শিল্প ও সাহিত্য

জন্মদিন আমার কাছে ক্লান্তির ডালিতে নতুন বোঝা: নির্মলেন্দু গুণ

নির্মলেন্দু গুণ সমকালীন বাংলা কবিতায় সবচেয়ে উজ্জ্বল নাম। তাঁর কথায়- কবিতা হচ্ছে কাব্যলক্ষ্মী, গদ্য ছত্রবৎ। দুই ধারাতেই নির্মলেন্দু গুণ অনন্য, অসামান্য। বাংলাদেশের জন্ম এবং মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠার যে রক্তসিঁড়ি তার সঙ্গেও নির্মলেন্দু গুণের সাক্ষাৎ শারীরিক এবং আত্মিক। কবির জন্মদিনে তাৎক্ষণিকভাবে  মুঠোফোনে ধারণকৃত এই কথোপকথন প্রকাশিত হলো। মুঠোফোনের এ পাশে ছিলেন লায়লা ফেরদৌসী

লায়লা: শুভ জন্মদিন দাদা!

নির্মলেন্দু গুণ: আমি আমার জন্মদিন পালন করা থেকে নিজেকে বিরত রেখেছি। আমি নিজ উদ্যোগে কখনও জন্মদিনের অনুষ্ঠান পালন করি না। জন্মদিন পালন না-করার কারণে আমি একটু চাপমুক্ত আছি। আমি নিজেই ভুলে যাচ্ছি- আমার জন্মদিন!

লায়লা: কবিতাপ্রেমী কিংবা আপনার ভক্ত-পাঠক যারা আছেন, তারা দিনটি অবশ্যই মরে রাখবেন। 

নির্মলেন্দু গুণ: হ্যাঁ, আমাকে অনেকেই নিমন্ত্রণ করেছেন। আমি তাদের নিবৃত্ত করেছি। জন্মদিন ছোটদের জন্য। তারা এনজয় করে। ছোটদের মধ্যেই এটি থাকা উচিত। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, কবিকে অপ্রত্যক্ষে রেখে তার সৃষ্টির মধ্যে যে প্রাণের প্রতিষ্ঠা তাহাই কবির জন্য গৌরবজনক। কবিকে প্রত্যক্ষে নিয়ে জন্মদিনের ব্যাপারটাতে তিনি উৎসাহিত করতেন না। তিনি আরো বলেছেন, আমার জন্মদিন তোমাদের কাছে প্রতি বছর নিয়ে যাচ্ছে উৎসব। আমার কাছে নিয়ে আসছে ক্লান্তির ডালিতে নতুন বোঝা। আমি রবীন্দ্রনাথের এই পঙ্ক্তি পড়ে সিদ্ধান্তটি গ্রহণ করেছিলাম আফটার সেভেন্টি। রবীন্দ্রনাথ সেভেন্টির সময়ই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তবে হ্যাঁ, জন্মদিন নিয়ে আমার খুব দীর্ঘ একটা কবিতা আছে- ‘৭ই আষাঢ়’। আমি জন্মদিন নিয়ে যতো বড় কবিতা লিখেছি আর কোনো কবি এত বড় কবিতা লিখেননি; চার কি পাঁচ পৃষ্ঠা হবে।

লায়লা: এই যে বয়স বেড়ে যায়, যাচ্ছে- কেমন লাগে?

নির্মলেন্দু গুণ: বয়স বেড়ে যাওয়া তো আজকে ৭৮ বছর ধরে দেখছি। কয়েক বছরের স্মৃতি মনে থাকে না। আমার মনে হয় পাঁচ বছর বয়সটি স্কুলে যাওয়ার জন্য যে নির্বাচন করা হয়েছে এটা বোধহয় এজন্য যে- তখন থেকে স্মৃতি সংরক্ষণ করার শক্তি মানুষ অর্জন করে। তার আগে কিছুই মনে থাকে না। কিন্তু এখন তো দেখি যে দুই-আড়াই বছর থেকেই অনেক বাবা-মা বাচ্চাদের পড়াশোনা শুরু করে দেন। আমাদের সময় পাঁচ বছরের নিচে কেউ স্কুলে ভর্তি হতো না। বাড়িতে হয়তো পড়াশোনার হাতেখড়ি হতো।

লায়লা: আপনি চাইলে বিলাসবহুল জীবন-যাপন করতে পারতেন, তারপরও এই বুড়িগঙ্গার তীরে সাধারণ জীবন বেছে নিলেন কেন?

নির্মলেন্দু গুণ: এখানে খুবই ভালো লাগে। সাধারণ মানুষ আমাকে কোনো কোয়েশ্চেন করে না। তারা শুধু আমাকে দেখে। এই জায়গাটাতে আমি যে নীরবতা পাই সেই নীরবতা আমার গ্রামের বাড়িতেও নেই। গ্রামের বাড়ির সামনে দিয়ে রাস্তা রয়েছে। রাস্তা দিয়ে প্রচুর টেম্পু, রিকশা, সিএনজি যায়। প্রচুর গাড়ির শব্দ। শত শত লোক এসে বসে থাকে আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য। এখানে কোনো গাড়ির শব্দ পাওয়া যায় না। মনে হয় না যে গাড়ি পৃথিবীতে আবিষ্কার হয়েছে। নো হর্ন, নো সাউন্ড অব অ্যানি ভেহিকেলস! আমার অনেস্ট ফিলিংসের ভেতরে যে জগৎ আমাকে আহ্বান করে, আমি মনে করি, কবির জন্য একটা মানসিক ধ্যানের দরকার। তার স্থিতি দরকার। একাত্ম হয়ে বসে জীবন সম্পর্কে চিন্তা ভাবনার অবকাশ তৈরি করা দরকার।

লায়লা: আপনি খুবই স্বাধীনচেতা এবং নিজের ইচ্ছেমতো জীবন তৈরি করে নিয়েছেন। এ বিষয়ে খুবই ভাগ্যবান মনে হয় আপনাকে।

নির্মলেন্দু গুণ: হ্যাঁ, তা বলা যেতে পারে। আমার আত্মজীবনী পড়লে সে জীবনের জন্য আমার সংগ্রাম জানা যায়। আমার যখন নুন আনতে পান্তা ফুরানোর অবস্থা তখন আমি বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়েছি। আমার বাবা পুরস্কারটাই শুধু দেখে গেলেন, আমার নুন আনতে পান্তা ফুরানোর দশাটাই দেখে গেলেন। এখন মনে হয় স্বর্গ যদি থেকে থাকে তিনি হয়তো স্বর্গের কোনো বোধী বৃক্ষতলে বসে ভাবছেন- আমি বোধহয় আগের মতোই কোনো ভাড়া বাড়িতে আছি এবং প্রয়োজনের তুলনায় আমার উপার্জন এখনো কম। কিন্তু আমি এখন তাকে কেমন করে বুঝাই- আমি এখন প্রয়োজনের চেয়ে অনেক অর্থ উপার্জনে সক্ষমতা অর্জন করেছি। আমি কাশবন, কবিতাকুঞ্জ, ঢাকায় বুড়িগঙ্গা নিজের বাড়িতে থাকি এই তথ্যটা আমি তাকে কেমন করে জানাই!

লায়লা: পৃথিবী বদলেছে, সমাজ বদলেছে, আমরাও আধুনিকতার আবরণে অনেক বদলে গেছি।

নির্মলেন্দু গুণ: আমি খুব বেশি বদলে যাইনি। এ জন্যই আমি আলাদা। আমি বলছি যে, আমি গাহি সে পুরো মানুষের গান। ধর্মেরও আগে প্রিয় প্রকৃতিতে যে মানুষ জেগেছিল আমি গাই সেই পুরো মানুষের গান। ফুল ম্যান মানে ধর্মেরও আগে আমাদের প্রকৃতিতে যে মানুষ, আমাদের পূর্ব পুরুষ তারাই ছিলেন পূর্ণ মানব। ধর্ম এসে সামাজিক নিয়মগুলো তৈরি করে ধর্মের অর্ন্তভুক্ত করে সেগুলোকে প্রচার করেছে। আমি আদিম পূর্ব পুরুষকে লালন করি। সেজন্য আমি সকল প্রকার প্রিজুডিস থেকে মুক্ত। আমি বলেছি- অগ্নির অশ্রুস্বর কুঞ্জন। নারী এবং পুরুষের অগম্য কেউ নেই। গম্যতা, অগম্যতা এগুলো মানুষ পরবর্তীতে সামাজিক শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য এই পদ্ধতিগুলো উদ্ভাবন করেছে।

লায়লা: দাদা, আলোচনা ভারি হয়ে উঠছে! ভেবেছিলাম, পপকর্ন খেতে খেতে আপনার কথাগুলো শুনব। 

নির্মলেন্দু গুণ: তুমিই তো ভারি আলাপের দিকে নিয়ে যাচ্ছ। আমি তো ভারি আলাপ করি না। এখন অবশ্য করতেও পারি, বাসায় থেকে থেকে ভারি হয়ে যাচ্ছি ইদানিং। যাক, জন্মদিনে খোঁজ নেওয়ার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ।