পজিটিভ বাংলাদেশ

বরিশালকে বদলে দেবে পদ্মা সেতু

নদীবেষ্টিত দক্ষিণাঞ্চলে বরিশাল বিভাগের চিত্র পাল্টে দিতে যাচ্ছে পদ্মা সেতু। এর ফলে পিছিয়ে পড়া এই বিভাগে ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে। একই সঙ্গে বরিশাল, ভোলা, পিরোজপুর, ঝালকাঠী, বরগুনা ও পটুয়াখালী জেলায় গড়ে উঠতে শুরু করবে নতুন নতুন সব শিল্প কারখানা। 

এক সময় নদী বেষ্টিত বরিশাল বিভাগর সঙ্গে দেশের অন্য বিভাগের সহজতর সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল না। ফলে স্বাধীনতার পর থেকেই এই বিভাগের জেলাগুলো ছিল খুবই অবহেলিত। 

বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে বরিশাল বিভাগের উন্নয়নে একের পর এক প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে শুরু করে। সর্বশেষ গত বছরের ২৪ অক্টোবর পায়রা সেতু উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে বিভাগীয় শহর বরিশালের সঙ্গে ৪ জেলার সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন হয়। এছাড়া আগামী আগষ্টে খুলে দেওয়ার কথা রয়েছে ৮৯৪ কোটি টাকা ব্যয়ে কচা নদীতে নির্মিত অষ্টম বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু। এই সেতুটির ফলে বরিশালের সঙ্গে পিরোজপুর-বাগেরহাট-খুলনার সড়কপথে ফেরিবিহীন যোগাযোগ স্থাপিত হবে। তবে ভোলার সঙ্গে সরসরি সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা হলেই ফেরি যুগের অবসান ঘটবে বরিশাল বিভাগে। 

আসার কথা হলো ভোলাকে সারা দেশের সঙ্গে সড়ক পথে যুক্ত করতে তেঁতুলিয়া নদীর ওপর দিয়ে দেশের দীর্ঘতম সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা করছে সরকার। ১০ কিলোমিটার দৈর্ঘে এই সেতুর ব্যয় ধরা হয়েছে ৯ হাজার ৯২২ কোটি টাকা। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ সেতু নির্মাণের জন্য জরিপ করেছে এবং সেতুর সম্ভাব্য স্থান নির্ধারণ করেছে।

এদিকে দক্ষিণাঞ্চলের মধ্যে বরিশাল বিভাগের ভাগ্য উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পায়রা সমুদ্রবন্দর, তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র, সাবমেরিন ক্যাবল ল্যান্ডিং স্টেশন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নভোথিয়েটার, শেখ হাসিনা সেনানিবাস, মেরিন একাডেমি, ক্যান্সার হাসপাতাল, শিশু হাসপাতাল, শিল্পকলা একাডেমি ভবন ও অডিটোরিয়াম এবং মহিলা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। কিন্তু এ সব প্রকল্পের পরও রাজধানীসহ সারাদেশের সঙ্গে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকায় অনেকটা পিছিয়ে ছিলো এ অঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতিক কার্যক্রম। 

সন্ধ্যার সময় পদ্মা সেতু

বরিশাল প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসেন বলেন, ‘পদ্মা সেতু একটি আত্মমর্যাদার নাম, একটি সাহসের নাম, বাংলাদেশ এগিয়ে যাওয়ার নাম। পদ্মাসেতু দক্ষিণাঞ্চলবাসীর অহংকার ও মর্যাদার জায়গায় নিয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বব্যাংককে চ্যালেঞ্জ করে পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন করেছেন এজন্য আমরা গর্বিত। পদ্মা সেতুর কারণে একদিকে যেমন সারাদেশের সঙ্গে এ অঞ্চলের মানুষের যোগাযোগ সহজ হবে তেমনি বাড়বে কর্মসংস্থান।’ 

বরিশাল চেম্বার অব কমার্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড’র সভাপতি সাইদুর রহমান রিন্টু বলেন, ‘বরিশালে ধান, শাকসবজি, নারকেল, সুপারি, পেয়ারা, আমড়া, তরমুজের পাশাপাশি তেজপাতারও চাষ হয়। বাজারজাত সহজ হলে এসব অঞ্চলে বড় আকারে তেজপাতা চাষের কথা বিবেচনা করা হচ্ছে। বাড়বে নারকেল ও সুপারির বাগানও। এতদিন এসব পণ্য রাজধানীতে পাঠানো ছিল দুঃসাধ্য। সেতু চালু হলে তা সহজ হয়ে যাবে।’ 

বরিশালের বিভাগীয় কমিশনার মো. আমিন-উল আহসান বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিকতায় ইতোমধ্যে পায়রা সেতু চালু হওয়ায় বরিশালসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলে ফেরিবিহীন যোগাযোগ শুরু হয়েছে। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর পর্যটনকেন্দ্র কুয়াকাটার সঙ্গে ঢাকাসহ সারাদেশের ফেরীবিহীন যোগাযোগ শুরু হবে। দক্ষিণাঞ্চলের যোগাযোগের ক্ষেত্রে শুরু হবে নতুন অধ্যায়। ফলে বরিশাল বিভাগে ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রসার ঘটবে।’

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মো. সাদেকুল আরিফিন বলেন, ‘পদ্মা সেতু দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় ৩ কোটি মানুষকে সারাদেশের সঙ্গে সংযুক্ত করবে। এছাড়া দেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিতে এ সেতুটি বিশেষ ভূমিকা রাখবে। আগামীতে বরিশাল হবে বাণিজ্য ও শিল্প নগরী। পায়রা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পায়রা সমুদ্র বন্দর ও কুয়াকাটা সৈকত এগুলোকে ঘিরে দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনৈতিক ও সামাজিক গতিশীলতা বৃদ্ধি পাবে।’

তিনি আরো বলেন, ‘শিক্ষা ও সংস্কৃতির সহজলভ্যতার কারণে এ বিভাগে সাংস্কৃতিক বিপ্লব ঘটবে।’ 

বরিশাল-২ আসনের সংসদ সদস্য শাহে আলম তালুকদার বলেন, ‘পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে বরিশাল বিভাগের ৬ জেলায়  ইতোমধ্যে শিল্পায়নের কাজ শুরু হয়েছে। বিশেষ করে পায়রা বন্দর পদ্মা সেতুর সুফল পাবে। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা অল্প সময়ের মধ্যে পণ্য পরিবহন করে পায়রা বন্দরের মাধ্যমে রপ্তানি ও আমদানি করতে উৎসাহি হবেন। সেদিন আর দেরি নয় বরিশালেও গার্মেন্টসসহ রপ্তানিমুখী শিল্প-কারখানা গড়ে উঠবে।’

বরিশাল-৪ আসনের সংসদ সদস্য পংকজ নাথ বলেন, ‘স্বপ্নের এই সেতুর মাধ্যমে একটা আমূল পরিবর্তন হবে। এই বিভাগে দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে। সবমিলিয়ে পদ্মা সেতু ঘিরে বরিশাল বিভাগের যোগাযোগ ব্যবস্থা, কৃষি, ব্যবসা-বাণিজ্য ও পর্যটন শিল্পের নতুন দুয়ার খুলবে।’

পদ্মা সেতুর সড়ক পথ

বরিশাল ৫ আসনের সাংসদ ও পানি প্রতিমন্ত্রী কর্ণেল অব. জাহিদ ফারুক বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দক্ষিণাঞ্চলের অগ্রযাত্রায় সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা আমাদের দিয়েছেন। আমরা তার নির্দেশনা অনুযায়ী প্রত্যন্ত গ্রামেও বাণিজ্যিক সুবিধা পৌঁছে দেব ইনশাআল্লাহ। আমরা গ্যাস ও অন্যান্য বিষয়গুলো নিয়েও ইতোমধ্যে আলোচনা করেছি।’ 

বরিশাল-১ আসনের সংসদ সদস্য ও পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ বলেন, ‘আবাসন শিল্প, পর্যটন শিল্প, হাইটেক পার্ক, তাঁতপল্লীসহ অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে। স্বপ্নের এই সেতুর চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বরিশাল বিভাগই নয় খুলনা বিভাগের অর্থনীতির পুনর্জাগরণ ঘটবে। সেই সঙ্গে এই সেতু দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে যোগাযোগ, বাণিজ্য বৃদ্ধিসহ অনেক ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এছাড়া কুয়াকাটা, বরিশালের দূর্গাসাগার, লাকুটিয়া জমিদার বাড়ি, দার্শনিক আরজ আলী মাতুব্বরের বাড়ি, রায়পাশা কড়াপুরের মিয়া বাড়ি মসজিদ, গুঠিয়া মসজিদ, গৈলা মনসা মন্দির, বার্থি তারা মায়ের মন্দির, ভোলার জ্যাকব টাওয়ার, চরকুকরি মুকরি, নেছারাবাদের আটঘর কুড়িয়ানায় ভাসমান পেয়ারা বাজার ও নৌকার হাটর সঙ্গে সারা দেশের দূরত্ব কমাবে। ফলে বাড়বে পর্যটকের সংখ্যা।’ 

তিনি আরো বলেন, ‘পদ্মা সেতু চালুর কয়েক বছরের মধ্যেই বরিশালে চালু হবে দীর্ঘ প্রতীক্ষার রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা।  রেললাইন নির্মাণের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রায় শেষ পর্যায়।’