খেলাধুলা

রোহিত-পান্ডিয়া বারবার বোকা বানাতে চেয়েছিল: মুকুল

এশিয়া কাপে না থেকেও যেন আছে বাংলাদেশ। ২২ গজে ক্রিকেটাররা লড়াইয়ে না থাকলেও ম্যাচ পরিচালনায় লাল-সবুজের প্রতিনিধিত্ব করছেন বাংলাদেশি আম্পায়ার মাসুদুর রহমান মুকুল। তিনি এশিয়া কাপে পরপর ভারত-পাকিস্তানের মতো বিগ ম্যাচে অনফিল্ড আম্পায়ার ছিলেন। বিখ্যাত আম্পায়ার আলিম দার তাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন ম্যাচের পরে। সামাজিক যোগাযোগ ম্যাধ্যম ভাসছে শুভেচ্ছা বার্তায়।

গ্রুপ পর্বের পর সুপার ফোরে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা কেমন ছিল মুকুলের? কিভাবে সামলেছেন বাবর আজম, বিরাট কোহলি ও রোহিত শর্মাদের? রাইজিংবিডির সঙ্গে একান্ত আলাপনে সবকিছু নিয়ে কথার ঝাঁপি খুলে বসেন মুকুল। দুবাই থেকে পাঠকদের জন্য সেই কথাগুলো তুলে ধরেছেন সাইফুল ইসলাম রিয়াদ।

ব্যাক টু ব্যাক ভারত-পাকিস্তান ম্যাচে আম্পায়ারিং। ক্যারিয়ারের অন্যতম মাইলফলক নিঃসন্দেহে। আপনি রোমাঞ্চিত কি না?

মুকুল: আমি আসলে বড় মঞ্চে কখনো আম্পায়ারিং করিনি। আমার সর্বোচ্চ বড় টুর্নামেন্ট অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ। যখন ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের দায়িত্ব পেলাম, তখন রোমাঞ্চিত ছিলাম। এর পাশাপাশি নিজের ভেতরেও চ্যালেঞ্জ ছিল। আসলে মানুষের জীবনে তো সব সময় সুযোগ আসে না। এ সুযোগটাকে যদি আমি কাজে লাগাতে পারি, তাহলে তো আমার আম্পায়ারিং ক্যারিয়ার বদলে যাবে। বিশ্বাস করবেন কি না জানি না, একজন বাংলাদেশি আম্পায়ার হয়ে বলছি, আমাদের আম্পায়ারদের চেহারাটাই বদলে যাবে। এই রোমাঞ্চ এবং চ্যালেঞ্জ দুটোই ছিল আমার ভেতর। এখন পর্যন্ত সফলতার সঙ্গে শেষ করতে পেরেছি। দেখা যাক, সামনে কী হয়?

ক্রিকেটের বিগ ম্যাচে আম্পায়ারিংয়ের দায়িত্বে ছিলেন। ভাবনায় কী ছিল?

মুকুল: আসলে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ সত্যি বলতে ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় ম্যাচ। হয়তবা অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ডের অ্যাশেজ থাকতে পারে। তবে, ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ সবচেয়ে বড় ম্যাচ। মাঠের ভেতর অনেক উত্তেজনা থাকে। নিশ্চিতভাবে নিজেকে খেলার আগে তৈরি করতে হয়েছে মানসিক ও শারীরিকভাবে।

এই দুই ম্যাচের অভিজ্ঞতা যদি বলতেন…

মুকুল: অন্যরকম এক অভিজ্ঞতা, মাঠে না দাঁড়ালে বোঝা যাবে না। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল—মাঠে এত প্রচণ্ড আওয়াজ ছিল, কোনো কথাই শুনতে পাচ্ছিলাম না। ওখানে চ্যালেঞ্জ ছিল—বল ব্যাটে লাগল না প্যাডে লাগল, কী হলো? দুই টিমে বড় বড় নাম খেলে, যারা পৃথিবীর ক্রিকেটকে লিড করে। তাদের ম্যাচ পরিচালনা করতে একটা চাপ তো থাকবেই। একটা ভুল সিদ্ধান্ত ম্যাচের ভাগ্য বদলে দিতে পারে। আমি কট বিহাইন্ড বা লেগ বিফোর নিয়ে বলছি না। কারণ, ডিআরএস আছে এটা রিকভার করতে।

আপনারা ওয়ার্কআউট করেছিলেন কি না, এই ম্যাচগুলোতে দায়িত্ব পালনের আগে?

মুকুল: আমাদের আগে থেকে ধারণা ছিল, আমরা ভারত-পাকিস্তানের ম্যাচ পাব। তখন থেকে আমরা কাজ শুরু করি। প্লেয়ার বাই প্লেয়ার ওয়ার্কআউট করেছি। একটা টিম যেরকম বিপক্ষ টিম নিয়ে ওয়ার্কআউট করে, সেভাবেই করেছি। লোকাল কোচদের থেকে পরামর্শ নিয়েছি। দায়িত্ব পাওয়ার পর আইসিসির কোচের সঙ্গে আমরা কথা বলেছি। আমি খুব খুশি। বিশ্ব ক্রিকেটে আমার অনেক সিনিয়র আছেন, তারা আমাকে অনেক হেল্প করেছেন। আগে যারা ভারত-পাকিস্তান ম্যাচে আম্পায়ারিং করেছেন, তাদের থেকে সহোযোগিতা নিয়েছি। যেসব জিনিসের মুখোমুখি হতে হয়, সেগুলো জানতে চেয়েছি। ডিসিশন মেকিংটা খুব গুরুত্বপূর্ণ, সেটা নিয়েই বেশি ওয়ার্কআউট করেছি।

এক দলে বিরাট কোহলি ও রোহিত শর্মা, আরেক দলে বাবর আজমরা। তারা কোনোভাবে প্রভাব ফেলতে চাইতেন কি না?

মুকুল: না, না। এরা যেহেতু বড় প্লেয়ার, এদের চাপ দেওয়ার সিস্টেম আলাদা৷ কখনো বুঝতে দেবে না যে, আপনাকে চাপ দিচ্ছে। ওরা যখন কথা বলে, তখনই বুঝে নিতে হয়, কথার হেতু কী? প্রথম ম্যাচে ওভাবে হয়নি। আমরা যখন ৩ ওভার করে পেনাল্টি করছিলাম মাঠে, তখন তারা জানতে চাচ্ছিল এসব ব্যাপার। ওরা ওভার রেট জানতে চাইছে। কাল যেটা হলো—যখন কট বিহাইন্ডের সিদ্ধান্ত নট আউট দিলাম, তখন জায়ান্ট স্ক্রিনে দেখাচ্ছিল; তখন পান্ডিয়া-রোহিতরা এসে জিজ্ঞেস করছিল যে, তুমি কী মনে করো? আরেকটা যখন লেগবিফোরের আবেদন করল বিষ্ণোইর বলে, আমি নট আউট দেওয়ার পর জাস্ট জিজ্ঞেস করল, আপনার কি মনে হয় মিসিং? সো, আমি ১৫ সেকেন্ড পর্যন্ত অপেক্ষা করছি, আমি যদি তখনই উত্তর দিতাম, তাহলে ওরা বুঝত দুর্বল আম্পায়ার। সো, ওরা বার বার সেটা করতে চাইত বোকা বানানোর জন্য, চাপগুলো এমন করে দেয়।

তার মানে আপনাকে বোকা বানাতে চেয়েছিল?

মুকুল: আমি বলে দিলেই ওরা সিদ্ধান্ত নিতো ডিআরএস নেবে কি না৷ সো, আমাদের ছোট ছোট জায়গাগুলো খুব ইম্প্রুভের জায়গা। আমাদের ১৫ সেকেন্ড পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। আমরা লেগবাই দেখাই না, আমরা ১৫ সেকেন্ড পর্যন্ত অপেক্ষা করি। এতেই ওরা আম্পায়ার কতটা উইক বা স্ট্রং বুঝে যায়। ছোট ছোট ব্যাপারগুলো খুব চ্যালেঞ্জিং। নরমাল যেটা করে, কালই করছে এমন না। একটা প্লেয়ার শট খেলার পর যেমন তার আত্মবিশ্বাস বোঝা যায়, সেম একজন আম্পায়ারও৷

খেলার ফাঁকে কোহলি-বাবরদের সঙ্গে কোনো কথা হয়েছিল?

মুকুল: আসলে টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খুব দ্রুত শেষ করতে হয়। ওভারের বিরতিতে ওরা খুব ব্যস্ত থাকে। খুব একটা সময় হয়ে ওঠে না। এখানে খুব গরম। ওভারের বিরতিতে ওরা পানি-জুস খেয়ে সময়টা পার করে দেয়। পানি পানের বিরতিতে মাঝে মাঝে টুকটাক কথা বলে। ক্রিকেটের বাইরে কোনো কথাই হয় না আসলে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আপনার প্রশংসায় ভাসছে। কেমন প্রতিক্রিয়া পাচ্ছেন?

মুকুল: মিশ্র প্রতিক্রিয়া। বাংলাদেশের ক্রিকেট যারা পরিচালনা করেন, তাদের থেকে অনেক ভালো বার্তা পেয়েছি। খেলা শেষে আলিম দার, একজন গ্রেট আম্পায়ার তিনি, আমাকে অভিনন্দন জানিয়েছে। আরও অভিনন্দন জানিয়েছে। মিশ্র প্রতিক্রিয়া এজন্য বললাম যে, আপনারা সবাই তো বাংলাদেশের ক্রিকেটকে ফলো করেন, আমরা আম্পায়াররা কিন্তু কোনো জায়গায় নেই। কারণ, আমাদের পারফরম্যান্স মিডিয়াতে বা আমাদের আর্থ-সামাজিক জায়গা থেকে বাংলাদেশে আমরা ভালো জায়গা নেই। বাংলাদেশে সবার ধারণা, আমরা মানসিকভাবে দুর্বল, আমাদের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা কম৷ আইসিসিও এসব ধারণা করত। তারা ভাবত, বড় ম্যাচ পরিচালনার ক্ষমতা রাখে না। যতদূর দেখেছি, আমাদের নিয়ে নেগেটিভ সমালোচনা হয়েছে, পজেটিভ নেই৷ সে জায়গা থেকে প্রশংসা আসতেছে, এটা আমাদের জন্য বিশাল চ্যালেঞ্জ। এটাকে যদি ধারাবাহিকভাবে করতে পারি, তাহলে সামনে ভালো দিন আসবে।

সামনেই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ আছে। সেখানে আপনি থাকছেন কি না? প্রত্যাশা কী?

মুকুল: সবকিছুর একটা নিয়ম আছে। রাতারাতি ভালো করে আপনি কিছু আশা করতে পারেন না। আমাদের ভালো সময় যাচ্ছে। আমাদের কোভিডের মাঝে ৭টা সিরিজ, এশিয়া কাপ, নারী বিশ্বকাপে আমাদের আম্পাররা খুব ভালো পারফর্ম করছে। এর ধারাবাহিকতা থাকলে এ টি-২০ বিশ্বকাপে না হোক, ভবিষ্যতে আমাদের থেকে কেউ না কেউ যাবে। প্রত্যাশা তো আছেই। আরও ওপরের লেভেলে এলিট প্যানেলে যাওয়ার আশা তো আছে। আশা করলেই তো হবে না, বাস্তবায়ন করতে পারফরম্যান্সও করতে হবে। এ মুহূর্তে আমরা টি-২০ বা বিশ্বকাপে থাকা নিয়ে আশা করছি না। বাট আমরা আশা করি, এভাবে যদি আমাদের পারফরম্যান্স দেখাতে পারি আইসিসিকে, আমরা না হোক, আমাদের পরের জেনারেশন কেউ না কেউ টপ লেভে আম্পায়ারিং করবে।