সাতসতেরো

ইসলামে সালাম বিনিময়ের বিধান

সালাম অর্থ শান্তি। সালাম বিনিময়ের মাধ্যমে পরস্পর ভালোবাসা, সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি তৈরি হয়। সালাম ইসলামের নিদর্শন। সালাম দেওয়া সুন্নত আর সালামের জবাব দেওয়া ওয়াজিব। মানে কোনো মুসলমান অপর মুসলমানকে সালাম দিলে এর উত্তর শুনিয়ে দিতে হয়। না দিলে গোনাহ হয়। যে আগে সালাম দেবে তার আমলনামায় নব্বইটি নেকি লেখা হয়, আর যে সালামের জবাব দেবে তার জন্য দশটি নেকি লেখা হয়।

আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছোট বড় সবাইকে সালাম দিতেন। কখনো তার আগে কেউ সালাম দিতে পারেনি। সাহাবায়ে কেরাম নবীজির সঙ্গে দেখা হলে তাঁকে আগে সালাম দেওয়ার অনেক চেষ্টা করতেন, তারপরও দেখা যেত নবীজিই আগে সালাম দিয়ে ফেলেছেন। সাহাবায়ে কেরাম পরস্পরের সঙ্গে দেখা হলেই সালাম দিতেন। তাঁরা সদাইপাতির জন্য নয়, শুধু সালাম বিনিময়ের জন্যও বাজারে যেতেন। তাই একজন মুসলমানের সঙ্গে অন্য মুসলমানের দেখা হওয়া মাত্রই সালাম বিনিময় করতে হয়। 

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কথাবার্তার আগেই সালাম দিতে বলেছেন। এমনকি সালাম বিনিময়ের পর দুজনের মাঝে কোনো গাছ, প্রাচীর বা কোনো কিছুর আড়াল পড়লে, এরপর পুনরায় দেখা হলেও সালাম বিনিময় করতে হয়। 

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালামের প্রচলন বাড়ানোর নির্দেশ দিয়েছেন। কোনো মুসলমান কাউকে সালাম দিলে তার চেয়ে উত্তমরূপে সালামের জবাব দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। অর্থাৎ কেউ যদি কাউকে ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলে সালাম দেয় তাহলে জবাবদাতা এর সঙ্গে ‘ওয়া রাহমাতুল্লাহ’ যুক্ত করে জবাব দেবে। যদি সালামদাতা ‘আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ’ বলে সালাম দেয়, তাহলে জাবাবদাতা এর সঙ্গে ‘ওয়া বারাকাতুহু’ যুক্ত করে সালামের উত্তর দেবে। এটা সালাম আদান-প্রদানের নিয়ম। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যখন তোমাদেরকে অভিবাদন করা হয় (সালাম দেওয়া হয়), তখন তোমরাও তার চেয়ে উত্তম অভিবাদন করো অথবা এরই অনুরূপ করো।’ (সুরা নিসা : আয়াত ৮৬)

ছোটরা বড়দের সালাম দেবে, পথচারী বসা ব্যক্তিকে এবং কমসংখ্যক লোক বেশিসংখ্যক লোককে সালাম দেবে। আরোহী পদচারীকে সালাম দেবে। মুসলমানদের জন্য অন্য ধর্মাবলম্বীকে সালাম দেওয়ার বিধান নেই। তবে তারা সালাম দিলে তাদের উত্তরে শুধু ‘ওয়া আলাইকা’ বলার বিধান রয়েছে। 

মুসলমানদের পরস্পর কল্যাণ ও দোয়া কামনার জন্য এরচেয়ে উত্তম অভিবাদন ও সম্ভাষণ আর কী হতে পারে। আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ- আপনার ওপর শান্তি ও রহমত বর্ষিত হোক। ওয়া আলাইকুমুস সালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু- আপনার ওপরও শান্তি, রহমত ও বরকত বর্ষিত হোক। পরিচিত-অপরিচিত সব মুসলমানকে সালাম দিতে হয়। এ সালাম দুনিয়াতেও উত্তম বাক্য, জান্নাতেও উত্তম বাক্য। ফেরেশতারা জান্নাতিদেরকে সালাম দেবেন।

সালামের পর একটি আদব ও শিষ্টাচার হলো মুসাফাহা করা। মুসাফাহা মানে হাত মিলানো। এক মুমিনের সঙ্গে আরেক মুমিনের দেখা হলে তারা যদি সালাম বিনিময় করে এবং মুসাফাহা করে, তাহলে তাদের গোনাহ গাছের পাতার মতো ঝরে যায়। আমরা কারো সঙ্গে কথা বলার আগে সালাম দিয়ে কথা বলা শুরু করব। কারণ, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কথা বলার আগে সালাম দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।

এমন জামাতকে সালাম দেওয়া মাকরুহ যারা অজু-গোসল করছে, খাচ্ছে, যুদ্ধ করছে, কোরআন তেলাওয়াত বা জিকির করছে, তালবিয়া পাঠ করছে, হাদিস পড়াচ্ছে, ভাষণ দিচ্ছে, ওয়াজ করছে, ওয়াজ-নসিহত বা ভাষণ শুনছে, মাসয়ালা-মাসায়েল আলোচনা করছে, পাঠদান করছে, গবেষণা করছে, আজান দিচ্ছে, সালাত আদায় করছে, প্রস্রাব-পায়খানায় আছে, বিচার কাজে লিপ্ত আছে ইত্যাদি। যদি কোনো ব্যক্তি এমন সময় সালাম দেয়, তার সালামের জবাব দেওয়া ওয়াজিব নয়।

যে নারীদের সঙ্গে বিয়ে হারাম, তাদের ‘মাহরাম’ বলা হয়। আর যাদের সঙ্গে বিয়ে বৈধ, তাদের ‘গায়রে মাহরাম’ বলা হয়। মাহরাম সব নারীকে সালাম দেওয়া সুন্নত, যেমন নারী নারীকে বা পুরুষ পুরুষকে সালাম দেওয়া সুন্নত। গায়রে মাহরাম ছোট বা অশীতিপর বৃদ্ধা হলে সেক্ষেত্রেও পুরুষরা তাদের সালাম দেওয়া সুন্নতের অন্তর্ভুক্ত হবে। পক্ষান্তরে পূর্ণ যুবতী বা যাদের প্রতি যৌন আকর্ষণ তৈরি হয়ে মনে ফেতনা বা খারাপ ভাবনা তৈরি হওয়ার আশঙ্কা থাকে, তাদের সালাম দেওয়া বা তাদের সালামের জবাব দেওয়া মাকরুহ। আর পর্দার আড়াল থেকে সর্বাবস্থায় সালাম দেওয়া জায়েয; কারণ সেখানে ফেতনার আশঙ্কা থাকে না।

আমাদের মনে রাখতে হবে, সালাম কোনো ফ্যাশনের বিষয় নয়, এটা আল্লাহপ্রদত্ত দোয়া এবং প্রিয় নবীজির আদর্শ। তাই সহি-শুদ্ধ করে সালাম দিতে হবে। অনেকে বিকৃত উচ্চারণে সালাম দেয়। যেমন, স্লামালেকুম, সালামালাইকুম, সামুকুম ইত্যাদি। এমন করা মারাত্মক পাপ। সুতরাং আসুন আমরা ছোট-বড়, পরিচিত-অপরিচিত সবার সঙ্গে সালাম বিনিময় করে পরস্পর সম্প্রীতি বাড়াই। ইসলামের সঠিক নিয়ম মেনে সালাম বিনিময় করে দুনিয়া ও আখেরাতে  কল্যাণ লাভ করি।

লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ ইসলামী লেখক ফোরাম