শিল্প ও সাহিত্য

নোবেলজয়ী আনি এরনোর উপন্যাস: চতুর্থ পর্ব

আমি প্রিয়তম বন্ধু মনেটের সঙ্গে খেলি, ক্লোপার্ত মহল্লার অন্যরাও থাকে। আমরা সবসময় শুরু করি একটা ঘর বানিয়ে। তারপর পাগলের মতো খুঁজতে থাকি একটা ভাঙা সসপ্যান, ধাতব টুকরা-টাকরা, কাঠের বাক্স বিছানা বানানোর জন্য আর কাপবোর্ড। খাবারের ছোট্ট আয়োজনে তৈরি হয় চিজের টুকরা, কিসমিস, বাদামের বরফি, টফি, এগুলো একত্রে ঠেসে দেই ভাঙা সসপ্যানে। বন্ধুদের মধ্যে আনন্দের চিৎকার শোনা যায়। কিন্তু আমি তো দায়িত্বপ্রাপ্ত, আমি তো বসের কন্যা... আমরা পুরো দুপুরটা খরচ করি ঘর তৈরি করতে, আমরা এখানে শোয়ার জন্য এ সব করি না। আমরা ঝগড়া করি, একজন মা কেনাকাটা করতে বের হয়, তার মেয়েকে সঙ্গে নেয় কিংবা আমার বন্ধুকে আর তারপর বারের মধ্যে যেসব ঘটে সেগুলো চলতে থাকে। ‘এদিকে আসো, দেখো মার্টিন বুড়োটা মাতাল হয়ে গেছে, চলো ওর উপরে থুতু ফেলি।’ 

আমি গর্বিত যে আমার বন্ধুরা এখানে তাই করতে পারে যা বাড়িতে করতে পারবে না। ওদের নিজেদের বাবা যখন মাতাল হয় তখন তো এসব করতে পারে না। ওয়াইন স্টোর রুমের আড়ালে লুকিয়ে, আমরা দেখি কে সবচেয়ে দূরে থুতু ফেলতে পারে। আর মার্টিন তো তখন টাল খাচ্ছে, অন্যমনস্ক চকচকে থুতু ছিটকে পড়ছে তার ভারী জ্যাকেটে। আমরা প্রায়শই মাতাল হওয়ার খেলা খেলি। আমরা একে অপরকে লাথি মারি, ব্যথা পাওয়া নিয়ে আমরা কিছু মনে করি না, আমরা তেমন ব্যাটা হওয়ার চেষ্টা করি যে তার বউকে পেটায় আর দুনিয়ার সব নাম ধরে ডাকে। ‘কুৎসিত... কুত্তি, খানকি!’ 

মনেট হাত ঝাকায় আর হাতটা মুখের মধ্যে রেখে ভয়ঙ্কর ভাবভঙ্গি করে... ‘তুমি জানো এসব কথার মানে কী? এই, বলো আমাদের!’ আমি বুঝিয়ে বলি। ‘একটা মেয়ে বিয়ে ছাড়া বাচ্চা পয়দা করলে এ সব বলে।’ মনেট তার মাথা ঝাকায়। হাত পেয়ালার মতো করে, আমার কানে ফিসফিস করে ভয়ঙ্কর সব কথা বলে যা আমি অন্য মেয়েদের কানে বলি, আর সবাই রক্তিম হয়ে ওঠে, মাটিতে বসে থাকে, আমরা আমাদের সব জ্ঞান বের করে দেই, আজব সব গল্প, ভয়ঙ্কর বিস্তৃত করে বলি, বড়দের এমন কোনো কাজ নেই যা আমরা গোপনে দেখিনি। আমরা এসবই চেষ্টা করি, আকস্মিক জবুথবু আর অসাড় অনুভূতি পিছলে নামে যতোক্ষণ না হাত তুলে ধরে উঁচুতে, ভয় পাই, আর আর চোখ বিস্ফোরিত হয় একগুচ্ছ কালো চুল প্রথম দর্শনে, যা মনেট স্বগর্বে আমাদের দেখাচ্ছে। 

‘তুমি একটা ভাগ্যবতী মাল গো!’ সন্ধ্যা নামে, একে একে ওরা বাড়ি যায়, যখন ওদের বাবারা বার ছাড়ে আর ওদেরকে সঙ্গে নিয়ে যায় কিংবা তাদের মায়েরা যখন দুধ আর সদাইপাতি নিতে আসে। বাচ্চাদের শপিং ব্যাগ বহন করতে হয়। আমি রয়ে যাই। দোকানের দেয়ালে বল ছুঁড়ে খেলতে থাকি, আমাদের সড়কে কোন যানবাহন নেই বলা যায়, কিংবা আমি তাড়াহুড়া করে ছবি বই দেখি, তারপর চলে যাই আর মুরগিগুলোকে খাবার দেই। সুখের সময়। ‘ডেনিস, আমি তোমার সাথে আর খেলতে যাচ্ছি না।’ মনেট একটু দূরে বসে তার ঝাকড়া কোকড়া চুলের আড়ালে নিজেকে লুকায়। একটা ছিপিতে আটকে থাকা পিনের মধ্যে সে উলের সুতা দিয়ে বেণী বানাচ্ছে। বেণী লম্বা হতে থাকে আর তার হাঁটু পর্যন্ত লম্বা হয়। রেগে আছে, আমার সঙ্গে আর কথা বলছে না ও। আমি ওকে একা রেখে যাবো... মসৃণ, চকচকে চুলের কুণ্ডুলি যা কখনোই আমাকে স্থির থাকতে দেয়নি। আমার চুল একদম সোজা। ও আমার দিকে জিভ দেখায়, আহা চুলের বাকানো পাকগুলো সব একটা আরেকটার উপরে বড়াই করে, চির চকচকে আর কৃষ্ণতর, আমাকে উত্তেজিত করে। আমি কেবল তার ঘন কালো কোকড়া চুল দেখতে পাই। আমি নিজেকে ওর দিকে ছুঁড়ে ফেলি, আমি টেনে মুখোভর্তি পিচ্ছিল ছোট্ট সাপগুলো ধরি, আর মোচড় দেই, হেঁচকা টান দেই, আমি পরম আনন্দে ওই চুলগুলোকে জট পাকাই। ‘দেখছো, তোমার চুল নিয়ে আমি কী করতে পারি!’

সে মুখ খোলে আর এক ইঞ্চি না-নড়েও জোরে চিৎকার দিয়ে ওঠে। তার কপালের প্রান্তের পাশে, ছোট্ট ঢিবির মতো যেখানে আমি টানছি চামড়ার আড়ালে হলুদ ছোপ দেখা যায়, যেখানে চুলের গোড়া দেখা যায়। ‘আমি এটা টেনে ছিঁড়ে ফেলবো!’ ‘আমি তোর মাকে বলে দিচ্ছি।’ সে ছুটে যায় চিৎকার করতে করতে। আমি ওর কাঁধের কাছে টাকের ছোপের মতো দেখতে পাই যেখানে অলোকগুচ্ছ ছিলো। ‘এটা হতে বহুদিন লাগবে! মেলাদিন তোমারে বোকা বোকা লাগবে!’ তবে, আমি কিন্তু ভয় পেতে থাকি। আমার বাবা আর মা এখানে আসার আগেই আমি বেশি অপেক্ষা করি না, আর বাইরের বাড়িতে গিয়ে লুকাই। চুলের কুণ্ডুলিটাকে খুলি ধীরে পায়খানার প্যানে ছেড়ে দেই পুরনো সব বিষ্ঠার মাঝে। ওটা আটকে যায়, আমি ফ্লাশ করে দেই, এটা ভাসতে থাকে, বড় একটা মাথা কাটা পোকার মতো। আমি দরজার হীরক খণ্ডের মতো ফুটোটা দিয়ে চোখ রাখি আর নিজের হৃদপিণ্ডের শব্দ শুনতে থাকি, ভয় আর তৃপ্তিতে... সে আসুক বরং আর পায়খানা থেকে তার কোকড়া চুল উদ্ধার করে নিয়ে যাক...  

রবিবারগুলো অন্য দিন থেকে আলাদা, যেমন সোনা আলাদা রূপা থেকে। নারী, পুরুষ, ঝকঝকে, দশটায় একত্রিত, ধুপের ধোঁয়ায় আবৃত, যা দুটো বালক সাদা আলখেল্লা পরে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে, মাথাগুলো নিচের দিকে। ওদের দেখে মনে হয় ওরা যেন মেঘের উপরে হাঁটছে, যেন ওদের রয়েছে ধোঁয়ার ডানা। ‘চার্চে কোনো কথা নয়!’ আমার মা, তার কালো ফিটফাট স্যুটে, গোলাপি ব্লাউজ আর সুগন্ধি পরে আছে। আমার হাঁটু ব্যথা করে, উরু ব্যথা করে, চার্চে আনন্দ আর ব্যথা সবসময় এক হয়ে থাকে আর আমি প্রার্থনার একটা বাক্যও বুঝতে পারি না, গুণগুণ করে পরা মন্ত্রগুলোও বুঝি না। ‘ক্রশের পাশে আইসা দাঁড়াও...’ ওরা বলে যেতে থাকে, মম... বৈধতা... ধুপদানকারীর বয়স্কজন ঘুরে যায়, ওকে রঙিন কাচের জানালায় আঁকা আলখেল্লা পরা নারী বা পুরুষদের মতোই দেখায়।

‘প্রভুর প্রতি প্রচুর প্রার্থনা করো।’ আমি সাদা পোশাকের লম্বা ছেলেটাকে দেখতে দেখতে গর্ভ, পাপ আর ফল বিষয়ক আমার প্রিয় প্রার্থনাগুলো মনে করার চেষ্টা করি। কপালে ক্রশের সের চিহ্ন আঁকা, মুখে আর বুকেও, আমি হেসে দেই কিছু লোক পিছনে পড়ে গেছে দেখে, আমি ওর ঝুলিয়ে দেয়া দেখতে পাই, হাঁটু গেড়ে বসি। আমি আশা করতে থাকি যদি চেনা কাউকে পাওয়া যায়, আমাদের দেকানের ক্রেতারা চার্চে যায় না, বারোটা এখন পুরো খরে আছে আর আমার বাবা তাদেরকে মদ পরিবেশন করছে, সেও চার্চে যায় না। বেমানান ক্রেতাগুলো কখনো চার্চের পেছন দিকে আসে, বিশেষ করে সকল সন্তদের পবিত্র রবিবারে। 

‘শুভ দিন, মাদাম লেস্যু, আপনাকে দারূণ দেখাচ্ছে, নিনিস, আপনার রবিবারের সেরা ভঙ্গি!’ আমি খুশিতে ফুলে উঠি। অন্যরা কখনোই এতো ভালো পোশাক পরে না, এমনকি মনেটও না। যখন সবাই গাইছে, সামনের গ্রীবা, বলিরেখা, সাদা চুল, গিট দেয়া স্কার্ফ, বিরাট খোপা বাধা চুল যেবন ঝিনুক আটকানো আছে এইসব দেখে আমি আনন্দ পাই... নারীরা বেদী ভরে ফেলেছে... তারা ফিরে আসে, তাদের ঠোঁট আটোসাটোভাবে বন্ধ, আর আমি অবাক হয়ে ভাবতে থাকি তারা কেমন করে কাউকে না-দেখিয়ে সাদা কাগজের একটু টুকরো গিলে ফেলে। মনেটের সঙ্গে একটা ভালো গেম খেলা যায়, একটা মদের পাত্র, লন্ড্রিতে দেয়ার জন্য ময়লা কাপড়ের ঝুরি থেকে জোগার করা একটা নাইটগাউন আর ধুপের বদলে ময়দা নিয়ে... প্রথম কামড় আর ক্রিমের ফোয়ারা তোমার জিভের ভেতর, স্ট্রবেরির টক, খোঁচা খোঁচা ছোট্ট লাল পাহাড় যেন, সব গাদাগাদি করে আছে যেন ছোট্ট একটা নৌকায়, না-খেয়ে ওদেরকে মুখে রেখে দেয়ার চেষ্টা করো, একটা কেকের স্বপ্ন যা স্থায়ী হবে চিরকালের জন্য। তোমার মুখ জলে ভরে উঠবে। শোভাযাত্রা চলতে থাকে, ধীরে, লম্বা বেদীর উপরের বালকটিকে সন্তের মতো মনে হয়।

পরের রবিবার, আমি আমার মাকে আরো কাছে এগুতে দেবো, যেখানে ওরা হাঁটুর উপরে প্যাড রেখে বসে আর ধূপের ধোঁয়া একদম মুখের উপরে এসে পড়ে। চার্চ হলো কল্পনার সবচেয়ে সুন্দর আর পরিচ্ছন্ন বাড়ি। আমরা যদি কেবল সেখানে খেতে, ঘুমাতে আর টয়লেট করতে পারতাম তাহলে কখনো ওই জায়গা ছাড়তাম না। আমরা সবাই চার্চের লম্বা বেঞ্চিতে লাইন দিয়ে থাকতাম, আমরা মাঝখানের সারি ধরে সাইকেল চালাতে পারতাম আর পিলারগুলোকে ঘিরে লুকোচুরি খেলতে পারতাম। কেবল আমি আর আমার বন্ধুরা আর বেদীর সেই সাদা পোশাক পরা বালকটি যে আমাদের খাওয়াতো, আমাদের পাশে শুয়ে থাকতো... বড় বাড়ি আর পরিপাটি আঙিনা। বেদনাদায়ক। আমরা কাউকে এমন চিনি না। আমার চোখে ধূসর সাইডওয়াক দিয়ে  চকচকে ফুটকির মতো দেখা যায়, রু ক্লোপার্ত, বহুদূরে, একদম প্রায় শহরের শেষপ্রান্তে। 

অবশেষে আমরা ছোট ছোট বাড়িগুলোর দিকে আসি যেখান থেকে মাতালরা ইতোমধ্যেই বেরিয়ে আসছে। ‘দেখো ওদের! সকাল এগারটাতেই ওদেরকে বের করে দেয়া হয়েছে!’ আমার বাবা-মা ভালো বারের মালিক, মার্জিত লোক। আমি বিরক্ত হয়ে বোতেতের দিকে তাকাই। আমার বাবা-মা অনেক ভালো, তারা সুন্দরভাবে মদ বিক্রি করেন, তারা কারো উপরে বাড়তি চাপ প্রয়োগ করেন না। রাস্তা জেগে উঠছে, নর্দমায় নিশ্চয়ই তোমার পা দেয়া ঠিক হবে না, একটা কলের ঝরনায় চাপ দিলেই ফোয়ারা ছুটবে, কেউ একজন পা কাটা লোক, সাটারগুলো নেমে যাচ্ছে, মাথা নিচু করে, কয়লা নিয়ে একটা ভূর্গভস্থ ভাড়ারের দিকে যাচ্ছে একজন, হাতড়ে হাতড়ে উঠছে, ভীত, আমার আকাশী নীল পোশাক, জাপটে ধরে আছি প্রার্থনা বই আর সাদা হাত মোজা দিয়ে... আর সাইকেল সারানোর দোকানের লোকটা সাইকেলের চাকার ফাঁক দিয়ে স্পোক পার হয়ে আমাদের যাওয়া দেখছে। সব সময় উবু হয়ে আছে ওখানে, নাকটা তার স্কার্ট বরাবর, প্লাস আর চিমটা হাতে। ‘নোংরা বুইড়া কোথাকার!’ মা গজগজ করে বলে। ওর মাকড়শার মতো ছোট্ট চোখ দুটা আঠার মতো লেগে আছে মায়ের মোজার কালো প্রান্তের দিকে যেখানে উপরের দিকে ক্রমশ প্রশস্ত হয়ে উঠছে সব কিছু। আমরা দূরে সরে যাই আর মা যে কোন গ্রাহক পেলেই থেমে কথা বলে, বিশেষ করে যদি তারা আমাদের দোকান থেকে কোন জিনিস কিনে এনে থাকে। তারপর আমরা বাড়িতে, অনাকাঙ্খিত স্বাগতম, ‘এই যে মাদাম ল্যাসু ফিরে এসেছেন পার্দ্রীর সঙ্গে খাতিরানা করে। খাড়াও, বসকে বলি!’ আমার মা আমাকে রবিবারের সেরা পোশাকটি খুলে ফেলতে বলেন। সকালের আনন্দের এখানেই সমাপ্তি।  

আরো বাকী আছে। দিনের মাঝামাঝি থেকে, বুড়ো লোকগুলো যাদেরকে বাড়ির বাইরে আসার অনুমতি দেয়া হয়েছে, চারপাশের খামারের কর্মীরা, নির্মাণ শ্রমিকরা যারা রবিবারে বাড়িতেই যায় না, আমার বাবা একটার পর একটা কৌটা তাদের জন্য খুলতে থাকেন, সাউরাক্রুট১, ক্যাসোলেট২, ডাল, সার্ডিন মাছ, ম্যাকারেল মাছ সাদা ওয়াইনে রাখা। আমি একবার এটার স্বাদ, আরেকবার ওটার স্বাদ উপভোগ করি, টমেটো সসে ভরপুর এক চামুচ বিনের স্বাদ, আঠালো ভুঁড়ির স্বাদ, অর্ধেকটা কুসুম গরম সসেজ, একদম প্যান থেকে সরাসরি আমার মুখে। এসব কিছুর পরও আমি আমার ডিনার খেয়ে ফেলি, সবুজ মটরশুঁটির মধ্যে  মাংস রোস্ট যেন একটা সবুজ সমুদ্র। মা টেবিলের উপর কেকের বাক্সটা রাখে আর আমি ঠোঁটে স্বাদ পাই টলমলে দেখতে কফি ক্রিমের তলাটার, কাজু বাদামের টুকরা আর গোলাপী ভাঁজগুলো। আমি অনেকটা পানি মুখ ভর্তি করে মুখটা পরিষ্কার করি, মুখ থেকে রোস্ট আর মটরশুঁটির স্বাদ ধুঁয়ে ফেলি যাতে করে আমি ক্রিমি নরম স্বাদ আর মাঝে মাঝে কুড়মুড়ে স্বাদ একসাথে উপভোগ করতে পারি। 

কোনো কোনো নির্বোধ রান্নাঘরের দরজায় মাথা ঢোকায়। ‘তোমরা তোমাদের খাবার উপভোগ করছো তো?’  কিন্তু আমার মা তার আগেই কেকের উপরে ন্যাপকিন ছুঁড়ে দেয়। ‘ওদেরকে ঈর্ষান্বিত করার কোনো মানে হয় না!’ এরপর এটা খাওয়া আরো মধুরতর হয়ে ওঠে, আর ন্যাপকিনে জড়ানো ক্রিমের টুকরা চেটে খাওয়া আরো মজার। ড্যানিস ল্যাসুর রবিবারের অপ্রত্যাশিত আনন্দ, পনের বছর আগে-পরের কোন একদিন। আমার মা দোকানের জানালার কাঠের পাল্লা লাগিয়ে দিতো। আমার বাবা ডোমিনো খেলায় যোগ দিতো, সবাই সুসজ্জিত পোশাক পরা। আমার চুলের বিনুনি আমার মাথার উপরে বড় একটা ঝুঁটির মতো বেঁধে দেয়া আর তখনও আমার পোশাকে কিছু সসের দাগ লেগে রয়েছে। যখন মা পরিষ্কার করতে থাকে, নিজের মুখটা পাউডারে ঢেকে দেয়, আমি আঙিনায় অপেক্ষা করি, যেখানে সব বাক্সগুলো সরিয়ে ফেলা হয়েছে, এই তো রবিবার। কিচ্ছু করার অনুমতি নাই, কোনভাবেই নিজেকে নোংরা করা যাবে না। আমি দেয়ালের পাশ দিয়ে লাফাই, আমি ডোমিনো খেলায় ব্যস্ত লোকদের চিৎকার শুনি। ‘এই এক! এইটা ব্ল্যাঙ্ক! যা তোমার হাতে নাই তা তুমি হারবা কেমনে!’ 

রান্নাঘরে যেন একটা খেলার অনুষ্ঠান চলছে তুর্যধ্বণি তুলে, মাথার উপরে একটা বিমান উড়ে যায়, আমার মা তার ময়লা পানিগুলো বাইরে ফেলে। আমি ততোদিনে পাঁচ কিংবা ছয় হয়ে গেছি। ডেনিস ল্যাসু ছিলো একদম পরিপূর্ণ সুখি। দোকানখানি, বার, আমার বাবা, আমার মা, সারাটা পৃথিবী যেন আমাকে ঘিরেই ছিলো। আমার অন্য সব ছোট্ট বন্ধুদের চেয়ে আমার ভাগ্য আর প্রাপ্তি এতো বেশি ছিলো যে বিশ্বাস করতে কষ্ট হতো, বিস্মিত হতাম যখন আমি এটা ভাবতাম কিংবা কিছুতেই এই ভাগ্যের কারণ বের করতে পারতাম না। আমি চারপাশে ঘুরপাক খেতাম, পৃথিবী দুলতো যেন, ধূসর বৃত্ত আমাকে ঘিরে দুলতো, দেয়ালগুলো যেন ধ্বসে পড়তো... ‘তোমার কাপড়ের অবস্থা দেখো!’ আমার মা আমার পোশাকের নিচটা ঝেড়ে দিতো, তখন সময় হয়েছে আমাদের বিশ্বস্ত পোষ্যদের দেখার, সেই সব লোক যারা মাসের পর মাস বাকীতে খেতো আর বাকী শোধ করতো, যারা অসুস্থ থাকতো, কেউ হয়তো একটা পা বা হাত হারিয়েছে। বৃদ্ধা নারী চের্দু, তার পাখানি পচন ধরে যাচ্ছে, তরুণী রেজল, কোমর থেকে সে পক্ষাঘাতগ্রস্থ, সে দুইবার প্যারিসের লর্দ্রেতে তীর্থযাত্রা করে এসেছে, চিকনা রেইন্টবর্গ যে তার ফোলা মুখের কারণে আর পান করতেই আসতো না। (চলবে)

 ১ লবণে দেয়া পাতাকপির আচার  ২ সাদা বিন দিয়ে তৈরি হাঁসের মাংস, খাসির মাংস আর শুয়োরের চর্বি-মাংসের এক প্রকার ঝোল

পড়ুন: নোবেলজয়ী আনি এরনোর উপন্যাস: তৃতীয় পর্ব