শিল্প ও সাহিত্য

বাংলাদেশের বর্ষা উৎসব 

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রকৃত বৈশিষ্ট্য নিহিত রয়েছে আমাদের দেশের ঋতু-বৈচিত্র্যের মধ্যে। তবে বর্ষা ঋতু যেন প্রকৃতির অনির্বচনীয় প্রকাশ। তাই বসন্তকে ‘ঋতুরাজ’ বলা হলেও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য বর্ষাই হলো ‘বাংলার প্রিয় ঋতু’। 

একথা সত্যি যে, প্রকৃতি ও মানুষের জীবনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের মধ্যেই একটি দেশের প্রকৃত সৌন্দর্য ফুটে ওঠে। প্রকৃতির বিচিত্র সৌন্দর্য আমাদের মনে গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করে সেকথা বলাবাহুল্য। বিশেষ করে বর্ষা ঋতু আমাদের মন সহজ, সরল আর সৃষ্টিশীল করে। মন হয়ে ওঠে উদাস। বর্ষা আমাদের মনভূমিকেও করেছে সরস আর কাব্যময়। অর্থনৈতিক জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য বিস্তারের পাশাপাশি বর্ষা বাঙালির সাংস্কৃতিক জীবনেও ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে।

বর্ষায় হিমালয়ের বরফ-গলা জল বর্ষার জলের সঙ্গে মিশে এ দেশের নদ-নদীর খরস্রোত বৃদ্ধি করে। ভাসমান পলি কৃষকের কৃষিতে ভাগ্যলক্ষ্মীর আশীর্বাদ হিসেবে সবুজ বিপ্লবের আশার বাণী শুনিয়ে যায়। শুধু বর্ষার কারণেই আমাদের এই বাংলাদেশ সুজলা, সুফলা, শস্য-শ্যামলা হয়ে উঠেছে। 

প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের মনের এক নিবিড় সম্পর্ক আছে। আর বৃষ্টির সঙ্গে মিশে আছে আনন্দ, আছে বিরহ। রোদ আর বৃষ্টি যেন ভিন্ন ভিন্ন অনুভব ও আলোড়ন তৈরি করে মানুষের মনে। আকাশে ভেসে বেড়ানো মেঘমালা মানুষকে নিয়ে যায় অজানার কোনো রঙিন দেশে। বর্ষা যে কেবল আনন্দ আর সুখের বারতা বয়ে নিয়ে আসে, কেবল যে সে সুন্দরের প্রতীক, তা কিন্তুও নয়। অতিবর্ষণে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়। ঘরবাড়ি ঢলে পড়ে। বিপন্ন হয় মানবতা। ব্যবসা-পাতি, চাকরি-বাকরিরও বারোটা বেজে যায়। ভেসে যায় ফসলের ক্ষেত, গবাদিপশু। বন্ধ হয়ে যায় স্কুল-কলেজ; বাইরে যাওয়া। বন্যা তার ভয়ঙ্কর রূপ নিয়ে হানা দেয় আমাদের শান্ত স্নিগ্ধ সংসারে। 

তারপরও বর্ষার একটা মাদকতা আছে। প্রাণে যেন নেশা ধরিয়ে দেয় খানিকটা। প্রবল খরায় তেতিয়ে থাকা মন যেন বৃষ্টির অপেক্ষায় প্রহর গোণে। গ্রামে গ্রামে চলে বৃষ্টির গান। বাড়ি বাড়ি গিয়ে উঠানে নেচে-গেয়ে ঝি-বউদের নিয়ে আনন্দ করে কিশোরী-তরুণীরা। চাল-ডালও সংগ্রহ করে তারা। গৃহস্থরা উঠানে ছিটায় সরিষার দানা। সবাই প্রার্থনা করে বৃষ্টি-খরার দাবদাহ থেকে বাঁচবার জন্য। বৃষ্টির আকাঙ্ক্ষায় গেয়ে ওঠা গান আমাদের কানে ভেসে আসে: ‘আয় বৃষ্টি ঝেঁপে ধান দেবো মেপে...’।

বৃষ্টির দিনে ঘরে ঘরে রান্না হয় খিচুড়ি। বৃষ্টির দিনে খিচুড়ি যে অমৃত! আর যদি সঙ্গে থাকে ইলিশ ভাজা তাহলে তো কথাই নেই। বৃষ্টির দিনে অলস প্রহরে বসে বসে গল্প করা, দিনমান তাস খেলে সময় কাটানো আর চুপি চুপি প্রেম করার আনন্দ- সে কি বলে প্রকাশ করার মতো!

বর্ষা এলে প্রকৃতি সাজে নতুন সাজে। তৃষিত হৃদয়ে, পুষ্পে-বৃক্ষে, পত্র-পল্লবে নতুন প্রাণের সঞ্চার করে। নূপুর পায়ে ঝুমুর ঝুমুর তালে ঝরে পড়া অঝোর ধারার বৃষ্টিতে ভিজতে থাকে উন্মুখ-অধীর প্রকৃতি। বৃষ্টির ধারায় উপছে পড়ে বাংলার ডোবা-নালা-মাঠ-ঘাট-পুকুর-বিল-হাওর। ঝরঝর নির্ঝরণীতে মানুষের মনকে যুগপৎ আনন্দ-বেদনা ও বিরহকাতরতায় সিক্ত করে তুলে বর্ষা। এই টাপুর টুপুর বৃষ্টিতেই ধুয়ে মুছে পরিষ্কার হয়ে যায় সব কিছু। তখন ভেজা মাটির গন্ধে মন যেন কেমন করে ওঠে। বড় আপন মনে হয় মা ও মাটিকে।

এই অবিরাম বৃষ্টিপাতেই স্ফীত হয় বর্ষার জলধারা। নদীরা ফিরে পায় হারানো যৌবন। ডুবে ডায় মাঠ-ঘাট, বাড়িঘর, প্রান্তর। সবুজ রঙ মেখে লাবণ্যময় হয়ে ওঠে রূপসী বাংলা। আউশ-পাটে ভরে ওঠে ফসলের মাঠ। ফুলে ফুলে শোভিত হয় কদম-কামিনী-কেয়া, জুঁই-টগর-মালতী-রজনীগন্ধা। 

বর্ষার অথৈ জলসম্ভার আর সুখ-দুঃখের দোলাচলের পরও কিন্তু থেমে থাকে না আনন্দ-উৎসব। এই মৌসুমেই অনুষ্ঠিত হয় বিভিন্ন ধর্মের নানা আনন্দ-পার্বণ। বিনোদনের লোকক্রীড়া হিসেবে অনুষ্ঠিত হয় নৌকাবাইচ, হা-ডু-ডু খেলা। ঘনঘোর বর্ষায় মন হোক মেঘের সঙ্গী। বৃষ্টির মূল ঘটনার বর্ণনা এমনিতে বেশ সহজ-সরল বলে মনে হলেও বাস্তবে কিন্তু তা বেশ জটিল। বিশেষ করে আমাদের মতো দেশে যেখানে বর্ষার সঙ্গে উৎপাদনের বিষয়টি অনেকখানি জড়িত। আষাঢ়ে যে প্রতীক্ষা দীর্ঘশ্বাস, তাকে দেখি শ্রাবণ বাতাস হয়ে ছুটে বেড়াতে। বর্ষা আমাদের প্রতীক্ষার উদযাপন। সবুজে-ধূসরে বোনা বিরল এক সংগীত।  

ঋতুবৈচিত্র্যের দেশ আমাদের এই বাংলাদেশ। বর্ষা বাংলার দ্বিতীয় ঋতু। এই ঋতুর উৎসবের ভেতর দিয়েই এদেশের বৈচিত্র্যময় ধর্ম-সাংস্কৃতিক পরিচয় মেলে। সেইসাথে শ্রমজীবী মানুষের কর্মহীন হয়ে পড়া জীবনের মাঝে নির্মল আনন্দযাপন দেখা যায় নানান গীতি-বাদ্যের সুরে। বর্ষা ঋতুর প্রথম দিন থেকে অর্থাৎ আষাঢ় মাসের প্রথম দিন থেকেই আমাদের গ্রাম-গঞ্জ ও শহরে বিচিত্র ধরনের ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক উৎসব শুরু হয়ে শেষ হয় শ্রাবণের শেষ দিনে। তারই কিছু চিত্র এখানে তুলে ধরা হলো। 

বৃষ্টির দিনে বাংলাদেশের গ্রামগুলো যখন জলে ডুবে থাকে তখন গ্রামের তরুণ-যুবকের দল ক্রীড়া বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে বেছে নেয় এই খেলা। এর জন্য কোনো বড় জায়গার দরকার পড়ে না। এই খেলাতে একাধারে শক্তি এবং সাহস দুটোরই দরকার হয়। কোনো কোনো এলাকায় বা অঞ্চলে হাডুডু খেলায় নানা ধরনের ছন্দ ব্যবহৃত হয়।  আমাদের দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাহিত্য-সংস্কৃতি এবং খেলাধুলায় নদ-নদীর উপস্থিতি প্রবলভাবে লক্ষ্য করা যায়। আর নৌকা বাইচ হলো আমাদের লোকালয় আর সংস্কৃতির একটি গর্বিত ফসল। একদল মাঝি নিয়ে গঠিত একাধিক পক্ষের মধ্যে নৌকা চালানোর প্রতিযোগিতাই হচ্ছে নৌকা বাইচ। সাধারণত নৌকার দাঁড় টানার কসরত এবং নৌকা চালানোর কৌশল দিয়ে জয়লাভের উদ্দেশ্যে এই বাইচ অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। আমাদের দেশের বিভিন্ন জেলায় বাইচের নৌকার বিভিন্ন ধরনের বৈশিষ্ট্য দেখতে পাওয়া যায়।

আষাঢ় মাসের নাগপঞ্চমী তিথিতে সাপের দেবী মনসার পূজা অনুষ্ঠিত হয়। এই পূজার মাধ্যমে ভক্তরা সাপের ভয় থেকে মুক্তি লাভ করে থাকে। নানা সময়ে মনসার অনেক উপাখ্যান রচিত হয়েছে।  যেমন: বেহুলা-লখিন্দর, মনসামঙ্গল কাব্য ইত্যাদি। 

জগন্নাথ দেবের স্মরণে ভারতের পুরীসহ আমাদের দেশের বিভিন্ন স্থানে আষাঢ় মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতে জগন্নাথ, তাঁর ভাই বলরাম এবং বোন সুভদ্রার মূর্তি স্থাপন করে শত শত ভক্ত রথযাত্রা শুরু করেন। আর একাদশী তিথিতে প্রত্যাবর্তন করেন। অর্থাৎ রথটি প্রথম দিন যেখান থেকে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়, আটদিন পরে আবার সেখানে এনেই রাখা হয়। একই বলে উল্টোরথ। আমাদের দেশে অনেক আগে থেকেই রথযাত্রার অনুষ্ঠান ও মেলা হয়ে আসছে। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রথযাত্রার উৎসবটি হয় ধামরাইয়ের জগন্নাথ মন্দিরে এবং সবচেয়ে বড় রথের মেলাটিও বসে এখানে। 

এটি মূলত বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের একটি উৎসব। এর আয়োজন অনেকটা দোলযাত্রা বা হোলির মতো। শ্রাবণ মাসের শুক্লা একাদশী থেকে পূর্ণিমা পর্যন্ত পাঁচদিন ধরে এই অনুষ্ঠান চলে। হিন্দু নারীরা গভীর উৎসাহের সাথে এই উৎসব পালন করে থাকে। 

বিশ্বে সর্পদেবী মনসা এবং সর্পপূজার ইতিহাস অনেক পুরোনো। এই দেবীকে সন্তুষ্ট করতে পারলে মানুষের মঙ্গল সম্ভব। সেই ভাবনা থেকেই সুন্দরবনের লোকজীবনে মনসা ভাসান বা মনসা মাহাত্ম্য প্রচারের তাগিদ লক্ষ্য করা যায়। সাধারণত শ্রাবণ মাসে এই ভাসান গীত অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। সুন্দরবনের বিভিন্ন স্থানে এই মনসা ভাসান গানের দল আছে। 

বাংলাদেশের টাঙ্গাইল জেলার কিছু এলাকাসহ বংশাই নদীতে শ্রাবণ মাসের শেষ তিন দিন শাওনে ডালার উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। সাধারণত মুসলমান পুরুষেরাই এই উৎসবের ধারক ও বাহক। বিশেষ করে মুসলমান সাপুড়েরাই শাওনে ডালার প্রধান আয়োজক। মূলত মনসামঙ্গল বা বেহুলা-লখিন্দরের প্রচলিত যে কাহিনি রয়েছে তাকে স্মরণ করেই এই উৎসবের আয়োজন করা হয়ে থাকে।

সাপের দেবী বলে খ্যাত মনসা বা পদ্মাদেবী মূলত সনাতন বা হিন্দুদের দেবী হলেও তিনি বাংলাদেশের অধিকাংশ অঞ্চলের মুসলমান সমাজেও সমানভাবে সম্মানিত। বিশেষ করে কুষ্টিয়া ও টাঙ্গাইল অঞ্চলে পদ্মাপুরাণের আখ্যানভিত্তিক পরিবেশনায় মুসলমানদের অংশগ্রহণ লক্ষ্য করার মতো। মুসলমান শিল্পীদের পরিচালিত ও পরিবেশিত ‘পদ্মার নাচন’ মূলত নৃত্যপ্রধান এক ধরনের নাট্য পরিবেশনা-রীতি।   

প্রতি বছর শ্রাবণ সংক্রান্তিতে মনসা পূজা উপলক্ষে মনসামঙ্গলের বিখ্যাত কবি বিজয় গুপ্তের বরিশালের বাড়িতে এই রয়ানী গানের আসর বসে। অবশ্য রয়ানী গানের এই উৎসবভিত্তিক আসর শুধু যে কবি বিজয় গুপ্তের বাড়িতেই সীমাবদ্ধ থাকে, তা কিন্তু নয়। বরং একই সময়ে তা বৃহত্তর বরিশাল জেলার বিভিন্ন অঞ্চলের অনেক গ্রামেই অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।   

অনেক গবেষকের মতে, ঢপ বা ঢপকীর্তন মূলত রাধাকৃষ্ণের কাহিনিনির্ভর পরিবেশনা। বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে শ্রাবণ মাসে পূজার সময় ঢপযাত্রার আঙ্গিকে মনসামঙ্গলের পরিবেশনা বেশি হয়ে থাকে। বৃহত্তর সিলেট জেলার সুনামগঞ্জ অঞ্চলে ঢপযাত্রা সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়।

এটি মূলত বৌদ্ধ ভিক্ষুদের একটি ব্রত বা অনুষ্ঠান। বর্ষার দিনে জলসিক্ত ও কর্দমাক্ত পথে ভ্রমণকালে জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে সবুজ তৃণ, চারাগাছ এবং ছোট ছোট প্রাণী পায়ের নিচে পড়ে দলিত হবার আশঙ্কা থাকে। তাই স্বয়ং বুদ্ধদেব এ সময় সর্বাধিক ভ্রমণ ত্যাগ করে নিজ নিজ বিহারে অবস্থান করে আত্মবিশ্লেষণাত্মক এবং অধিষ্ঠানমূলক বিবিধ বিষয় চর্চা করার বিধান দিয়েছেন। বর্ষাবাস, প্রবারণা ও কঠিন চীবরদান- বৌদ্ধদের এই তিনটি উৎসব পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। 

বৌদ্ধদের অন্যতম একটি ধর্মীয় উৎসব এই আষাঢ়ী পূর্ণিমা। ঐতিহাসিক এবং ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এর বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। ঘাটু গান বিলুপ্তপ্রায় এক প্রকারের লোকগীতি। সাধারণত ঘাটে ঘাটে নৌকা ভিড়িয়ে এ গান গাওয়া হয় বলে এর নাম হয়েছে ঘাটের গান বা ঘাটু গান। নটীবেশে কিশোর বালক নাচের মাধ্যমে এই গান পরিবেশন করে থাকে। দৈনন্দিন জীবনের বিচিত্র ঘটনা এবং রাধাকৃষ্ণের প্রণয়লীলা এই গানের মূল বিষয়বস্তু। প্রধানত বর্ষা ঋতুতে যখন নদী-নালা, খাল-বিল জলে ভরা থাকে তখন নৌকায় করে এই ঘাটু গানের আসর বসে।   

বর্ষা উৎসবের এসব আয়োজন ছাড়াও সারা দেশে আরো বহু ধরনের উৎসব অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে কেবল বর্ষাকে কেন্দ্র করেই। যার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো- দিনাজপুর অঞ্চলের কান্দনী এবং রংপুর অঞ্চলের বিধবাদের বিষহরির গান, চাঁপাইনবাবগঞ্জ অঞ্চলের আলকাপ, বৃহত্তর রাজশাহী অঞ্চলের গম্ভীরা ও মনসার গান।