রাইজিংবিডি স্পেশাল

সাদা চিনিতে রং ও রাসায়নিক মিশিয়ে লাল, বেশি দামে বিক্রি

মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলোর মধ্যে প্রথম হলো খাদ্য। কিন্তু, বর্তমানে নির্ভেজাল খাদ্য যেন সোনার হরিণ। ভেজালের তালিকায় যোগ হয়েছে চিনি। খাঁটি চিনি কিনতে গিয়ে ঠকছেন সাধারণ মানুষ। রং ও রাসায়নিক দ্রব্য মিশিয়ে সাদা চিনি লাল রঙের করে দেশি আখের খাঁটি চিনি হিসেবে বিক্রি করা হচ্ছে। সম্প্রতি এমন প্রতারণার দায়ে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করেছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তাদের অভিযান অব্যাহত আছে। ভেজাল চিনি খেলে ক্যান্সারসহ বিভিন্ন ধরনের রোগে হয় বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্বাস্থ্য সচেতন ক্রেতারা পরিশোধিত চিনির পরিবর্তে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন উৎপাদিত দেশি আখের লাল চিনি খান। কিন্তু, বর্তমানে চাহিদার তুলনায় বাজারে এ চিনির সরবরাহ কম। এ সুযোগে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী চিনি চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন উৎপাদিত আখের চিনির মোড়ক নকল করে কৃত্রিম রং ও রাসায়নিক দ্রব্য মিশিয়ে চিনি বাজারজাত করেছে। প্রতি কেজি দেশি চিনি ১১০ থেকে ১২৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সাধারণ মানের সাদা চিনি বিক্রি হচ্ছে ৯০-১০০ টাকায়। লাভ বেশি হওয়ায় সাদা চিনি লাল রঙের করে বিক্রি করছেন অনেক বিক্রেতারা।

শনিবার (২৯ অক্টোবর) রাজধানীর কারওয়ানবাজার, মিরপুর, যাত্রাবাড়ীসহ পুরান ঢাকার কিছু এলাকায় বাজার ঘুরে দেখা যায়, ক্ষতিকর রং ও কেমিক্যাল মেশানো চিনিতে দোকান ঠাসা। পুরান ঢাকার চকবাজার, মৌলভী বাজার, নয়াবাজার, আারমানিটোলায় বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন উৎপাদিত চিনির প্যাকেটের মতো খালি মোড়ক বিক্রি করা হচ্ছে।

যাত্রাবাড়ী বাজার থেকে দেশি লাল চিনি কিনেছেন রফিকুল ইসলাম। তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘বাসায় গিয়ে চিনির প্যাকেট দেখে সন্দেহ হয়। বাসায় চিনি করপোরেশনের কলে উৎপাদিত আগের প্যাকেটের সঙ্গে মিলিয়ে দেখি, আমার সদ্য কেনা চিনি গাঢ় লাল এবং প্যাকেটের গায়ে ছোট করে তিন তারা চিহ্নিত। এর পর দুটি আলাদা বাটিতে পানি নিয়ে তাতে চিনি দেই। বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন উৎপাদিত চিনির রং স্বাভাবিক হলেও নতুন কেনা চিনি গাঢ় লাল। দোকানির কাছে চিনি নিয়ে গেলে তার সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয়।’

যাত্রাবাড়ী কবির এন্টারপ্রাইজের মালিক নূর হোসেন বলেন, ‘চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন উৎপাদিত চিনির সরবরাহ অপ্রতুল। এ চিনি কোনোদিন পাওয়া যায়, কোনোদিন পাওয়া যায় না। অন্য কোম্পানি আখের খাঁটি দেশি চিনি নিয়ে আসে। চাহিদা বেশি থাকায় এবং লাল চিনিতে লাভ বেশি হওয়ায় তা বিক্রি করি। লেখাপড়া কম জানি। কোনটা আাসল, কোনটা নকল, তা বুঝি না। যারা ভেজাল দেয়, তাদের কঠোর শাস্তি দিলে ভেজাল কমবে।’ 

চিনিতে ভেজাল রোধে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর সেপ্টেম্বর মাসে এবং ১০ থেকে ১৫ অক্টোবর রাজধানীর কারওয়ান বাজার, মৌলভীবাজারে অভিযান চালিয়ে ৮০০ কেজি লাল চিনি জব্দ করে ধ্বংস করেছে। অভিযানকালে দোকানগুলোতে তীর, সতেজ, লাল কেয়া, ও খাঁটিসহ বিভিন্ন নামে লাল চিনি বিক্রি করতে দেখে পাইকারি বিক্রেতাদের সন্ধানে নামে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর।

কারওয়ানবাজারের মেসার্স এনায়েত স্টোরে পাওয়া যায় লাল চিনি। সেখানে অভিযান চালিয়ে ১০০ কেজি চিনি জব্দ করা হয়।  আসল না নকল, তা যাচাই করার জন্য চিনিতে পানি দিলে চিনি থেকে রং আলাদা হয়ে যায়। বিক্রেতার কাছে কোনো মেমোও পাওয়া যায়নি। তাই, ক্ষতিকর এসব চিনির প্যাকেট জনসাধারণের সামনে ধ্বংস করা হয় এবং প্রতারণার অপরাধে এনায়েত স্টোরকে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। এছাড়া, কারওয়ানবাজারের কিচেন মার্কেটের দ্বিতীয় তলায় আর এ এন্টারপ্রাইজেও ৫৯ বস্তা লাল চিনি পাওয়া যায়। এই প্রতিষ্ঠানকে সাত দিন দোকান বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয় এবং ভোক্তা অধিদপ্তরের কার্যালয়ে ডাকা হয়।

মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. এ এইচ এম সাইক রহমান বলেছেন, ‘বর্তমানে দেশের অধিকাংশ খাদ্যে ভেজাল দেওয়া হচ্ছে। কিছুদিন আগে এক অভিযানে দেখলাম, খাঁটি আখের চিনির নামে রং ও কেমিক্যাল মিশ্রিত সাদা চিনি বিক্রি হচ্ছে। রং মেশানো লাল চিনি খেলে বিভিন্ন ধরনের রোগ হতে পারে। এ ভেজাল চিনি শিশুদের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এসব চিনি খাদ্যে মিশিয়ে খেলে প্রথমে কিডনি আক্রান্ত হবে। উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগ হতে পারে। ক্যান্সারের ঝুঁকিও আছে। খাদ্যে ভেজাল রোধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’

এ বিষয়ে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেছেন, ‘নকল ও ভেজাল পণ্য তৈরি আগে থেকেই হতো। তবে, দাম বাড়ার কারণে কিছু ব্যবসায়ীর তৎপরতা আরও বেড়েছে। সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে অধিদপ্তর অভিযান চালাচ্ছে।’ 

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্পের যে লাল চিনি আছে, তার মতো করে সাদা চিনির মধ্যে টেক্সটাইল রঙ ব্যবহার করে লাল চিনি প্যাকেটজাত করে বিক্রি করা হচ্ছিল। এসব চিনি যারা প্যাকেটজাত করে বাজারে বিক্রি করছে, তাদের নির্ধারিত কোনো ঠিকানা প্যাকেটের মোড়কে নেই। এসব অবৈধ ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত থাকবে।’