মতামত

হঠাৎ বন্যা: কীসের আলামত

আড়াই হাজার বছর আগে চৈনিক দার্শনিক লাওৎসু বলেছেন: ‘নদীতে বাঁধ দিও না, প্রয়োজনে নদীর কাছ থেকে একটু দূরে সরে যেও।’

তিনি প্রকৃতিকে পরিবর্তন করতে নিষেধ করেছিলেন। বলেছিলেন, প্রকৃতিকে তার নিজের সুরে বইতে দাও। তা না-হলে প্রকৃতি খুব ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে। প্রকৃতির নিজস্ব সত্তা আছে, সে তার মতো করেই সব নিয়ন্ত্রণ করে। প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে যেও না। বিশাল প্রকৃতির কাছে মানুষ বড় ক্ষুদ্র। বরং প্রকৃতির নিজস্ব সুরের সঙ্গে চলতে চেষ্টা করো। 

আজ এসব কথা শুনলে অনেকে হাসবে। কিন্তু এখন সত্যিই দেখা যাচ্ছে, লাও ৎসুর কথা কেমন অক্ষরে অক্ষরে ফলে যাচ্ছে। প্রকৃতি কী বিষম ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে! প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে এখন অনেকে পারমাণবিক বোমার সঙ্গে তুলনা করছেন। প্রাকৃতিক বিপর্যয় এমনকি পারমাণবিক বোমার চেয়েও ভয়ঙ্কর! পারমাণবিক বোমা হয়তো কেউ ফাটাবে না, কিন্তু প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে মানুষ কোনো না-কোনোভাবে ভুগছে বছরের পর বছর। পারমাণবিক বোমার হাত থেকে হয়তো আমরা রক্ষা পাব, কিন্তু প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষার কোনো উপায় নেই। একদিকে বায়ুমণ্ডল প্রচণ্ড উষ্ণ হয়ে উঠছে, অন্যদিকে আমাদের নদী-নালা-খাল-বিলগুলো ভরে যাচ্ছে আবর্জনায়।  একটা বিষয় তো সহজভাবেই বোঝা যায়, প্রতিদিন যে-পরিমাণ বাষ্প তৈরি হয় তত পরিমাণ মেঘও তৈরি হয়। সেই মেঘ তো বৃষ্টি হয়ে কোথাও না কোথাও নামতে হবে।

মেঘমালা তো আর সারা বছর আকাশে আকাশে ঘুরে বেড়াতে পারে না। কখনও না কখনও তাকে বৃষ্টি হয়ে ঝরতে হবে। মেঘ বৃষ্টি হয়ে ঝরে পাহাড়ে-জঙ্গলে-জনপদে। সেই বৃষ্টিধারা সহজভাবে নদী-নালা-খাল-বিলগুলো দিয়ে সমুদ্রপর্যন্ত বয়ে যেতে হবে। তা না-হলে অনিবার্যভাবেই বন্যা হবে। সিলেটে হঠাৎ বন্যার একমাত্র কারণ, যে-পরিমাণ বৃষ্টি ঝরেছে সে-পরিমান পানি নদীগুলো দিয়ে দ্রুত প্রবাহিত হতে পারেনি। প্রধান কারণ নদীগুলোর নাব্যতা সংকট। দ্বিতীয়ত নদী পর্যন্ত পানি সরতে যে-সব খাল-বিল বা ছড়া ছিল সেগুলো ভরাট হয়ে গেছে। অনেকে সেগুলো দখল করেছে। তার উপর হাওরে অপরিকল্পিত বাঁধ দেওয়া হয়েছে। ফলে তুমুল বৃষ্টির চাপ আর নদী-নালাগুলো সহ্য করতে পারেনি। পানি উপচে দিয়েছে জনপদে। এখন সিলেটে ঘরে ঘরে পানি। সুনামগঞ্জ ৯০ শতাংশ তলিয়ে গেছে, ৮০ শতাংশ তলিয়ে গেছে সিলেট শহর। বিদুৎ বিচ্ছিন্ন। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। ৪০ লাখ মানুষ বর্তমানে পানিবন্দি। জনগণের সেবায় সেনাবাহিনী নামাতে বাধ্য হয়েছে সরকার। এ সবই সংবাদমাধ্যমে জেনেছি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও আমরা বন্যার ছবি, বিপর্যস্ত মানুষের ছবি দেখছি। 

সিলেট বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক বন্ধু জানালেন, সিলেট বিশ্ববিদ্যালয় সিলেটের সবচেয়ে উঁচু জায়গায়। কোনোদিন সেখানে পানি উঠতে দেখেননি। কিন্তু এবার বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক জায়গা ডুবে গেছে। সিলেট শহর থেকে এক বন্ধু জানালেন, তাদের ঘরে হাঁটুপানি। মানবেতর জীবনযাপন করছে মানুষ। পরিস্থিতি এমন ঘর থেকে বের হওয়ারও উপায় নেই। শুকনো খাবার খেয়ে আছেন। 

উত্তরাঞ্চলের আরো কটি জেলায় বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। জামালপুর, শেরপুর, বগুরা, সিরাজগঞ্জ, কুড়িগ্রাম, নীলফামারীর বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হতে পারে। নদীগুলোর পানি বাড়ছে। আগামী কদিন আরো বৃষ্টির পূর্বাভাষ দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। সেরকম হলে দক্ষিণাঞ্চল, পূর্বাঞ্চলেও বন্যা ছড়িয়ে পড়তে পারে। ইতোমধ্যে ঢাকা ও এর আশপাশের অনেক অঞ্চল তলিয়ে গেছে। সেরকম হলে ১৯৮৮ ও ১৯৯৮-এর মতো বন্যা-পরিস্থিতির মুখোমুখি হবো আমরা। মাত্র তো আষাঢ়ের শুরু, পুরো আষাঢ় পড়ে আছে, তারপর শ্রাবণ, ভাদ্র-আশ্বিন, বৃষ্টির তো এখন সময়গময় নেই। শরৎকালেও প্রচুর বৃষ্টি হয় এখন। ফলে সহসাই আমরা বন্যা থেকে মুক্তি পাব বলে মনে হয় না। বরং পরিস্থিতি কখন আরো খারাপের দিকে যায় সেটাই এখন ভয়ের বিষয়। 

সবচেয়ে বড় ভয়ের কথা, প্রকৃতির কোনো কিছু আর এখন আমরা আগাম ধারণা করতে পারি না। আবহাওয়া অধিদপ্তরও সেরকম কোনো পূর্বাভাষ দিতে পারে না। মেঘালয়, চেরাপুঞ্জিতে এরকম ভয়ঙ্কর বৃষ্টি হবে কে জানতো! আর ভারতে বৃষ্টি হয় তার সুফল আমরা ভোগ করতে না পারলেও, কুফল শতভাগই আমরা ভোগ করি। বাংলাদেশের নদীশাসনের জন্য তো ভারত-সরকারেরও সহযোগিতা প্রয়োজন। এদিকে তরিতরকারীসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে বন্যার পানির মতোই! হাওর অঞ্চলের অনেক ধান তলিয়ে গেছে আগেই। ফলে চালের দাম লাগামছাড়া। সব মিলিয়ে এক ভয়ঙ্কর পরস্থিতির মুখোমুখি আমরা।

এ থেকে মুক্তির উপায় কী? সহসা মুক্তির উপায় নেই। যখন বন্যা-পরিস্থিতি দেখা দেয় তখন এ-নিয়ে অনেক কথা শোনা যায়। প্রশাসন দ্রুত দখল হওয়া খালগুলো উদ্ধার করে। তারপর আর দীর্ঘমেয়াদী কোনো পরিকল্পনা নেই। কিন্তু এই তো শেষ না। ভবিষ্যতে এ-পরিস্থিতি আরো খারাপ দিকেই যাবে। জনসচেতনতাই এ থেকে মুক্তির একমাত্র উপায়। জনসচেতনতা মানে শুধু নিজের চারপাশ পরিষ্কার রাখা, খাল, নালা ও ছড়াগুলো দখলমুক্ত রাখা নয়, প্রশাসনকেও চাপে রাখতে হবে যেন যথাসময়ে তারা উপযুক্ত পদক্ষেপ নেয়। জনগণ তাদের দাবিদাওয়া সম্পর্কে সচেতন না-হলে প্রশাসনও অন্ধের ভূমিকা পালন করবে। সত্যি করে বলতে প্রকৃতির হাতে যেমন মানুষ অসহায়, তেমনি রাজনৈতিক ক্ষমতার হাতেও মানুষ অসহায়। হাওরে অপরিকল্পিত বাঁধ, যত্রতত্র রাস্তাঘাট, খাল-ছড়া ভরাট করে ঘরবাড়ি, মার্কেট, দোকানপাট, কারখানাসহ নানারকম অবকাঠামো নির্মাণ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ক্ষমতাবলেই হয়। স্থানীয় ক্ষমতাশালীরা এসব করে। তাদের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে অনেকে সাহস পায় না। জনগণের সম্মিলিত প্রতিবাদ এ থেকে রক্ষা করতে পারে। 

আশার কথা বাংলাদেশে কোনো প্রকার প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা দিলে জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় পরিস্থিতি অনেকটাই মোকাবিলা করা যায়। ১৯৯৮ সালের বন্যায় আমরা দেখেছি সর্বসাধারণ কেমন স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে এসেছিল বন্যা-কবলিত মানুষের পাশে। তারা ত্রাণ সংগ্রহ করেছে, ত্রাণ বিতরণ করেছে। এখনো সেরকম এক পরিস্থিতি। এর মধ্যেই সর্বস্তরের জনগণ এগিয়ে আসতে শুরু করেছে অসহায় মানুষের পাশে। কিন্তু সাময়িক এ-সহযোগিতাই মুক্তির উপায় না। এটা জরুরি পরিস্থিতি সামাল দিতে পারে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এটা দেশের অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর। এটা সামগ্রিক অর্থনীতির ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। এক মৌসুমের বন্যা কয়েক বছরের জন্য লক্ষ মানুষকে দারিদ্র্যসীমার নিচে নামিয়ে আনতে পারে। ১৯৮৮, ১৯৯৮ সালের বন্যায় দেখা গেছে যারা ফসল হারিয়েছে, গবাদিপশু হারিয়েছে, কাজ হারিয়েছে অনেক বছর লেগেছে তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে। এরকম বন্যা বেকারত্ব বাড়িয়ে দেয়, রাষ্ট্রের সমস্ত কাজে বিঘ্ন সৃষ্টি করে। অবকাঠামো ধ্বংস করে। বন্যার ক্ষতি পুরোটা সাদা চোখে দেখা যায় না। বন্যার সঙ্গে আসে অনেক রোগবালাইও। যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্নতার ফলে সাধারণ মানুষ সঠিক চিকিৎসাও পায় না তখন। 

কয়েক বছর আগে আগাম বন্যায় যখন হাওর অঞ্চল তলিয়ে গিয়েছিল কাজ হারিয়ে, বাসস্থান হারিয়ে অনেক খেটে খাওয়া মানুষ ঢাকা এসে ভিড় জমিয়েছিলেন। রাস্তার পাশেই ছিল তাদের আশ্রয়। অনেকে টুকিটাকি ব্যবসা ও কায়িক শ্রমের বিনিময়ে জীবন চালিয়েছেন। বেশির ভাগই ভিক্ষা করেছেন। তখন একটি পরিবারের সঙ্গে আমার কথা হয়েছিল। তাদের ঘর ছিল, গরু ছিল, আজ তাদের কিছুই নেই, পথের ফকির। বাচ্চাদের লেখাপড়াও বন্ধ। 

ইতোমধ্যে বন্যার কারণে এসএসসি পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। অসংখ্য স্কুল বন্ধ। মাত্র করোনা মহামারির ধকল আমরা কাটিয়ে উঠেছিলাম। স্কুলগুলো খুলেছে বেশিদিন নয়। এর মধ্যেই আবার সব বন্ধ। এসব প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় আসলে শিক্ষাব্যবস্থা। নিয়মিত পড়াশোনায় মাসখানেকের বিরতীও অনেক সময় অনেক ক্ষতি করে। দীর্ঘবিরতীর পর স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ফিরতে সময় লাগে অভ্যাসগত কারণেই। এমন কি অনেক দরিদ্র পরিবারের প্রাথমিক, মাধ্যমিক পড়ুয়া ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা এসব পরিস্থিতির কারণে চিরতরে বন্ধও হয়ে যায়। 

দুঃখের কথা, বাংলাদেশে এসব নিয়ে বেশি গবেষণাও হয় না। যুগ যুগ ধরে এ দেশের মানুষ শুধু আসন্ন-সংকট মোকাবিলা করতে করতেই জীবন পার করছে। তা থেকে দীর্ঘমেয়াদী মুক্তির তেমন পরিকল্পনা করেনি। এক অঞ্চলের বন্যা সারাদেশেই কী ভয়ঙ্কর প্রভাব ফেলে এ সম্পর্কেও আমরা তেমন সচেতন নই। বাংলাদেশের যেখানেই যা ঘটুক তার প্রভাব ঢাকা শহরেও পড়ে। রাজধানী ঢাকা শুধু প্রশাসনকেন্দ্র নয়, অনেক নিরন্ন গৃহহীন মানুষের আশ্রয়ের জায়গাও বটে। ফলে দিন দিনই এখানে ভিড় বাড়ছে। আবার এখানে ভিড় বাড়লে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিসহ পরিবেশ বিপর্যয় এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থাও ভেঙে পড়বে। রাস্তাঘাটে বাড়ছে গৃহহীন মানুষের সংখ্যা। বাড়ছে ভিক্ষুকের সংখ্যা। এমন কি বাড়ছে ছিনতাইকারীসহ প্রতারকের সংখ্যাও। 

আড়াই হাজার বছর আগে লাওৎসু যা বলে গেছেন তা হয়তো আমরা শুনবো না। মানুষের এ-সভ্যতা নানা দিক দিয়েই তার বিপদসীমা ছাড়িয়ে গেছে আরো অনেক আগেই। আমাদের সামনে এখন কেবল ধ্বংসের আলামত।  এখন শেষ রক্ষা যতটুকু করা যায় ততটুকুই মঙ্গল।