রাইজিংবিডি স্পেশাল

বন্যা খরার পর ঘূর্ণিঝড়ে বাড়ছে কৃষকের দুশ্চিন্তা

‘সেচ সংকটের মধ্য দিয়ে অনেক কষ্টে আমন আবাদ করেছিলাম। আশা করেছিলাম, নিজের ক্ষেতের ধান থেকে পরিবারের পাঁচ মাসের খাবার সংগ্রহ করতে পারবো। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং-এর ধাক্কায় এ বছর আমি ধান পাবো না। চলতে হবে ধারদেনা করে।’

কথাগুলো বলছিলেন আবদুর রহিম মোল্লা। ৫০ বছর বয়সী এই কৃষকের বাড়ি বাংলাদেশের উপকূলের জেলা বরগুনার পদ্মা গ্রামে। সিত্রাং-এ ক্ষয়ক্ষতির কথা বলার সময় এই কৃষকের মনে পড়ে ২০০৭ সালে আরেক প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় সিডরের কথা। ১৫ বছর আগে সিডরের আঘাতে আবদুর রহিম মোল্লা ক্ষেতের সব ধান হারিয়েছিলেন।  

ছোট-বড় সব ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ কৃষকদের বিপর্যস্ত করে। এ বছর আগাম বন্যার পরে ছিল তীব্র খরা। বর্ষায় বৃষ্টি হয়নি। পানির অভাবে ধান চাষে বিলম্ব হয়। অনেক কৃষককে অতিরিক্ত ব্যয় করে জমিতে সেচ দিতে হয়েছে। বহুমূখী প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে ধান আবাদ করতে হয়েছে। সংকট থাকলেও এ বছর আমন ধানের ফলন ভালো হয়েছিল। কৃষকেরা আশা করেছিলেন, বেশি লাভবান হতে না পারলেও অন্তত নিজের ক্ষেত থেকে খাদ্যটুকু তারা সংগ্রহ করতে পারবেন। কিন্তু সিত্রাং কৃষকের সেই আশায় বালি ছিটিয়েছে।  

আবদুর রহিম মোল্লা একা নন, তার মতো আরো অনেক কৃষক সিডর থেকে সিত্রাং-এ ক্ষতির মুখে পড়েছেন। কৃষকেরা বারবার এভাবে ক্ষতির মুখে পড়েন এবং সেই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ঋণ নিয়ে চাষ করতে বাধ্য হন। কিন্তু প্রাকৃতিক বিপদ তাদের পিছু ছাড়ে না। ফলে ঘাটতি কাটিয়ে ওঠা কঠিন হয়ে পড়ে। কৃষকের ছোট ছোট ক্ষতির এজেন্ডাগুলোও থেকে যায় আলোচনার বাইরে।   

বরগুনা সদর উপজেলার মধ্যম গাজী মাহমুদ গ্রামের কৃষক ইদ্রিস আলীর নষ্ট সবজি ক্ষেত

অক্টোবর-নভেম্বর মাসের ঘূর্ণিঝড়গুলোতে কৃষকের ক্ষতি হয় সবচেয়ে বেশি। কারণ এ সময় মাঠে থাকে কৃষকদের প্রধান ফসল আমন। আবদুর রহিম মোল্লার ক্ষেতের ধান সিত্রাং-এর আঘাতে মাটিতে নুয়ে পড়েছে। একই অবস্থা কৃষক জালাল হাওলাদারের। কিন্তু রিপন মোল্লার ধান ক্ষেত পুরোপুরি পানির তলায় ডুবে আছে।

নভেম্বরে অনুষ্ঠেয় জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলন কপ২৭-এর মাত্র ১২ দিন আগে বাংলাদেশে লস অ্যান্ড ড্যামেজের দৃষ্টান্ত রেখে গেল সিত্রাং। এ বছর সম্মেলনের আলোচ্য বিষয়গুলোর মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে লস অ্যান্ড ড্যামেজ গুরুত্ব পাবে। বাংলাদেশ এ বছর রেকর্ড বন্যা এবং রেকর্ড খরা মোকাবিলা করেছে। মে এবং জুন মাসে দুই দফা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল উত্তরপূর্ব অঞ্চলের ৭ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ। এর পরই খরায় বিপর্যস্ত হয় আমন চাষাবাদ। সরকারি তরফে জানানো হয়েছে এ বছর ডিসেম্বরে আরো একটি সাইক্লোন আঘাত করতে পারে বাংলাদেশে। যদিও সিত্রাং-এর ক্ষয়ক্ষতির পূর্ণাঙ্গ সরকারি হিসাব এখনো পাওয়া যায়নি। পেতে আরো দুই সপ্তাহ লাগবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ সরকারের দুর্যোগ ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান এমপি। সংবাদ সম্মেলনে তিনি প্রাথমিক ক্ষয়ক্ষতির হিসাব তুলে ধরে বলেন, ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং-এর আঘাতে বাংলাদেশের ৪১৯টি ইউনিয়ন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১০ হাজার ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সরকারি তালিকায় মৃতের সংখ্যা ৯ জন, তবে বেসরকারি পরিসংখ্যানে মৃতের সংখ্যা ৩৫ জন। 

খরায় শুরু, ঘূর্ণিঝড়ে শেষ 

ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং-এর পরে বাংলাদেশের উপকূলের বিভিন্ন গ্রামে ধানের ক্ষতির ছবি চোখে পড়ে। বরগুনা সদর উপজেলার নলটোনা ইউনিয়নের গ্রামের পর গ্রাম আমন ক্ষেত পানির নিচে ডুবে আছে। একই ছবি চোখে পড়ে বরগুনা সদর উপজেলার বদরখালী ইউনিয়নের গ্রামগুলোতে। শুধু ফসলের ক্ষেত নয়, ওইসব গ্রামের বহু বাড়িঘর এখনো পানির নিচে। উপকূলের অন্যান্য জেলার কৃষকও সিত্রাং-এর পরে আমনের ফলন নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন।    

কৃষক ইদ্রিস আলী হাওলাদারের আমন ক্ষেত তিন ফুট পানির নিচে ডুবে আছে 

বরগুনা সদর উপজেলার মধ্যম গাজী মাহমুদ গ্রামের কৃষক ইদ্রিস হাওলাদার বলেন, ‘এ বছর আমার চাষাবাদের সংকটের শুরু হয়ে খরায়। এরপর অসময়ে ঘূর্ণিঝড় সবকিছু শেষ করে দিয়ে গেল। আবার আমরা লোকসানের মুখে পড়লাম। এখন আবার ধারদেনা করতে হবে।’

কৃষক ইদ্রিস আলী হাওলাদার বলেন, ‘এখন ধান পুষ্ট হওয়ার সময়। এ সময় ধান ক্ষেতে সর্বোচ্চ পানি থাকার কথা ছয় ইঞ্চি। কিন্তু সিত্রাং-এর পরে এখন ধান ক্ষেত আড়াই থেকে তিন ফুট পানির নিচে। এই পানিতে ধান পচে যাবে।’

বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র বলেছে, সারাদেশে ৫৬ দশমিক ৫৭ লাখ হেক্টর জমিতে আমন চাষ হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ১১ লাখ হেক্টর ছিল দেশের তিনটি উপকূলীয় বিভাগ চট্টগ্রাম, খুলনা ও বরিশালে। পানির সংকট থাকলেও অতিরিক্ত ব্যয় করে কৃষক আমন আবাদ করেছেন। কেননা, আমন থেকে তার বাৎসরিক খাদ্যের বড় অংশের যোগান আসে।  

বাংলাদেশের বৃষ্টিনির্ভর ফসল আমন। এটি বাংলাদেশে উৎপাদিত মোট শস্যের ৩৯ শতাংশ। আমন উৎপাদন বর্ষার বৃষ্টির উপর অনেকাংশে নির্ভর করে। কিন্তু এ বছর বর্ষাকালে ছিল ভিন্ন ছবি। প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে কৃষক সময়মত আমন আবাদ করতে পারেননি। বরগুনার কৃষক ইদ্রিস আলী হাওলাদার এ বছর তার জমি আবাদের জন্য ৩০ হাজার টাকা খরচ করেছেন। বর্ষাকালে পানি না থাকায় তার অতিরিক্ত খরচ হয়েছে ১০ হাজার টাকা। অতিরিক্ত খরচ করার পরেও আমন ধান ঘরে তোলা নিয়ে তিনি শঙ্কায় আছেন। সিত্রাং-এর পর থেকে তার অধিকাংশ ধান ক্ষেত এখন পানির তলায়। ধানের মতো  শীতকালীন সবজিতেও ক্ষতির মুখে পড়েছেন ইদ্রিস।  

প্রাকৃতিক বিপদ ক্রমেই বাড়ছে 

জলবায়ু সংকটের যারা বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হন তারা এখন আরো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। তাদের ক্ষতির পরিমাণ প্রতি বছর বাড়ছে। দেশের উপকূলের সামনের সারিতে থাকা মানুষগুলোই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন। ভোলা জেলার চরফ্যাসন উপজেলার বিচ্ছিন্ন দ্বীপ ঢালচর-এর বাসিন্দা সিরাজুল ইসলাম তাদেরই একজন। সিত্রাং-এর আঘাতে তার ঘরের সব মালামাল ভেসে গেছে। শুধু ঘরের চালা দাঁড়িয়ে আছে। পরিবারসহ সিরাজুল ইসলাম দ্বীপে সরকারি কলোনিতে নিকট আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। 

ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত ধান ক্ষেত। ছবিটি বরগুনা সদর উপজেলার বদরখালী গ্রাম থেকে তোলা    

সিরাজুল ইসলামের বাড়ির কাছেই ছিল নূরন্নবী মাঝির বাড়ি। তার ঘরও ভেসে গেছে। পরিবারের ৬ সদস্য নিয়ে তিনি অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। দ্বীপ ঢালচরের এই মানুষেরা আগে অনেক নিরাপদে ছিলেন; যখন সেখানে নদীর ভাঙন শুরু হয়নি। প্রাকৃতিক বিপদগুলো তখন তাদের ততটা ক্ষতি করতে পারেনি। বাড়ি থেকে নদী ছিল অনেক দূরে। কিন্তু এখন স্বাভাবিক জোয়ারের পানিতেও তারা ঝুঁকির মুখে থাকে। 

দ্বীপ ঢালচরের বাসিন্দা শরীফ সওদাগর বলেন, ‘এই দ্বীপের মানুষেরা সব সময়ই ঝুঁকিতে থাকে। আগের চেয়ে এখন প্রাকৃতিক বিপদের ঝুঁকি অনেক বেশি। সব প্রাকৃতিক বিপদ মোকাবিলা করেই আমাদের টিকে থাকতে হয়। সিত্রাং-এ এই দ্বীপের সব বাড়ি উচ্চ জোয়ারের পানিতে ডুবেছে।’

সিত্রাংয়ের তাণ্ডবে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা উপকূলে প্রায় তিন শতাধিক কাঁচা ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হওয়ায় চট্টগ্রাম নগরের দক্ষিণ হালিশহর, উত্তর পতেঙ্গা ও দক্ষিণ পতেঙ্গা এলাকায় বহু এখন খোলা আকাশের নিচে। স্থানীয় বাসিন্দা চম্পা রানী জলদাশ বলেন, ‘রাত সাড়ে ১০টায় ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। আমি তিন সন্তান নিয়ে বেড়িবাঁধে আশ্রয় নিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম ঘূর্ণিঝড়ের পর বাড়ি ফিরবো। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় আমাদের সব কিছু ভাসিয়ে নিয়েছে। খাবার-পোশাক কিছুই পাইনি। আমার স্বামীর প্রায় লাখ টাকার মাছ ধরার জাল ভেসে গেছে।’

সিত্রাং-এর পরে বরগুনা জেলার বদরখালী ইউনিয়নের দ্বীপ মাঝেরচরের মানুষগুলোর কষ্টের সীমা ছাড়িয়ে গেছে। ফসলি মাঠ, রাস্তা, বাড়ি ডুবে আছে পানির তলায়। ওই দ্বীপের জীবিকার প্রধান অবলম্বন বর্ষাকালীন ধান, শীতকালীন ফসল এবং নদীর মাছ। কিন্তু এই তিন ক্ষেত্রেই বহুমূখী সমস্যা। ফলে উপার্জন কমে যাচ্ছে। সিত্রাং-এর পরে এ বছর ওই দ্বীপে অনেকেই শীতকালীন ফসল আবাদ করতে পারবে না।   

দ্বীপের বাসিন্দা বাচ্চু দফাদার বলেন, ‘সাইক্লোন সিত্রাং-এর প্রভাবে এখন এই দ্বীপের অধিকাংশ এলাকা পানির নিচে। অনেকে শীতকালীন ফসল আবাদ শুরু করেছিল। কিন্তু সিত্রাং সব ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। আমরা এই দ্বীপের মানুষেরা সরকারি সুযোগের দিক থেকে শেষের সারিতে এবং প্রাকৃতিক বিপদের দিক থেকে প্রথম সারিতে। দ্বীপের মানুষদের রক্ষা করতে হলে শক্ত বেড়িবাঁধ নির্মাণ করতে হবে।’

বরগুনা সদর উপজেলার গুলিশাখালী মাঝের চরের কৃষক মো. শাহীনের টমেটো ক্ষেত এখন পানির তলায়

সিডর থেকে সিত্রাং

চলতি শতাব্দীতে (২০০১-২০২২) বাংলাদেশে ১২টি ঘূর্ণিঝড় আঘাত করেছে। ২০০৭ সালে ধ্বংসাত্মক সুপার ঘূর্ণিঝড় সিডর আঘাত করে বাংলাদেশের উপকূলে। এর মাত্র দুই বছর পরে ২০০৯ সালে আঘাত করে ঘূর্ণিঝড় আইলা। ২০১৩ সালে মহাসেন, ২০১৫ সালে কোমেন, ২০১৬ সালে রোয়ানু, ২০১৭ সালে মোরা, ২০১৮ সালে তিতলী, ২০১৯ সালে ও বুলবুল, ২০২০ সালে সুপার ঘূর্ণিঝড় আম্ফান, ২০২১ সালে ইয়াস এবং সর্বশেষ সিত্রাং বাংলাদেশের উপকূলে আঘাত করে। 

ঘন ঘন সাইক্লোনের কারণে বাংলাদেশের উপকূলের বহু মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত। প্রতিটি সাইক্লোনের পরে অনেক পরিবার বাস্তুচ্যুত হতে বাধ্য হয়। ঘূর্ণিঝড়ে জান-মালের ক্ষতি কমিয়ে আনতে নানামূখী পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। এর ইতিবাচক ফলও পাওয়া গেছে। ঘূর্ণিঝড় ব্যবস্থাপনায় বিশ্বে রোলমডেল বাংলাদেশ। কিন্তু এখনো ঘূর্ণিঝড় ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের অনেক কিছু করার আছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। 

জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ডক্টর আইনুন নিশাত বলেন, ‘সাইক্লোন থেকে মানুষের জীবন ও মালামালের নিরাপত্তার জন্য আমাদের আরো কাজ করতে হবে। সমগ্র উপকূলের বেড়িবাঁধ নির্মাণ করতে হবে। বেড়িবাঁধ শক্ত ও উঁচু করতে হবে। সাইক্লোন শেলটার ব্যবস্থাপনা উন্নত করার উদ্যোগ নিতে হবে।’ 

আইনুন নিশাত আরো বলেন, ‘বাংলাদেশে সাইক্লোন সতর্কীকরণ সংকেতগুলো দেওয়া হয় বন্দর-ভিত্তিক। এই সতর্কীকরণ সংকেতগুলো অধিকাংশ মানুষ বুঝতে পারে না। সতর্কীকরণ সংকেতগুলো এলাকা-ভিত্তিক দেওয়া হলে মানুষ সহজে বুঝতে পারে। সাইক্লোনটি কোন গ্রাম বা কোন উপজেলায় আঘাত করবে, সাইক্লোন সতর্কীকরণ সংকেতে সেই তথ্য বলা উচিত।’ 

‘বাংলাদেশে সাইক্লোনগুলো আঘাত করার সময় মাঠে ফসল থাকে। এ কারণে সাইক্লোন সতর্কীকরণ সংকেতের সঙ্গে কৃষি মন্ত্রণালয়কে সংযুক্ত করা উচিত। কেননা, কৃষকদের করণীয় বিষয়গুলো কৃষি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা ভালোভাবে ব্যাখ্যা করতে পারবেন।’ যোগ করেন এই জলবায়ু বিশেষজ্ঞ।