শিল্প ও সাহিত্য

ছোটগল্প || কৃষ্ণা তিথির চাঁদ 

খট খট শব্দে ঘুম ভেঙে যায় আমিনার। চোখ বুজেই সে আন্দাজ করার চেষ্টা করে শব্দটা ঠিক কোত্থেকে আসছে। গোয়াল ঘর থেকে কি? আবার চোর-টোর এলো না তো?... কিছুক্ষণ পর শব্দটা আবার হয়। দরজায়। খট খট খট। ঠিক তিনবার।  ভয়ে কয়েক মুহূর্তে শ্বাস নিতে ভুলে যায় আমিনা। ও খোদা! এই শব্দ যে আমিনার চেনা। কাঠের দরজায় ফের শব্দ হয়, খট খট খট।

আমিনার একপাশে ঘুমাচ্ছে সালাম। ওর স্বামী। আরেক পাশে দুই ছেলে। বড়টার বয়স ছয়, ছোটটার বয়স তিন। স্বামী সন্তানের মাঝে ভয়ে কাঠ হয়ে যায় সে। আবার শব্দ হয়। এবার জানালায়। জানালাটা বিছানার পাশেই। শরীর কাঁপতে থাকে আমিনার। যদি সালামের ঘুম ভেঙে যায়? সালাম অবশ্য ঘুমায় মরার মতো। আহা, সারাদিন অত খাটনি যায় মানুষটার। ঘুমাবেই তো। তাহলেও ঘুম যত গাঢ়ই হোক, নিশুতি রাতে কানের পাশে অমন শব্দ হলে ঘুম তো ভাঙতেও পারে।

আমিনা! আমিনা! অনুচ্চ কণ্ঠের ডাক শোনা যায়। আমিনা সন্তর্পণে বিছানা থেকে নামে। এলোমেলো চুলগুলো দিয়ে খোঁপা বাঁধে। দরজা খুলতে গিয়ে যেন থমকায়। সালাম না হোক, যদি ছেলেরা কেউ জেগে যায়? ছোট ছেলেটার তো রাতে দুই তিনবার ঘুম ভাঙে। আর শাশুড়ি বোধহয় আজকাল রাতের বেলা ঘুমায়ই না। রাতে যখনই কোনো প্রয়োজনে বের হয় সে, বুড়ির গলা শুনবেই। কে উঠল? বউ নাকি? 

বুড়ি এখন জেগে আছে কি না কে জানে! খট খট খট। এবার শব্দটা আসে দরজা থেকে। আমিনা আর আগ-পিছ ভাবে না। দরজা খুলে বের হয়। আকাশে কৃষ্ণা তিথির ক্ষয়া চাঁদ। ঝিঁঝির তুমুল চিৎকার যেন ঝাঁপিয়ে পড়ে তার কানে। চাঁদের আবছা আলোয় শাশুড়ির ঘরের দিকে তাকায় একবার। দরজা বন্ধ। তবু খানিকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে সে। যদি শাশুড়ির কোনো সাড়া পাওয়া যায়। না, ঝিঁঝির চিৎকার ছাড়া সারা বাড়িতে আর কোনো শব্দ নেই। বিড়াল পায়ে উঠোনের এক কোণে সফেদা গাছের ছায়ায় গিয়ে দাঁড়ায় আমিনা। ওখানে যে দাঁড়িয়ে আছে সে যে বারেক, শব্দেই বুঝেছে সে।

তুমি! চাপা স্বরে বলে আমিনা।  আইলাম। বারেকও নিচু স্বরেই জবাব দেয়।  প্রাণে কি একটুও ভয় নাই তোমার! যদি কেউ দেইখ্যা ফেলে? বিড়ালের আবার কাঁটার ভয়! স্বামী-সন্তান-সংসার সব নিয়া তুমি বড় সুখেই আছ আমিনা। এত রাতে বুঝি সেই সুখ কাইড়া নিতে আইছো? আমারে যতটা খারাপ মানুষ ভাবো তুমি, অতটা খারাপ আমি না আমিনা। তোমার সুখটা আমারই সুখ। বারেক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। একটুক্ষণ চুপ করে থেকে সে বলে, সালামের দোকান বোধহয় ভালই চলে। অমন চৌচালা ঘর তুলছে। উঠানে টিউবওয়েল বসাইছে। দিনের বেলা একবার আইছিলাম। তখন সব দেইখ্যা গেছি। তোমার সাহসটা চিরকালই বেশি। কী করতে আইছো এই রাইতে? কী চাও তুমি? তা মিছা না, সাহস ছিল এক সময়। এখন আর নাই। সাহস থাকলে রাতের বেলা চোরের মতন দেখা করতে আই। চোরের মতন! এখন বুঝি অইসব ছাইড়া দিছো?

অইটা তো শুধু আমার পেশাই না আমিনা, নেশাও। নেশা এমন জিনিস, রক্তে মিশ্যা থাকে! কেউ নিজের নেশারে অস্বীকার করতে পারে না। ...কিন্তু এখন সামর্থটা আর আগের মতন নেই। বাগাট বাজারে মিষ্টির দোকানে ক্যাশ ভাঙতে গিয়া একবার ধরা পইড়া গেলাম। শালা কর্মচারীডা যে দোকানেই ঘুমায় তা কে জানত। মাইরা ডাইন পাটা প্রায় ভাঙ্গাই দিছে। চিকিৎসা করাইছিলাম। ভালো মতন সারে নাই। এই জীবনে সারবোও না মনে হয়। হাঁটতে গেলে ল্যাংড়াইতে হয়।... জানো আমিনা, ফুপু গত শীতে মারা গেছে। বাড়িত এখন আমি একলাই থাকি। আমি কে তোমার, এত রাইতে আমারে এইসব শোনাইতে আইছো? আমিনার গলায় ঝাঁঝ। যাও তুমি। কেউ দেইখ্যা ফেললে বাম পাটাও ভাঙবো।

তুমি ধরাইয়্যা না দিলে কেউ দেখবো না! বারেক হাসে। অমন অল্প আলোতেও দেখতে পায় আমিনা। বারেকের হাসিটা আগের মতোই আছে। আমারে দশ হাজার টাকা দিতে পারবা আমিনা। খোদার কসম, এই একবারই। টাকাটা পাইলে আর কোনো সময় আসমু না তোমার কাছে। দশ হাজার টাকা! অত টাকা আমি কই পামু? টাকা পয়সা সব ছেলেগ বাপের কাছে থাকে। আর আমার কাছে টাকা থাকলেও দিতাম না। তুমি যাও। না হইলে আমি চেঁচাইয়্যা লোক জড়ো করমু। পারবা? কই, চেঁচাও তো দেখি। না পারার কী আছে। ডাকলেই স্বামী-শাউড়ি উইঠ্যা আসবো। পাড়ার লোক দৌড়ায়্যা আসবো। তুমি অনেক বদলাইয়্যা গেছো আমিনা! আগে এমন কঠিনভাবে কথা কইতা না। আচ্ছা আমিনা, তুমি কি সালামের সাথেও জোছনা রাইতে পদ্মার চরে বেড়াইতে যাও? আমার সাথে যেমন যাইতা? তা জাইন্যা তোমার লাভ কী? নাহ্ লাভ আর কী।... তা সিঁধ কাটার বিদ্যাটা এখনও ভুলি নাই। রাইতেরবেলা ঘর খালি কইরা ফেললে টেরও পাইতা না। তার বদলে দশ হাজার টাকাই তো চাইতাছি। তুমি আমার কাছ থাইক্যা কত টাকা নিয়া আইছিলা মনে আছে?

তুমি এই বাড়ি চিনলা কী কইরা? এতক্ষণে যেন প্রশ্নটা করার কথা মনে পড়ে আমিনার। চোরেরা দুই দশ গ্রামের সব বাড়িই চিনে। আর আমি সালামরেও চিনি। শাশুড়ির ঘরে খুক খুক কাশির শব্দ হয়। আমিনা বলে, শাউড়ি জাইগ্যা গেছে। বুড়ির কান বড় সজাগ। শব্দ শুনলে উইঠ্যা আসবো। যাও তুমি। কোন উপায় না পাইয়্যা তোমার কাছে আইছিলাম আমিনা। ফিসফিস করে বলে বারেক। একেবারে খালি হাতে ফিরাইয়্যা দিবা? ...আসলে আজকাল অইসব কাজ প্রায় ছাইড়াই দিছি। খাওয়ার টাকাটাও এখন হাতে থাকে না। কিছু টাকা পাইলে মুদি দোকানটা আবার চালু করতাম। বড় আশা কইরা আইছিলাম।... তা যাই আমি এখন। কাইল রাইতে না হয় আবার একবার আসমু। দশ হাজার না পারো, কিছু কমসম হইলেও দিয়ো। ভয় নাই, টাকাটা নিমু আমি ধার হিসাবেই। ফেরত পাইবাই। 

বারেক বাড়ির নামার দিকে হাঁটতে থাকে। আমিনা কলতলায় যায়। টিউবয়েলের হাতল নেড়ে ইচ্ছাকৃতভাবে শব্দ করে। কে! কলতলায় কে? শাশুড়ি তার ঘর থেকে চেঁচিয়ে ওঠে। মা, আমি। আমিনা সাড়া দেয়। পানি খাইতে উঠছি। আমিনার সত্যি পিপাসা পেয়েছে। গলা শুকিয়ে কাঠ। কল চেপে পানি খেয়ে ফের বিছানায় গিয়ে শোয়  সে।

আমিনার বিয়ে হয়েছিল উনিশ বছর বয়সে। বলতে কী, রমজান একটু  তাড়াহুড়ো করেই মেয়ের বিয়ে দিয়েছিল। বারেক নিজেই প্রস্তাবটা পেড়েছিল রমজানের কাছে। রমজান দেখল নির্ঝঞ্ঝাট ঘরেই যাচ্ছে মেয়ে। শাশুড়ি জীবিত নেই। দুই ননদ ছিল, তারা শ্বশুর বাড়িতে। চার চারটা মেয়ের বড়টাকে পার করতে পারলে মাথার বোঝা কিছুটা হালকা হয় রমজানের। ...তাই বলে মেয়েকে যে পানিতে ফেলে দিচ্ছে তা তো নয়। ছেলের নিজস্ব ভিটে আছে। ঘর আছে। কিছু চাষের জমি। বাড়ির সাথে পুকুর। বাজারে ছোটখাট একটা মুদী দোকান।... ছেলে আমিনাকে দেখে পছন্দ করেছে। দাবি দাওয়াও বিশেষ নেই। মেয়েকে কিছু গয়না দিলেই হবে। ভ্যানচালক রমজান মেয়ের জন্য এর চেয়ে ভালো ছেলে আর কোথায় পাবে?

ছেলের মুখে যা শুনেছে বিশ্বাস করেছে রমজান। গ্রামের মানুষকে একরকম না জানিয়েই বিয়ে দিয়েছে আমিনার। তা জ্ঞাতিগুষ্টি আর পড়শিদের ক’জনকে অবশ্য খাইয়েছে। সমাজে চলতে গেলে এইটুকু তো করা লাগেই। না, ছেলে মিথ্যে বলেনি। বারেক বউ নিয়ে ফেরার সময় আমিনার দুই চাচাতো ভাই গিয়েছিল সাথে। তারা বারেকের বাড়িতে ক’দিন থেকে এসেছে। বাড়ি ঘর নিজের চোখে দেখে এসেছে। মেয়ের শ্বশুরবাড়ি অবশ্য একটু বেশিই দূরে। তা হোক। বিয়ের পর তো মেয়ে থাকবে শ্বশুরবাড়িতেই। তার কাছেই কী, দূরেই কী।

গায়ের রং কালো হলেও চেহারাটা মন্দ নয় বারেকের। লম্বা চওড়া শক্ত সমর্থ শরীর। বোধহয় মাথায় একটু আধটু ছিট আছে তার। না হলে রাত-বিরাতে আমিনাকে নিয়ে পদ্মার চরে ঘুরতে বের হয়! ...জোছনা রাতে কোনও কোনও সময় বারেক তাকে নিয়ে পুকুরে গোছল করতেও নামে। তা বলতে কী, লোকটার অমনধারা পাগলামি খুব একটা খারাপ লাগে না আমিনার। বরং ভালোই যেন লাগে।

বারেকের বাড়িতে মানুষ বলতে এক বিধবা ফুপু। বেশ বয়স্ক। বুড়ি না পারে ভালো মতো হাঁটাচলা করতে, না পারে ভালো মতো কথা বলতে। আমিনা যে দুটো সুখ-দুঃখের কথা বলবে, এমন কেউ নেই বাড়িতে। আর বাড়িটাও যেন কেমন। গ্রামের একটেরে। আশপাশে কোনো বাড়িঘর নেই। এই সব কারণেই কি না কে জানে, বিয়ের পর বেশ ক’দিন বাড়ি থেকে বের হয় না বারেক। নতুন বউকে নিয়ে বুঁদ হয়ে রয়। তা যত আদর সোহাগই করুক, পুরুষ মানুষ দিনরাত ঘরে বসে থাকলে কোন বউয়ের ভাল লাগে? বাড়িত কি আমি দুই দিনের জন্য বেড়াইতে আইছি? না, বউ যখন হইয়্যা আইছি থাকমু তো সারাজীবনই। এইবার কাজেকামে একটু মন দেও। আমি আসার পর দোকানে তো একদিনও বসতে দেখলাম না।     বারেক আমিনার পাশেই শুয়ে শুয়ে পা নাচাচ্ছে। আমিনার কথা শুনে হাসে। বলে, দোকানে আমার কাজ কী! আমার সব কাজ তো রাইতের বেলা। বারেকের কথার ধরনে লজ্জা পায় আমিনা। তুমি কী কও তো! ফুপু না হয় হাঁটাচলা করতে পারে না। কানে তো শোনে। বারেক কিছু বলে না। মিটিমিটি হাসে।  কিন্তু না, আমিনা বুঝতে ভুল করেছিল। বারেকের কাজ রাতেই। দোকান আছে নামে। বারেকের পেশা চুরি করা! জানতে পেরে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে আমিনার। 

আর সব রাতের মতোই বারেকের পাশে ঘুমিয়ে আছে আমিনা। শেষ রাতের দিকে ঘুম ভেঙে যায় তার। তলপেটে প্রচন্ড চাপ। বিছানা হাতড়ে স্বামীকে জাগাতে যায় সে। কিন্তু বিছানা শূন্য। মানুষটা বোধহয় নিজেই বাইরে গেছে। অন্ধকারে বিছানায় শুয়ে অপেক্ষা করতে থাকে সে। অপেক্ষা একসময় আশঙ্কা হয়ে যায়। বাইরে এতক্ষণ কী করছে মানুষটা? ছটফটানির মধ্য দিয়েই রাত শেষ হয়। পাখি ডাকতে শুরু করলে ফিরে বারেক। নিজেই পেশা সম্পর্কে বলে আমিনাকে।  অনেক অনুরোধ-অনুনয় করেছে আমিনা। বারেককে চুরির পেশা থেকে ফেরানোর অনেক চেষ্টা করেছে। কান্নাকাটি করেছে বহুদিন। হাতে-পায়ে ধরেছে। কাজ হয়নি। চুরি ছাড়া নাকি আর কোনো কাজ জানে না বারেক।

বিয়ের দু’মাস পর।  একদিন সকালে মার খেয়ে ফেরে বারেক। উস্কোখুস্কো চুল। শরীরের এখানে-ওখানে ফেটে রক্ত পড়ছে। বাম চোখটা ভীষণ ফোলা। কোন রকমে বিছানায় গা এলিয়েই ঘুমিয়ে পড়ে সে।...বোধহয় সারাদিনই ঘুমিয়েছে। বা অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল বারেক। ঠিক জানে না আমিনা। বারেককে ঘুমে রেখেই ও চলে এসেছিল বাপের বাড়ি। একেবারে। আসার সময় গয়নাগাটি টাকা-পয়সা ঘরে যা ছিল সব নিয়ে এসেছিল। তা নিয়ে আসবে না-ই বা কেন? গয়নাগুলো তো আমিনার বাপই দিয়েছে। আর টাকা? বিয়েতে এরচেয়ে বেশি টাকাই খরচ হয়েছে রমজানের। আমিনাদের বাড়ির সবাই ভয়ে কাঁটা হয়ে রইল কয়েকদিন। কখন আবার বারেক এসে হাজির হয়। পাড়া পড়শিরা জানলে কী কেলেঙ্কারী হবে। মাস ছয়েক পরেও যখন এল না বারেক, কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়েছিল আমিনার বাপ-মা। আর বোধহয় আসবে না বারেক। না আসেওনি সে। ...জামাইয়ের সাথে বনিবনা হচ্ছে না, তাই মেয়েকে ছাড়িয়ে নিয়ে এসেছে। সবাইকে তাই বোঝায় আমিনার বাপ।

তা তখনই আমি কইছিলাম রমজান, ছেলের সম্পর্কে ভালো মতন খোঁজ না নিয়া হুট কইরা মেয়ের বিয়ে দিস না, আলাউদ্দি বলে। আমিনাদের পাশের বাড়িটাই আলাউদ্দির। সম্পর্কে আমিনার চাচা হয়। গ্রামের লোকেরা তো আমিনার জামাইকে ভালো মতন দেখলই না। তবে কপালটা ভালো আমিনার। বাচ্চা-কাচ্চা আসে নাই পেটে। সহজেই আবার বিয়া দিতে পারবি। এইবার ভালো মতন খোঁজখবর নিয়া আশপাশের গ্রামেই বিয়া দিস মেয়ের।

না, এবার ঘর-বর সব ভালো মতো দেখেই মেয়ের সম্বন্ধ ঠিক করে রমজান। মেয়ের শ্বশুরবাড়ি পাশের গ্রামেই। উঠোনে দাঁড়িয়ে উঁকি দিলে দেখা যায়। তা আমিনার তো সত্যি সত্যি ছাড়াছাড়ি হয়নি। আলাউদ্দির পরামর্শে মেয়েকে দিয়ে একটা তালাকনামা পাঠায় রমজান। সে তালাকনামা বারেকের কাছে ঠিকঠাক পৌঁছেছে কি না কে জানে! বারেক আস্ত একটা হারামজাদা। আমিনাকে সব সময় মারধর করত। ঠিকমতো ভাত-কাপড় দিত না। তাই মেয়েকে নিয়ে এসেছে। বিয়ের আগে সালামকে এসবই বলেছে রমজান। সালাম কিছু বলেনি। তারও তো এটাই প্রথম বিয়ে নয়। ...প্রথম বউটা কেন যে গলায় দড়ি দিয়েছিল কে জানে!

সারাদিন কাজে-কামে মন বসাতে পারে না আমিনা। মনের ভেতর সারাক্ষণই ভয়। তার তালাকের কাগজ বারেক পেয়েছিল কি না তা তো জানা যায়নি। যদি না পেয়ে থাকে তো আমিনা এখনও বারেকের বউ। টাকা না পেয়ে যদি দাবি প্রতিষ্ঠা করতে চায় বারেক? দিনটা যেন ফুরৎ করে চলে যায়। প্রায় মাঝ রাত হয়ে গেছে। এখনও ঘুম আসছে না আমিনার। বারেক তো বলে গিয়েছিল আজ রাতে আবার আসবে। যদি আসে? কী করবে আমিনা? সালামকে ডেকে তুলবে?

সালাম নিঃসাড়ে ঘুমাচ্ছে। পাশে শুয়ে মৃদু নাক ডাকার শব্দ পায় আমিনা। ছোট ছেলেটা ঘুমের মাঝেই একবার কেঁদে ওঠে। আবার ঘুমিয়ে পড়ে। ওঘর থেকে শাশুড়ি বোধহয় বের হয়েছে। দরজা খোলার শব্দ হয়।  কিছুক্ষণ পর আবার সব চুপচাপ। অন্ধকারে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখ লেগে এসেছিল আমিনার। তখনই খট খট শব্দটা হয়। বারেক শেষ রাতের দিকে যখন ফিরত, তখন এভাবেই আওয়াজ করত দরজায়। স্বামী-সন্তান-সংসার নিয়ে কত সুখে আছে আমিনা! এবার বুঝি সে সুখে শনির দৃষ্টি পড়ল! আরেকবার খট খট শব্দ হয় দরজায়। তারপর অনেকক্ষণ আর কোনো শব্দ নেই। বোধহয় দূরে সরে গেছে বারেক। দূরে গিয়ে অপেক্ষা করছে তার। স্বামীকে আস্তে আস্তে ঠেলতে থাকে আমিনা। সালামের কোনো সাড়া নেই। মানুষটা যে কী! ঘুমালে আর হুঁশ থাকে না। আরও বার দুই-তিন ঠেলে তবে সালামকে জাগাতে পারে আমিনা। গোয়াল ঘরের দিকে অনেকক্ষণ ধইরা খুটখাট শব্দ শুনতাছি, আমিনা স্বামীর কানে কানে ফিসফিস করে। ছাগলটাও একবার ডাকল। আবার চোর-টোর আইল নাকি? তুমি চুপচাপ মার ঘরের দরজা দিয়া বাইর হইয়্যা যাও। আইনুদ্দিন ভাই, রহমান ভাইগ ডাইক্যা আনো। 

সালাম নিঃশব্দে পাশের ঘরের দরজা দিয়ে বের হয়ে যায়। আমিনা একটু অপেক্ষা করে। ধীরে সুস্থে বিছানা থেকে নামে। দরজা খুলে বের হয়। সফেদা গাছটার নিচে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে। চাঁদের প্রায় নিভু নিভু আলোতেও বোঝা যায়। চেঁচাতে গিয়ে প্রথমটায় থমকায় আমিনা। গলায় যেন জোর পায় না সে। অবশ্য পরক্ষণেই গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে- চোর চোর বলে।

হোক না চোর, মানুষ তো। আহা! মানুষ মানুষকে এভাবে মারতে পারে? খবর পেয়ে সারা গ্রামের মানুষ ভেঙে পড়েছে আমিনাদের উঠোনে। মারতে মারতে সবাই বোধহয় ক্লান্ত। এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে। সালাম গেছে থানায় খবর দিতে। আরেকটু আগে গেলে কী এমন ক্ষতিটা হতো। বিদ্যুৎ নেই অনেকক্ষণ। টর্চ, হারিকেন, কুপির আলোতে উঠোনটা দিনের মতো আলোকিত। আমিনা অনেক আগেই ঘরের ভেতর এসে দাঁড়িয়ে ছিল। চোখের সামনের লোকজন একটু সরে দাঁড়ালে জানালা দিয়ে বারেককে দেখতে পায় সে। হাত দুটো পিছমোড়া করে বাঁধা বারেকের। গায়ে বোধহয় শার্ট জাতীয় কিছু ছিল। এখন ওটা ফালা ফালা। লুঙ্গিটাও কয়েক জায়গায় ছেঁড়া। নাক-মুখ দিয়ে চুইয়ে চুইয়ে রক্ত পড়ছে। কী আশ্চর্য! বারেক জানালার দিকেই তাকিয়ে আছে। 

চোখে চোখ পড়াতে, চট করে জানালার কাছ থেকে সরে আসে আমিনা। চোখ দুটো কেন যে জলে ভরে ওঠে তার!