রাইজিংবিডি স্পেশাল

চিনি সংকটের নেপথ্যে ‘গ্যাস সংকট’

চিনি নিয়ে বাজারে সংকট তৈরি হয়েছে। গত ৬ অক্টোবর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় চিনির দাম নির্ধারণ করে দেওয়ার পর থেকে (খোলা চিনির দাম ৯০ টাকা ও প্যাকেটজাত চিনির দাম ৯৫ টাকা) সংকট দেখা দিয়েছে।

খুচরা ব্যবসায়ী ও ক্রেতারা বলছেন, সিন্ডিকেট করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বেশি দামে চিনি বিক্রি করছে কিছু অসাধু বড় ব্যবসায়ী ও চিনি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। বড় ব্যবসায়ী ও চিনি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বলছে, সরবরাহে ঘাটতি তৈরি হয়েছে গ্যাসের অভাব ও লোডশেডিংয়ের কারণে।

রাজধানীর খুচরা দোকানগুলোতে কখনো চিনি পাওয়া যাচ্ছে, আবার কখনো পাওয়া যাচ্ছে না। বিক্রেতারা বলছেন, পাইকারি দোকান ও কোম্পানি থেকে মাঝে মধ্যে চিনি পাওয়া যায়, যা পরিমাণে অল্প। সেই চিনি দ্রুত বিক্রি হয়ে যায়। ফলে বেশির ভাগ সময় দোকানে চিনি থাকে না।

বাজারে চিনি বিক্রি হচ্ছে দোকানে খোলা চিনি ১১৫-১২৫ টাকা, খোলাবাজারে সরকার নির্ধারিত দাম ৯০ টাকা কেজি। প্যাকেটজাত চিনির কেজি ৯৫ টাকা।

শনিবার (১২ নভেম্বর) রাজধানীর ধোলাইপার, যাত্রাবাড়ী, দয়াগঞ্জ, বংশাল, রায়েরবাগ এলাকার কাঁচাবাজার ও পাড়া-মহল্লার মুদি দোকান ঘুরে এ চিত্র দেখা গেছে।

খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, চিনি ক্রেতারা একবার পাচ্ছেন তো আরেকবার পাচ্ছেন না। প্রায় চার সপ্তাহ ধরে বলতে গেলে চিনিই পাওয়া যাচ্ছে না। তিন-চার বস্তা পেলে সেটা বিক্রি হচ্ছে।

মো. রাশেদুর হক। রাজধানীর যাত্রাবাড়ী নবীনগর রোডের মেসার্স রাসেল ভ্যারাইটিস স্টোরের মালিক। রাসেল স্টোরে মুদি দোকানে চিনি খুঁজছিলেন আমির হোসেন কল্লোল নামের এক স্থানীয় বাসিন্দা। তিনি রাইজিংবিডিকে বলেন, একমাস ধরে  হুট হাট করে চিনির দাম বাড়ছে, এখন আবার তা পাওয়াও যাচ্ছে না।

টিসিবি সূত্রে জানা গেছে, বাজারে এখন প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হচ্ছে ১১০ থেকে ১১৫ টাকায়। দুই সপ্তাহে দাম বেড়েছে কেজিতে ১০ থেকে ১৫ টাকা। প্রতি কেজি চিনির দাম ২ দশমিক ২৭ শতাংশ বেড়েছে।

বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের (বিটিটিসি) হিসেবে, দেশে বছরে চিনির চাহিদা ২০ লাখ মেট্রিক টন। বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত চিনি ও ডলারের মূল্য বৃদ্ধির কারণে আগে থেকেই চিনির দাম বাড়ছিল। তবে দুই সপ্তাহ আগে থেকে সরবরাহে ঘাটতি শুরু হয়।

রায়েরবাগের মুদি দোকানদার মঈন উদ্দিন বলেন, গত ২৮ দিন থেকে কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধিরা আসছেন না। মাঝে মধ্যে এলেও কাঙ্ক্ষিত পণ্য দিতে পারছেন না। বিশেষ করে চিনি দেওয়া প্রায় বন্ধ রেখেছে কোম্পানিগুলো। যাদের কাছে আগের কেনা চিনি রয়েছে, তারা কিছু কিছু করে বিক্রি করছেন এখন।

বাজারে আসা স্কুলশিক্ষক আলম রায়হান বলেন, তেল, চিনি ও আটা-ময়দা যেসব পণ্যের সংকট রয়েছে, সেগুলোর বাজার কয়েকটি কোম্পানির দখলে। তারা বিশ্ববাজার এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে অজুহাত করে সিন্ডিকেট তৈরি করেছে। স্থানীয় বাজারে পণ্যের দাম যেভাবে বাড়ানো হয়েছে বিশ্ববাজারে তা ততটা বাড়েনি। এসব কোম্পানির বিরুদ্ধে সরকার কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারছে না বলেই তারা বেপরোয়া হয়ে ওঠেছে। এ পরিস্থিতিতে ভোক্তারা একদম নাজেহাল।

যাত্রাবাড়ী বাজারে নোয়াখালী স্টোরের মালিক ফোরকানুল হক বলেন, ৩০ বছরের ব্যবসায়িক জীবনে পণ্যের এমন সংকট কখনো দেখিনি। চিনিসহ নিত্যপণ্য সরবরাহ ঠিকমত না দিয়ে বাজারে ক্রেতা-বিক্রেতা সবাইকে জিম্মি করে রেখেছে কিছু অসাধু কোম্পানি। দেশের বর্তমান পরিস্থিতি কী, সেটা জানার উপায় তো আর আমাদের নেই।

মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের (এমজিআই) মহাব্যবস্থাপক এস এম মুজিবুর রহমান বলেন, কারখানায় যে পরিমাণ চিনি উৎপাদন হচ্ছে, তার পুরোটাই সরবরাহ করা হচ্ছে। কারখানায় কোনো মজুত নেই। সরবরাহে এই ঘাটতি তৈরি হয়েছে গ্যাসের অভাব ও লোডশেডিংয়ের কারণে। কারখানায় উৎপাদন কার্যক্রম ঠিকভাবে চালানো যাচ্ছে না।

মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের (এমজিআই) মার্কেটিং ম্যানেজার রফিকুল ইসলাম বলেন, সচিবালয়সহ বিভিন্ন স্থানে ট্রাকে করে প্যাকেটজাত চিনি বিক্রি শুরু হয়েছে। সরকারের নির্ধারিত মূল্যে চিনি কেজি ৯৫ টাকা করে বিক্রি করা হচ্ছে।

বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক না থাকায় চিনির উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। বাজারে পর্যাপ্ত চিনি আছে। কাজেই চিনি নিয়ে নেতিবাচক কোনো প্রভাব দেখছি না। জানুয়ারি পর্যন্ত কোনো সমস্যা নেই। যে সমস্যা পেয়েছি তা হলো, গ্যাসের সরবরাহের অপ্রতুলতা। যে কারণে ৬৬ শতাংশের বেশি চিনি উৎপাদন করা যাচ্ছে না। আশা করি, দু-একদিনের মধ্যে গ্যাসের সরবরাহ স্বাভাবিক হলে যে পরিমাণ চিনি দরকার, তা উৎপাদন সম্ভব হবে।

তিনি বলেন, চিনির সরবরাহ ঠিকভাবে হওয়া দরকার। সরবরাহ ধীরগতি হলে সমস্যা, সরবরাহ স্বাভাবিক হলে যে দাম নির্ধারণ করা হয়েছে সে দামে বিক্রি করা যাবে। অনেক চিনি গুদামে পড়ে আছে, তা প্রক্রিয়াজাত করতে পারলে বাজারে আসবে।

জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, দেশে প্রতিদিন গড়ে চিনির চাহিদা ৫ হাজার মেট্রিক টন। কিন্তু এখন উৎপাদন হচ্ছে সাড়ে ৩ হাজার মেট্রিক টন। ফলে দিনে চিনির ঘাটতি হচ্ছে দেড় হাজার টন। আর চাহিদার চেয়ে উৎপাদন ও সরবরাহ কম থাকায় চিনির দাম বেড়েছে। চিনির কোনও ঘাটতি নেই।