সাক্ষাৎকার

‘কবিরা মানুষের হৃদয় খুন করে’

ইরাজ আহমেদ এর জন্ম মার্চ ২৫, ১৯৬৪। লেখালেখির শুরু আশির দশকের শুরুতে। লেখাপড়া শেষ করেছেন বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। সাংবাদিকতা পেশার সঙ্গে জড়িত ছিলেন প্রায় ত্রিশ বছর। এখন লেখালেখির সঙ্গেই জড়িত। প্রকাশিত গ্রন্থ: ফেলে আসা রুমাল (কাব্যগ্রন্থ), এইসব অন্ধকার (উপন্যাস), পুড়তে থাকো বিজ্ঞাপনের আগুনে (কাব্যগ্রন্থ), যেখান থেকে আকাশ দেখা যায় না। (উপন্যাস). কয়েকটি মৃত জোনাকী (গল্পগ্রন্থ), বৃত্তের ভেতরে একা। (উপন্যাস), শীতে ভবঘুরে (কাব্যগ্রন্থ), অভ্যুত্থান (উপন্যাস), চৈত্রের দিন (উপন্যাস), মহাকালের ঘোড়া (উপন্যাস), চে গুয়েভেরার আফ্রিকার ডায়েরি (অনুবাদ)। রাইজিংবিডির পাঠকদের জন্য তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রুদ্রাক্ষ রহমান।

রুদ্রাক্ষ রহমান: কখনও খুন করার ইচ্ছে জাগে? আমার এমন প্রশ্নে একটুও অবাক হলেন না তিনি। এটা তার যাপিত স্বভাব। কেনো কিছুতেই বিস্মিত হোন না। মুহূর্তকাল ব্যয় না করে হাসি ছড়িয়ে দিলেন। ইরাজ আহমেদ: প্রতিদিনই খুনের ইচ্ছে জাগে। কবিরাই তো খুনি হতে চায়। কবিরা মানুষের হৃদয় খুন করে। 

রুদ্রাক্ষ রহমান:: বিপ্লবী হওয়ার ইচ্ছ হয়েছিলো কখনো? এবার একটু নড়ে চড়ে বসলেন ইরাজ আহমেদ। বাইরের আলো আটকে দেওয়া ঘরে, একটু আলো-একটু আঁধারের খেলায় আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম শক্ত হয়ে যাচ্ছে তার চোয়ালের পেশি। তিনি এবার চেয়ারে পিঠ এলিয়ে দেয়ার ভঙ্গিটা ভেঙে একটু ঝুঁকে এলেন। একবার না দেখার মতো করে তাকালেন বাঁ দিকে একটু দূরে বড় টিভি স্ক্রিনে নেচে চলা নোরা ফাতেহর দিকে। তারপর ডান দিকে পর্দা গলে ভেতরে আসা রোদের দিকে চোখ রাখলেন। ইরাজ আহমেদ: নবারুণ ভট্টাচার্যের কবিতা পড়ে সত্যি সত্যি বিপ্লবী হতে চেয়েছিলাম।

রুদ্রাক্ষ রহমান: খুন, বিপ্লব ছেড়ে কবিতায় জীবনপোড়ানো কেনো? এই প্রশ্নে আবারো রহস্যঘেরা হাসি তার ঠোঁটে। হেসেই উত্তর ফেরান তিনি। ইরাজ আহমেদ: কারণ কবিরা খুনও করতে পারে, বিপ্লবও করতে পারে। এই শহরে ক্লান্ত হতে হতে আমারই কখনো কখনো খুন করতে ইচ্ছে করে। আর মানুষের পৃথিবীতে আমার বিপ্লব করার ইচ্ছে কখনোই শেষ হবে না। ‘অ্যাগেইন উই ইউনাইট আন্ডার আ নিউ ব্যানার।’

রুদ্রাক্ষ রহমান: বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্যের শিক্ষার্থী আপনি। দেশি, বিদেশি সাহিত্য, কবিতার সঙ্গে আপনার নিত্যবসবাস। তারপরও কোন কবির কবিতা পড়ে আপনার ভেতর তীব্র ইচ্ছে হয়েছিলো কবিতা লেখার, কবি হওয়ার? ইরাজ আহমেদ : নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ‘নক্ষত্র জয়ের জন্য’ কাব্যগ্রন্থটি পড়ে। সেটা বিগত শতাব্দীর ৮০ সাল।

রুদ্রাক্ষ রহমান : আর ছাপার অক্ষরে আপনার কবিতা? ইরাজ আহমেদ : সেটা ১৯৮১ কিংবা ৮২ সাল। একটা ছোট কাগজ, নাম প্রতিপক্ষ। কবি জাহিদ হায়দার, গল্পকার আবু সাঈদ জুবেরী, মানিক চৌধুরীসহ কয়েকজন মিলে কাগজটা বের করতেন। সেখানেই ছাপার অক্ষরে প্রথম কবিতা।

রুদ্রাক্ষ রহমান : তারপর?  ইরাজ আহমেদ : তারপর থেকে চলছে।

রুদ্রাক্ষ রহমান: তো আপনি কবিতা না লিখলে বাংলা সাহিত্যের এমন কী ক্ষতি হতো? ইরাজ আহমেদ : আমি কবিতা না লিখলে বাংলা সাহিত্যের ক্ষতি হতো-কী-হতো-না জানি না। তবে আমার পাঠকের ক্ষতি হতো। বাংলা ভাষার অনেকে আমার কবিতা পড়েন। আমার কবিতা পড়তে চান। তারা বিভিন্ন মাধ্যমে আমাকে জানান যে, তারা আমার কবিতার জন্য অপেক্ষা করেন। আমার পাঠকের কথা ভেবে আমি বই করার পাশাপাশি ফেসবুকে কবিতা পোস্ট করি। আমি মনে করি ফেসবুক এখন দুনিয়ার সবচেয়ে বড়,বিস্তৃত প্রচার মাধ্যম। আর, আমি যেহেতু কবিতা নিয়ে, আমি আমার পাঠকের কাছে পৌঁছতে চাই। আসলে এখন টের পাই, কবিতা না-লিখে আমার কোনো উপায় ছিলো না।

রুদ্রাক্ষ রহমান : যতদূর জানি, ‘ফেলে আসা রুমাল’ আপনার প্রথম কবিতার বই। তারপর ‘পুড়তে থাকো বিজ্ঞাপনের আগুনে’। এরপর অনেকটা সময় আপনি কবিতা থেকে অনেকটা দূরে। অবশ্য এটাও বলতে হয়, ৩০ বছর সাংবাদিকতা করার পর আপনি স্বেচ্ছানির্বাসন বেছে নেন। কবিতার পাশাপাশি উপন্যাস, গল্পগ্রন্থ, অনুবাদ বই আছে আপনার। কিন্তু শীতে ভবঘুরে কাব্যগ্রন্থ দিয়ে দ্বিতীয় ইনিংস শুরু হলো আপনার এবং তখন থেকে তুমুল ফেসবুক যুগ। তাই তো? ইরাজ আহমেদ : অনেকটা তাই। সত্যের পেছনেও সত্যি থাকে। ঘটনার পেছনে যেমন কখনো কখনো আসল ঘটনা লুকিয়ে থাকে। কবিতার ক্ষেত্র থেকে যুদ্ধবিরতির বিষয়টা বহুদূর সাংবাদিকতা পেশার কারণেই। কবিতা আসলে একজন কবিকে ভিতর থেকে উদ্বাস্তু করে দেয়। হয়তো সেই উদ্বাস্তু অবস্থাটা আমার পেশার সঙ্গে সাংঘর্ষিক ছিলো, হয়তো জীবন তখন কবির জীবনকে অ্যাফোর্ড করতে চায়নি।

রুদ্রাক্ষ রহমান: আপনার প্রকাশিত শেষ কবিতার বই ‘লন্ড্রি মালিকের বড় ছেলে’। ‘জুয়াড়ি ও জলন্ত রুমাল’, অপূর্ব ডান্স স্কুলের মেয়েরা, বৃষ্টি আমাকে নেয়নি অন্তরা, আত্মহত্যার সামগ্রী, দরজা খোলো আফিমের দোকান- বইগুলো পাঠক গৃহীত কবিতায় ভরা। এবং আপনি তথাকথিত ‘জনপ্রিয়’ কবি না হয়েও পাঠকপ্রিয় এবং পাঠক সমাদৃত। এবং আপনি বাংলা সাহিত্যের জাদুকর কবি আবুল হাসান প্রভাবিত- ইরাজ আহমেদ : সচেতন এবং অসচেতনভাবে আমি স্বীকার করি, আমি আবুল হাসান প্রভাবিত। আসলে কবি আবুল হাসান মানুষটাকে না-দেখেও আমি ভালোবাসি, তার কবিতা আমাকে বিপুল আনন্দ দেয়। আমার অত্যন্ত প্রিয় তিনজন কবি জীবনানন্দ দাশ, বিনয় মজুমদার, ও উৎপল কুমার বসু। কিন্তু আমি আমার কবিতায় আমার নিজের কথাই বলতে চেয়েছি; চাচ্ছি। আমি মনে করি, কবিতার প্রথম লগ্ন থেকে আমরা সবাই মিলে একটি কবিতাই লেখার চেষ্টা করছি। যুগে যুগে দেশে দেশে কবিরা মিলে একটি কবিতাই লিখছেন। কবিতার এই প্রবাহমান ধারায় আমিও চলছি। আমার পরে অন্য একজন এসে এই প্রবাহে যুক্ত হবেন।

রুদ্রাক্ষ রহমান :কবি গার্সিয়া লোরকা নিউইয়র্ক গিয়েছিলেন। আমার জানা মতে অপনারও খুব প্রিয় শহর নিউইয়র্ক। আপনি ওই শহরে কবিতা খুঁজে পেয়েছেন? ইরাজ আহমেদ : কবিতা যে কোনো জায়গা থেকে উঠে আসতে পারে। তবে নিউইয়র্ক নিষ্ঠুর শহর। ওই শহর সবাইকে জায়গা দেয়, কিন্তু কারো হয় না। কাউকে সে আপন করে নেয় না। দ্বিতীয়বার নিউইয়র্ক ভ্রমণে আমি ভিন্ন একজীবনবোধ সংগ্রহ করেছি।

রুদ্রাক্ষ রহমান :এখন কী করে দিন যায়? ইরাজ আহমেদ : কবিতা লিখি আর জীবনকে যাপন করি।

রুদ্রাক্ষ রহমান : আপনার অর্থনৈতিক জীবন কেমন? ইরাজ আহমেদ : দেখুন, আমি নিজেকে একটি ভাড়াটে বন্দুক বলে ভাবি। বন্দুকবাজও বলতে পারেন। বাঁধাধরা চাকরি করি না। তবে বেঁচে থাকার জন্য নানান কিছু করতে হয় আমাকে। নাটকের স্ক্রিপ্ট থেকে শুরু করে বই অনুবাদ বহুকিছুই করতে হয় আমাকে। তবে এই ভাড়াটে বন্দুক কবিতাও লেখে।

রুদ্রাক্ষ রহমান : আর যদি কবিতা না লিখতে পারেন... ইরাজ আহমেদ : কোনো আপসোস থাকবে না। আমি ভেবে নেবো ওকে, আই অ্যাম ডান। তবে এটা বলি, সবকিছু আলগোছে পাশে তুলে রেখে আমি এখনো কবিতা পড়তে, কবিতা নিয়ে কথা বলতে এবং কবিতা লিখতে ভালোবাসি। এ নিয়ে বেশি মরিয়া উদগ্রীব, আনন্দ পাই। আই ফিল এক্সপ্লোসিভ। কবিতার চেয়ে সুন্দরতর কিছু নেই। হতে পারে না।