কমাতে হবে, কারণ ধূমপান পায়ে রক্ত প্রবাহ কমিয়ে ফেলে।

* বেশি করে ফল ও শাকসবজি খেতে হবে, অপরদিকে লবণ ও চিনি কমাতে হবে

* প্রতিদিন শরীরচর্চা করতে হবে, এমনকি ১০ মিনিট হাঁটলেও ঝুঁকি কমে।

ডায়াবেটিস রোগীদের প্রতিদিনই পায়ের যত্ন নেয়া উচিত, যেমন-

* পা ধোয়ার পর ভালোভাবে শুকাতে হবে, এমনকি আঙুলের ফাঁকও।

* পায়ে ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করতে হবে, কিন্তু আঙুলের ফাঁকে নয়।

* পায়ের নখ সোজা বরাবর কেটে ছোট রাখতে হবে।

* আর্দ্রতা শোষণকারী মোজা পরতে হবে ও জুতা পায়ে দেওয়ার সময় বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে, যাতে পায়ে কোনো খোঁচা না লাগে, কোনো ক্ষত যেন তৈরি না হয়।

* পায়ে কাটাছেঁড়া, ফোসকা, লাল দাগ ও অন্যান্য লক্ষণ আছে কিনা নিয়মিত চেক করতে হবে।

* সবসময় মোজা পরতে হবে, এমনকি ঘরেও।

* বসার সময় পা-কে উঁচুতে রাখতে হবে এবং রক্তপ্রবাহ বাড়াতে পায়ের আঙুল নাড়াতে হবে।

* অপ্রয়োজনে পা ভেজানো হতে বিরত থাকতে হবে।