রাইজিংবিডি স্পেশাল

স্মার্ট ফোনের প্রভাবে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামীণখেলা

নাম নিরব। বয়স দুই বছর ছুঁই ছুঁই। ভালো করে বাবা-মা ডাকতে পারে না। কে, কি হয় তা বোঝে না। তবে স্মার্ট ফোন চালাতে পারে। স্মার্ট ফোন হাতে দিয়ে সারা দিন বসিয়ে রাখা হয় তাকে। সন্ধ্যা থেকে মধ্য রাত পর্যন্ত মোবাইল হাতে নিয়ে সময় কাটাচ্ছে সে। হাত থেকে মোবাইল নিলে কান্না শুরু করে। মোবাইল হাতে দিয়ে গোসল, কাপড় পরানো ও খাওয়ানো যায়। মোবাইল ছাড়া যেন অচল। মোবাইল হাতে না থাকলে খাবে না, গোসল করতে চাইবে না। 

আরস। বয়স ৫ বছর। বাবা ব্যাংকে চাকরি করেন। মা স্কুলে চাকরি করেন। ছেলেকে তেমন সময় দিতে পারেন না বাবা-মা। বাসায় অন্যের কাছে রাখতে হয় তাকে। তারও যেন মোবাইল ছাড়া চলে না। কোনো খেলনা নয়। নয় কোনো বাহানা। শুধু স্মার্ট ফোন চাই তার।  

শহরের পর এখন গ্রামের শিশুরাও নিরব ও আরসের মতো মোবাইলে আসক্ত হয়ে পড়ছে। তাদের সময় কাটে রুমে বসে। স্মার্ট ফোনের প্রভাবে তারা পরিচিত হতে পারছে না খেলাধূলার সঙ্গে।

একটা সময় গ্রামের মাঠে-ঘাটে, পথে-প্রান্তরে শিশু থেকে বৃদ্ধরাও গ্রামীণ যে সব খেলায় মুগ্ধ থাকত, এখন আর সেই খেলা তেমন চোখে পড়ে না। এ সব খেলায় শরীরচর্চা ও বিনোদন ছিল। শিশুদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশ সাধন হতো।

কিছু খেলা ছিল আঞ্চলিক ছড়া মেশানো। যেমন ‘কানা মাছি ভোঁ ভোঁ, যাকে পাবি, তাকে ছোঁ’, ‘ব্যাঙ মারবি যে, ব্যাঙের ভাতার সে’... ইত্যাদি।

কোনো কোনো খেলা ছিল শুধু মেয়েদের জন্য। আবার কোনো খেলা কেবল ছেলেদের জন্য। কিছু খেলায় ছেলে ও মেয়ে উভয়ে অংশ নিতে পারত। গোল্লা ছুঁট, দাঁড়িয়া বান্দা, নুনতা, বউছি, ডাংগুলি, গুলি (মার্বেল) খেলা, লাটিম ঘুরানো, গুলতি মারা, হা-ডু-ডু, ঘুড়ি উড়ানো, গুলতি মারা, চারকড়ি, ওপেন্টি বায়োস্কোপ, কুতুকত, বুড়ির চি (ছি ধরা), পুতুল খেলা, জোড়-বিজোড়, বিশ কাঠি, ষোলো ঘুঁটি, এলাডিং বেলাডিং, উবু-দুবু, চুড়ি ভাঙ্গা, লুডু খেলা, বাঘবন্দী, কানামাছি ভোঁ ভোঁ, কাঁঠাল চুরি, টিলো, শাক ভাত, ইচিং-বিচিং, ডুবসাঁতার, ডুবাডুবি, ব্যাঙ লাফানো, চিলি ও হাঁসহাঁস খেলা, আবুর মার টাপুর-টুপুর ইত্যাদি খেলা ছিল। সকল শিশু এই সব খেলা জানত এবং খেলত।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষামূলক অনেক খেলা ছিল। যেমন মোরগ লড়াই, বালিশ বদল, রুমাল চুরি, হাঁড়ি ভাঙা, সুই-সুতা ইত্যাদি।

ছোটদের পাশাপাশি গ্রামে বড়দেরও ছিল নানান খেলা। যেমন লাঠিখেলা, নৌকাবাইচ, বলীখেলা, কুস্তি, হা-ডু-ডু, উচ্চ লাফ, লম্বা লাফ, দৌঁড়, ৩ গুটি, ১২ গুটি ও ১৬ গুটি খেলা ইত্যাদি। গুটি খেলা মাটিতে দাগ কেটে কোট বানিয়ে খেলা হতো।

গ্রামীণ মেয়েদের বিয়ের আগ-পর্যন্ত রান্না শেখার জন্য বাড়ি বাড়ি চাউল উঠিয়ে ‘রান্না করা’ খেলার প্রচলন ছিল। এটা জোলোপাতি বলা হয়। তৃপ্তি নিয়ে সেই খাবার খেত ছোট-বড় সবাই। কখনও কখনও বালু মাটি দিয়ে ঘর তৈরি করে সংসার পাতানো খেলা, যেটা ‘বউ বউ খেলা’ বলা হয়; সেটা খেলত মেয়েশিশুরা।  

এই গ্রামীণখেলা কত আগে থেকে চলে এসেছে, এর হিসাব নেই। গ্রামীণ এই বিনোদনগুলো ছিল শিক্ষামূলক। এ খেলা থেকে শিশুরা বড়দের সঙ্গে কেমন আচরণ করতে হয়, তা যেমন শিখত; ছোটদের প্রতি স্নেহ-ভালোবাসার শিক্ষাও পেত। এই সব খেলা থেকে শিশু-কিশোররা শিখত শৃঙ্খলা, একতা, নৈতিকতা, ধৈর্য, বন্ধুত্ব, নেতৃত্বের গুণাবলী। 

এমন খেলা এখন আর চোখে পড়ে না। বেশিরভাগ শিশু এ সব খেলার সঙ্গে অপরিচিত। সেই জায়গা দখল করে নিচ্ছে স্মার্ট ফোন।