সাতসতেরো

শিশুর অধিকার প্রতিষ্ঠায় মহানবীর (সা.) শিক্ষা

আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। সুন্দর চরিত্রের শিশুরাই সুন্দর ভবিষ্যৎ নির্মাণ করতে পারে। সুসন্তান পেতে আল্লাহ তায়ালার কাছে প্রার্থনা করার জন্য মহান আল্লাহ আমাদের এভাবে বলতে শিক্ষা দিয়েছেন, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের এমন স্ত্রী ও সন্তান দান করুন, যারা আমাদের নয়ন প্রীতিকর হবে।’ (সুরা ফুরকান: ৭৪)। ইসলাম শিশুদের প্রতি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। আমাদের প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘শিশুরা হচ্ছে বেহেশতের সুন্দর পতঙ্গ। ভালো সন্তান বেহেশতের ফুল।’ (মিশকাত: ৪৯৪৯)

এসব ফুলশিশু আমাদের পৃথিবীর, সমাজের ও পরিবারের শোভা। এদের অধিকার নিশ্চিত করেছে ইসলাম। নবীজির শিক্ষার আলো নিয়ে আমরা শিশুদের অধিকার আদায় করলে সুন্দর হবে আমাদের জীবন। ইহকালে এবং পরকালে।

বেঁচে থাকার অধিকার

’শিশুর জন্মের পর প্রথমেই তার সুন্দর নাম রাখতে হয়। এরপর তার বেঁচে থাকার অধিকার নিশ্চিত করতে হয়। সন্তানকে হত্যা করা অথবা তাকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেওয়া মহাপাপ। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা নিজেদের সন্তানদের হত্যা করো না। যারা নিজেদের সন্তানদের হত্যা করেছে তারা অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’ (সুরা বনি ইসরাইল: ৩১)। শিশুর দুধপানের অধিকার সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘মায়েরা তাদের সন্তানদের পূর্ণ দুই বছর দুধপান করাবে।’ (সুরা বাকারা: ২৩৩)। শিশুকে দুধ দানকারী মায়ের জন্য আল্লাহ তায়ালা রোজা মওকুফ করে কাজা করার অনুমতি দিয়েছেন। এতেই বোঝা যায়, শিশুর বিকাশের প্রতি ইসলাম কতটুকু গুরুত্ব দিয়েছে।

স্নেহপূর্ণ ব্যবহার পাওয়ার অধিকার

প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) শিশুদের অনেক ভালোবাসতেন। দেখা হলেই তাদের আগে আগে সালাম দিতেন। বাইরে থেকে মদিনায় প্রবেশ করার সময় শিশুদের দেখতে পেলে তিনি তাদের উটের সামনে-পেছনে বসিয়ে আনতেন। তিনি বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমাদের ছোটদের স্নেহ করে না, সে আমাদের দলের নয়।’ (মুসনাদে আহমাদ: ২২৬৫৪)। ‘শিশুদের স্নেহ করো এবং তাদের প্রতি দয়া করো। তোমরা তাদের সঙ্গে কোনো ওয়াদা করলে তা পূরণ করো। কারণ, তারা মনে করছে তোমরাই তাদের সব কিছুর ব্যবস্থা করছ।’ (সহিহুল জামে : ৫৬৫২)

মহানবী (সা.) তার নাতি হাসান ও হোসাইনকে নিজের পিঠে বসিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে চলতেন, যেন তারা ঘোড়ায় চড়ার আনন্দ অনুভব করে। নামাজে তিনি সিজদায় গেলে হাসান, হোসাইন এবং হজরত জয়নব (রা.)-এর মেয়ে উমামা তার পিঠে ও ঘাড়ে উঠে বসে থাকত। তখন তিনি সিজদা দীর্ঘ করে নিতেন, যেন তারা সহজে নামতে পারে। তিনি শিশুদের কান্না মোটেই পছন্দ করতেন না। একবার তার কানে হোসাইনের কান্নার আওয়াজ এলো। এতে তিনি কষ্ট পেয়ে হজরত ফাতেমা (রা.)কে ডেকে বললেন, ‘তুমি কি জান না তার কান্না আমাকে কষ্ট দেয়?’

কোনো শিশুর কান্না শুনতে পেলে তিনি নামাজ সংক্ষিপ্ত করে নিতেন। একবার মদিনায় কিছু অমুসলিম শিশু মারা গেল। এতে মহানবী উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন। একজন সাহাবি মহানবীকে বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! তারা তো মুসলিম শিশু ছিল না।’ মহানবী তাকে বললেন, ‘তারা তোমার চেয়ে উত্তম ছিল।’ (নাসায়ি: ১১৪১; মুসনাদে আহমাদ: ১৭৬৮৮)

সমান আদর ও উপহার পাওয়ার অধিকার

নিজের সব সন্তানকে সমান আদর করতে হবে এবং সমান উপহার দিতে হবে। একজন সাহাবি তার এক সন্তানকে চুমো দিলেন, অন্যকে দিলেন না। তা দেখে মহানবী (সা.) বললেন, ‘তুমি দুই সন্তানের মধ্যে সমতা রক্ষা করলে না কেন? (কানযুল উম্মাল : ৪৫৩৪৬)। হজরত নুমান ইবনে বশির (রা.) বলেন, আমার ছোটবেলায় আমার আম্মা আমার আব্বা বশিরকে বলেন আমাকে কিছু দান করতে। তখন আব্বা আমাকে একটি বাগান দান করেন। আমার আম্মা আব্বাকে বললেন, আপনি যতক্ষণ আল্লাহর রাসুলকে এই দানের সাক্ষী না বানাবেন ততক্ষণ আমি খুশি হব না।

তখন আব্বা আমাকে নিয়ে আল্লাহর রাসুলের কাছে গেলেন। এরপর আম্মার কথা উল্লেখ করে তাকে এই দানের সাক্ষী হওয়ার অনুরোধ করলেন। তখন তিনি আব্বার কাছে জানতে চাইলেন, তোমার সব সন্তানকে কি এরূপ দান করেছ? আব্বা বললেন, না। আল্লাহর রাসুল বললেন, আমি বেইনসাফির সাক্ষী হতে পারি না। তাই সব সন্তানের প্রতি সমতা রক্ষা করতে হবে।

শিক্ষার অধিকার

মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের সন্তানদের ভালোভাবে জ্ঞান দান করো। কারণ, তাদের তোমাদের পরবর্তী সময়ের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে।’ (আল-জামেউস সাগির: ২৫)। ‘নিজের সন্তানের মুখের মাধ্যমে সর্বপ্রথম ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলাও এবং মৃত্যুর সময় তাদের এই কালেমার শিক্ষা দাও।’ (মুসলিম: ৯১৬) 

সন্তানদের শিক্ষা দেওয়ার ব্যাপারে মহানবীর এমন আরও অনেক বাণী রয়েছে। তাই আগামী পৃথিবীর যোগ্য মানুষ তৈরির জন্য শিশুদের সময়ের চাহিদামতো সব বিষয়ে শিক্ষিত করে তুলতে হবে। পাশাপাশি প্রতিটি শিশুকে নৈতিক শিক্ষাও দিতে হবে। তাদের শারীরিক ও মানসিকভাবে শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে হবে। ইসলাম এভাবে শিশুদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সুনির্দিষ্ট নীতিমালা দিয়েছে। মহানবী (সা.) তা বাস্তবায়ন করে দেখিয়ে গেছেন। আসুন আমরা ইসলাম ও মহানবীর দেখানো নীতিমালায় আমাদের শিশুদের অধিকার নিশ্চিত করি।

লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ ইসলামী লেখক ফোরাম