ভ্রমণ

ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের ছায়াঘেরা ক্যাম্পাসে 

পথের প্রায় সম্পূর্ণটাই ছায়া ঢাকা। কড়ই জাতীয় গাছের ডালপালা চলে এসেছে রাস্তার উপর। উড়াল সড়ক পাশাপাশি দুই ভাগে বিভক্ত। মাঝের ফাঁকটুকু দিয়ে উঠে গিয়েছে গাছের ডগা। সিঙ্গাপুরে এত গাছ থাকতে পারে ভাবিনি। 

বাস থেকে নেমে পড়লাম পিএসবি সায়েন্স পার্ক বিল্ডিং স্টপেজে, গন্তব্য ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর। ভেবেছিলাম স্টপেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা নিকটেই। লিটল ইন্ডিয়া স্টপেজে এত করে খোঁজ নেওয়ার পর বাসে উঠলাম অথচ পৌঁছলাম ভুল জায়গায়। ছায়া সুনিবিড় পথ পেয়ে আর কোনো বাহনে উঠতে ইচ্ছা হলো না- হেঁটেই চলতে থাকলাম। প্রায় এক কিলোমিটার হেঁটেও অন্তত একজন মানুষ পেলাম না, যার কাছ থেকে জেনে নেব কোন দিকে যেতে হবে। 

এলাকাটা হালকা টিলাময়। চলতে চলতে চার রাস্তার মোড় থেকে বামের রাস্তাটাই বেছে নিলাম। ঢুকে গেলাম এক জঙ্গল পথে। খানিক উঁচুতে উঠে কিছুদূর যাওয়ার পর ডানে-বাঁয়ে একাধিক শাখা-প্রশাখা বেরিয়ে গিয়েছে। পথই বলে দিলো তা বিশ্ববিদ্যালয়ের পথ নয়। চৌরাস্তায় ফিরে এসে সোজা এগিয়ে যেতে থাকলাম। কিছুদূর গিয়ে মনে হলো বামে গেলে গন্তব্যে পৌঁছতে পারবো। পাশ দিয়ে নিরাপত্তা বেষ্টনী দেওয়া পায়ে চলার সরু একটা পথ। কোনো মতে একজন চলা যায় এমন। মনে হলো বহুকাল মানুষের পা পড়েনি। দশ মিনিট যাওয়ার পর দেখি আর কোনো ফুটপাথ নেই। বাধ্য হয়ে পুনরায় মূল রাস্তায় ফিরতে হলো। সেখান থেকে বেশ কিছু দূর এগিয়ে যাওয়ার পর একজন পথচারীর দেখা পেলে তবেই না সঠিক দিকনির্দেশনাটি মিললো। কুইন্স টাউন সাবওয়ে স্টেশন থেকে ট্রেনে করে কেন্ট ব্রীজ পৌঁছেই পেয়ে গেলাম ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর। 

স্টেশন থেকে বেরিয়ে এক মিনিট এগিয়ে দেখতে পেলাম একটা ভবনের গায়ে বড় করে লেখা- এনইউএস। তার নিচেই বাস স্টপেজ। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর সার্বক্ষণিক নিজস্ব বাস সেবা চলমান। একজন কর্মকর্তা জানালেন আমাকে বাসে করেই ঘুরতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ঠিক কোন জায়গা দেখব তা পূর্ব নির্ধারিত নয়। সুতরাং একটার পর একটা রুটের বাসে উঠে পড়বো আর ঘুরবো। এরই মধ্যে দেশ থেকে ফোন পেয়ে কথা হলো এক বড় ভাইয়ের সঙ্গে। ফোনালাপে কথায় কথায় জানতে পারলাম আমার শহর বগুড়ার একজন তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগে শিক্ষকতা করেন, চাইলে আমি তার সঙ্গে দেখা করতে পারি। নির্দিষ্ট ভবনে গেলাম বটে; তবে তার হদিস করতে পারলাম না। লাভের মধ্যে যা হলো, বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় পাঠাগারের দেখাটা পেয়ে গেলাম। 

রাস্তার এক পাশে তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের ভবন, অপর পাশে পাঠাগার। পাঠাগারে ঢুকতে না পারলেও আশপাশটা ঘুরে দেখার সুযোগ হলো। ভবনের নিচতলা সম্পূর্ণ খোলামেলা। একপাশে গ্যালারীর মতো। গ্যালারীর শীর্ষে সমতল অংশে বেশ কিছু চেয়ার-টেবিল পাতা। চমৎকার জায়গা, প্রাকৃতিক আলোর পর্যাপ্ততার কারণে কৃত্রিম আলোর দরকার পড়ে না। একদল শিক্ষার্থী দল বেঁধে অধ্যয়ন করছে আর কুরমুর করে কিছু একটা খাচ্ছে। নিজেও একটা টেবিলে বসে পড়লাম এবং ব্যাগ থেকে একটা বিস্কুটের প্যাকেট বের করলাম। নোনতা বিস্কুট, স্বাদে অনন্য শুধু অভাব বোধ করলাম এক মগ কফির। নিচে কয়েকজন শিক্ষার্থী শোলা, কার্টোন, কাগজসহ পরিত্যাক্ত জিনিসপত্র দিয়ে নানান শিল্পকর্ম ও কাঠামো তৈরিতে ব্যস্ত। এর মধ্যে আমার বিস্কুট খাওয়া এবং প্রয়োজনীয় কিছু নোটস নেওয়া উভয়ই শেষ। তারা যে সমস্ত জিনিস তৈরিতে ব্যস্ত তার মধ্যে সিংহাসনটা সব থেকে বেশি আকর্ষণীয়। জনপ্রিয় ইংরেজি ধারাবাহিক গেম অব থ্রনের সেই সিংহাসন। 

কার্টোন কাটা টুকরো দিয়ে তৈরির পর এমন রং মেরে দেওয়া হয়েছে যে, বোঝার উপায় নেই তা আসল না নকল। কথার ফাঁকে আগ্রহ প্রকাশ করায় শিক্ষার্থীদের একজন মুহূর্তেই আমাকে রাজা বানিয়ে দিলো। সিংহাসনে বসিয়ে পটাপট কয়েকটা ছবি তুলে ক্যামেরাটা হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো, এই নাও তোমাকে সাত রাজত্বের মহারাজা বানিয়ে দিলাম। 

পাঠাগার চত্বর থেকে আর একটা বাসে উঠে রওনা দিলাম বিশ্ববিদ্যালয় যাদুঘরের দিকে। পুরো এলাকা টিলাময়। সবুজের সমারহের কমতি নেই। তার মাঝে গড়ে ওঠা ভবনগুলোতে সর্বাধুনিক নির্মাণশৈলীর বহিঃপ্রকাশ। এক গন্তব্য থেকে আরেক গন্তব্যে যাওয়া মানে বৃক্ষের ছায়া ঢাকা উঁচুনিচু পথে এগিয়ে চলা, যেন কোনো বনের মধ্যে দিয়ে রোমাঞ্চের যাত্রা। যাদুঘরের ছাদ এবং দেয়ালে গাছপালার প্রাচুর্য। ভিতরে প্রবেশ করলেই একটা কাঁচের বাক্স আর তার ভেতর থেকে মানুষের মতো করে যে প্রাণীটি তাকিয়ে আছে তা আমার দেখা সর্বপ্রথম ওরাংওটাং। মৃত হলেও দেখে মনে হবে জীবিত এবং জ্বলজ্বল করে তাকিয়ে আছে। প্রাইমেট বর্গের প্রাণীটি বিলুপ্ত প্রায়, ১৯৩০ সালে সুমাত্রা থেকে সংগৃহীত। কিছুটা হনুমান ও খানিকটা বানরের মতো দেখতে। খয়েরি রঙের দীর্ঘ লোমশ শরীরের মাঝ থেকে বেরিয়ে আসা হাত দুটো দেখে মনে হয় তা যেন মানুষেরই হাত!

মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়া আদি নিবাস হলেও বর্তমানে পৃথিবীর শুধু ব্রুনাই ও সুমাত্রার ঘন জঙ্গলেই তাদের অস্তিত্ব মেলে। দিনকে দিন আশঙ্কাজনক হারে সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। প্রাইমেট বর্গের কোন প্রাণীই মানুষদের প্রত্যক্ষ পূর্বসূরী নয় কিন্তু বর্তমানের জীবজন্তু অন্যান্য প্রাইমেট ও মানুষেরা এক সাধারণ বিবর্তনের ইতিহাসের অংশীদার। বিজ্ঞানের ভাষ্যমতে মানুষের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য গবেষণা করে বোঝার চেষ্টা করা যেতে পারে কীভাবে ও কেন প্রাইমেটদের একটি ধারা বিবর্তিত হয়ে মানুষের আবির্ভাব হলো আর অন্য একটি ধারা বিবর্তিত হয়ে শিম্পাঞ্জি ও গরিলার আবির্ভাব ঘটল? 

এরপর কিছুটা লক্ষ্যহীন ঘোরাঘুরি। অর্থাৎ, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার সব রাস্তায় একটা করে চক্কর দেওয়া। নেমে পড়লাম ইউনিভার্সিটি টাউনে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতর মিলন কেন্দ্র ধরনের সুবিশাল জায়গা। উঁচু দালানের সাথে কাঁচের ছাদ দেওয়া বাগান। পথরের ঝকঝকে মেঝে, তারই বুকে শোভা পাচ্ছে বিভিন্ন প্রকার গাছ। বাগানের ভেতর দিয়ে আরও কিছুটা এগিয়ে গেলে অনেক বড় একটা খাবার জায়গা। দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করতেই নাসিকা রন্ধ্র ছুঁয়ে গেল হরেক খাবারের সুবাস। ফুডকোর্টে সারি সারি দোকান আর তার সামনে দিয়ে বসার চেয়ার-টেবিল। একেক দোকানে একেক ধরনের খাবার। সোজা কথা পৃথিবীর জনপ্রিয় প্রায় সব ধরনের খাবারেরই দোকান আছে। 

কফির দোকানের সামনে লেখা, প্রতি মগ কফি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর জন্য ৮০ এবং সাধারণের ক্ষেত্রে ৯০ পয়সা। আমি যেহেতু সাধারণ তাই আমার বেলায় ৯০ পয়সা। কফির মগ নিয়ে টেবিলে ফিরে দেখি একজন শিক্ষার্থী গভীর মনোযোগে নুডুলস খাচ্ছে। পাশে ঠিক একই দোকান থেকে নেওয়া কফির মগ। তার স্বতৃপ্ত নুডুলস ভক্ষণে ব্যাঘাত ঘটাতে ইচ্ছা হলো না। কিন্তু আমার ব্যাগ আর খাতা কলম ঠিক একই টেবিলে রাখা। অনুমতি নিয়ে যখন বসে পড়লাম তখন তার দুঃখের অন্ত রইল না, যেন অন্যের টেবিলে বসে বড় অন্যায় করে ফেলেছে। তরুণ শিক্ষার্থী অ্যারেন তুরস্ক থেকে এসেছে, পদার্থ বিজ্ঞানের উপর একটা বিশেষ কোর্স করার জন্য। সে আমার চাহিদা মতো কোনো তথ্য সরবরাহ করতে না পারলেও একটা উপকার করে দিতে পারল। ভাবলাম আমার হোস্টেলের তুর্কি ভদ্রলোককে চমকে দেওয়ার একটা ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সকালেই তার সাথে নাস্তার টেবিলে কথা হয়েছে। কি বলে গেলেন তার কিছুই বুঝতে পারলাম না। বিস্তর কথার মাঝ থেকে শুধু দুটি শব্দের উচ্চারণ বুঝতে পারলাম ‘খুসু খুসু’ বা এর কাছাকাছি কিছু একটা হয়ে থাকবে। বাদবাকি তার হাতের ইশারা এবং অন্যান্য অঙ্গ ভঙ্গিমা থেকে আন্দাজ করে নিতে হল, তিনি নুডুলস কিনে ঠকেছেন। 

অ্যারেন আমার অভিপ্রায় অনুধাবনপূর্বক তুর্কি ভাষার কয়েকটা কথা শিখিয়ে দিলো। সঠিক সময়ে প্রয়োগের সুবিধার্থে সাথে সাথে তা খাতায় লিখেও নিলাম। দুঃখের বিষয় রাতে লোকটার সাথে দেখা হলে বাক্যগুলো অ্যারেনের মতই উচ্চারণ করে বললাম কিন্তু তিনি চমকিত হওয়া দূরের কথা কোনো প্রতিক্রিয়াই ব্যক্ত করলেন না। তাতে নিজের কাছে খানিকটা হতবুদ্ধি বা অপমানিত বোধ হলো। আশপাশে তাকিয়ে দেখে নিলাম কাণ্ডটা আর কেউ দেখল কিনা। ফ্রেশ হয়ে মই বেয়ে মাত্র বিছানায় উঠেছি; দেখি লোকটা একটা সিদ্ধ ডিম হাতে নিয়ে নিচে দাঁড়িয়ে আছে। কথা না বলে ডিমটা আমার হাতে চালান করে দিয়ে আবারও নিজের মতো কি কি সব বলতে বলতে বিদায় হলেন। 

যাই হোক, ফুডকোর্ট থেকে বেরিয়ে পা বাড়ালাম মাঠের দিকে। মাঠের অপর প্রান্তে কয়েকটা ভবন, উঠে গিয়েছে আকাশের কাছাকাছি। চতুর্দিকে ঢালাই করা পায়ে হাঁটা পথ। মাঠে পা রাখা মাত্র হুট করে একদল শিশু-কিশোর এসে ঘিরে ধরল। সঙ্গে একজন শিক্ষিকা। স্কুল থেকে তাদের দেশের সব থেকে বড় বিদ্যাঙ্গন ভ্রমণে নেওয়া হয়েছে। ভ্রমণে কিছু কাজও দেওয়া হয়েছে। একটা প্রশ্নমালা হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলা হলো, সেগুলোর আলোকে আমাকে প্রশ্ন করা হবে এবং প্রতিবেদন তৈরির জন্য তা ভিডিও ক্যামেরায় ধারণ করা হবে। আমার যে তাতে কোনো আপত্তি নেই সেটা জানার পর শুরু হলো পশ্নোত্তর পর্ব। হঠাৎ করেই এমন একটা পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়া কতটা মূল্যবান আর উপভোগ্য হলো তা আমি ভেবেই পোলাম না! 

মাঠের অপর প্রান্তে ভবনের নিচ তলায় বসার সুবন্দোবস্ত। দলে দলে শিক্ষার্থীগণ দলীয় অধ্যয়ন আর গল্পগুজবে মেতে উঠেছে। দেখতে দেখতে সবুজ ঘাসের মাঠজুড়ে ঢেলে পড়ল পড়ন্ত বিকেলের মিষ্টি রোদ। ঠিক তার পিছে পিছে তাড়া করার মতো এগিয়ে চললো উঁচু দালানের এক খণ্ড ছায়া। ইউনিভার্সিটি টাউন থেকে বেরিয়ে আর বাসে উঠতে মন চাইল না। সকাল থেকে ঘুরতে ঘুরতে প্রায় সমস্ত পথই মুখস্ত হয়ে গিয়েছে। ইচ্ছা হলো পায়ে হেঁটেই কেন্ট ব্রীজ স্টেশনে যাই। প্রকৃতি বোধহয় আমার মনের ভাষা বুঝতে পারল। চারপাশে চোখ জুড়ানো সবুজ আর সেই সবুজের মাঝ থেকে ভেসে এল তার সাথে নিবিড় হওয়ার নিঃশব্দ আহ্বান। প্রকৃতির এমন নিঃস্বার্থ আহ্বানকে উপেক্ষা করা আমার সাধ্যের অতীত। তাইতো বৃক্ষের নিচ দিয়ে সর্পিল কালো পথ আর ঝিরিঝিরি বাতাস হয়ে উঠল আমার বিদায় বেলার পরম বন্ধু। (শেষ)