রাইজিংবিডি স্পেশাল

জার্সিতে বিশ্বকাপের হাওয়া: কেহ কারে নাহি ছাড়ে, সমানে সমান

অন্যান্য দেশের ফুটবলপ্রেমীদের মতো বিশ্বকাপ নিয়ে উন্মাদনা বাংলাদেশের দর্শকদেরও। আমাদের দেশের দর্শকদের উন্মাদনার পরিমাণটা বিশ্বের অন্য দেশের তুলনায় একটু বেশিই বলা চলে। ‘ফুটবল জাদুকর’ ম্যারাডোনা এবং ‘কালোমানিক’ পেলের কারণে বাংলাদেশের ফুটবলপ্রেমীরা মূলত দুই ভাগে বিভক্ত। আর্জেন্টিনা এবং ব্রাজিল। এই দুই দলের সমর্থকদের পাগলামির মাত্রা মাঝেমধ্যে সীমা ছাড়িয়ে যায়। নিজের জমি বিক্রির টাকা দিয়ে সাত মাইল দীর্ঘ পতাকা বানানো, নিজের পুরো বাড়িকে প্রিয় দলের পতাকার রঙে রঙিন করে তোলা; কখনো-বা দুই দলের সমর্থকদের মধ্যে ঝগড়া, বিবাদ, হাতাহাতি, মারামারির সংবাদও গণমাধ্যমে দেখা যায়।

বিশ্বকাপ এলে সমর্থকদের মাঝে প্রিয় দলের জার্সি কেনার ধুম পড়ে যায়। এবারও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। গত প্রায় এক মাস ধরে সারাদেশের সব মার্কেট ও অনলাইনে দেদারসে বিক্রি হচ্ছে বিভিন্ন দলের বিশ্বকাপ জার্সি। তবে এক্ষেত্রে আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিল- এই দুই দলের জার্সিই সমানভাবে বিক্রি হচ্ছে। কারটা যে বেশি, আর কার কম- সে হিসাব করা অসম্ভব। ‘কেহ কারে নাহি ছাড়ে, সমানে সমান’।

‘জার্সির বিক্রি কেমন চলছে’ জানতে চাইলে রাজধানীর ধানমন্ডি হকার্স মার্কেটের কান্তা ফ্যাশনের ইমরান বলেন, গত তিন-চার দিন থেকে প্রতিদিন প্রায় ৫০-৬০টি জার্সি বিক্রি হচ্ছে। এগুলো মানভেদে বিক্রি হচ্ছে ৩০০ থে‌কে ৬০০ টাকায়। কোন দলেরটা বেশি বিক্রি হচ্ছে? ইমরান জানান, আর্জেন্টিনা এবং ব্রাজিল এই দুই দলেরই বেশি চল‌ছে। আমাদের দেশে এই দুই দলের সাপোর্টারই বেশি।

আরেক ব্যবসায়ী খান ফ্যাশ‌নের বাচ্চু মিয়া জানান, তার জার্সিগু‌লো একটু উন্নতমানের। একেকটির দাম ৪০০ থেকে ৮০০ টাকা। দুই দেশের জার্সিই সমানভাবে নিচ্ছেন সাপোর্টাররা। তিনি জার্সি কিনেন ফুলবাড়িয়া পাইকারি মার্কেট থেকে। একেকটি জার্সিতে বর্তমানে ভালোই লাভ করছেন। খেলা শুরু হওয়ার ৩-৪ দিন পরে জার্সির দাম কমে যাবে বলে জানান এই ব্যবসায়ী।

ফুলবাড়িয়া পাইকারি বাজারের পলাশ ফ্যাশন হাউজের মালিক ব্যবসায়ী ফরহাদ মিয়া বলেন, আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিলের জার্সি বেশি চলছে। প্রতিদিন ২০০-২৫০ ডজন জার্সি খুচরা ব্যবসায়ীরা নিয়ে যাচ্ছেন। কেবল ঢাকার নয়, সারাদেশের ব্যবসায়ীরাই নিচ্ছেন। গত এক সপ্তাহ ধরে জার্সি বিক্রি বেড়েছে। আরও সপ্তাহখানেক এই জোয়ার থাকবে। এরপর আস্তে আস্তে কমবে। আমাদের প্রতিটা জার্সি মানভেদে, পাইকারি হিসাবে ২৫০ থেকে ৪০০ টাকার মধ্যে পড়ে। 

এত গেলো জার্সির খবর! এবার সমর্থকদের প্রসঙ্গে আসা যাক। বাংলাদেশে যে কেবল আর্জেন্টিনা বা ব্রাজিলের সমর্থক রয়েছে তা কিন্তু নয়। এর বাইরে অন্য কয়েকটি দলের সমর্থকও রয়েছে। সংখ্যায় হয়তো কম। রয়েছে- জার্মানি, স্পেন, পর্তুগাল, ফ্রান্স বা কলম্বিয়া দলের সমর্থকও।

তেমনি এক সমর্থক, ব্যবসায়ী সাহাদাত উদরাজী। তিনি বলেন, বিশ্বকাপ ১৯৯০ সালে নতুন দল হিসাবে ছিল কলম্বিয়া। সে বছর কলম্বিয়ার খেলা এত ভাল লাগে যে, আমি এই দ‌লের প্রেমে পড়ে যাই। এই বাংলাদেশে আমার মনে হয় আমিই একমাত্র কলম্বিয়া দ‌লের সমর্থক। সেই থেকে আমি আর দল বদলাইনি। কলম্বিয়া হারুক-জিতুক আমি ওই দলের সাথে ছিলাম, আছি এবং থাকবো। ২০২২ বিশ্বকাপে আমার প্রিয়দল কলম্বিয়া কোয়ালিফাই থেকে বাদ পড়েছে। তারা এবার বিশ্বকাপে নেই, ভাবতেই মন খারাপ। ফলে এই বছর আমি কোনও দেশকেই সমর্থন করবো না, তবে খেলা দেখবো। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এনায়েত বরাবরই আর্জেন্টিনার ভক্ত। বিশেষ করে মেসির। তিনি বলেন, এবারের বিশ্বকাপের সার্বিক দিক দেখে ঠিক বলা যাচ্ছে না- কোন দল চ্যাম্পিয়ন হবে। যে অবস্থা, তাতে মনে হচ্ছে- আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল বা ফ্রান্স এই তিন দলের একদলের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। 

অপরদিকে, চাকরিজীবী সা‌দেক বেশ জোর দি‌য়ে বলেন, এবার ব্রা‌জিল চ্যাম্পিয়ন হ‌বে। তাই ব্রাজিলের জার্সি কিনতে এসেছি। কেন ব্রাজিল চ্যাম্পিয়ন হবে? হেসে তিনি বলেন, আমি ব্রা‌জিল সাপোর্ট করি, তাই।

সমর্থকরা যে যেই দল সমর্থন করছেন, তারা ভাবছেন- সেই দলই চ্যাম্পিয়ন হবে। তেমনি নিলয়ের বিশ্বাস, তার প্রিয় দল স্পেন এবার কাপ জিতবে। আর মেহরব মনে করেন জিতবে জার্মানি। ব্রাজিল এবার কাপ জিতবেই- আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বললেন নাফিউল।

মাহতাবের প্রিয় খেলোয়াড় রোনালদো। সে কারণে তিনি বিশ্বাস করেন, এবারের চ্যাম্পিয়ন হ‌বে রোনালদোর দল পর্তুগাল। তিনি চান, রোনালদোর এবারই শেষ বিশ্বকাপ খেলা, তাই কাপটি যেন তার প্রিয় খেলোয়াড়ের হাতেই উঠে।

তেমনি আর্জেন্টিনার সমর্থক রোদ্দুরও আশা করেন, তার প্রিয় খেলোয়াড় মেসির হাতে কাপটা উঠুক। রোনালদোর মতো এটাই বিশ্ব সেরা ফুটবল তারকা মেসির শেষ বিশ্বকাপ।

আমাদের দেশের সকল দলের সমর্থকদের জন্য শুভকামনা জানান লেখক, সাংবাদিক, কবি আনিসুল হক। তিনি খেলাকে খেলা হিসাবে দেখা এবং উপভোগ করারও আহ্বান জানান সকল দলের সমর্থকদের। বিশ্বকাপ খেলাকে কেন্দ্র করে কোনও অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা যাতে না ঘটে, সে ব্যাপারে সবাইকে সংযমের সঙ্গে খেলা দেখা ও আনন্দ করারও অনুরোধ জানান তিনি। 

প্রসঙ্গত, আগামী ২০ নভেম্বর থেকে শুরু হচ্ছে বিশ্বকাপ ফুটবল। এবারের আসর হচ্ছে এশিয়ার দেশ কাতারে। অংশ নিচ্ছে বিশ্বের ৩২টি দেশ। আট গ্রুপে অংশ নেওয়া দলগুলো হচ্ছে- (গ্রুপ-এ) কাতার, ইকুয়েডর, সেনেগাল ও নেদারল্যান্ডস। (গ্রুপ-বি) ইংল্যান্ড, ইরান, যুক্তরাষ্ট্র ও ওয়েলস। (গ্রুপ-সি) আর্জেন্টিনা, সৌদি আরব, মেক্সিকো ও পোল্যান্ড। (গ্রুপ-ডি) ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, ডেনমার্ক ও তিউনিসিয়া। (গ্রুপ-ই) স্পেন, কোস্টারিকা, জার্মানি ও জাপান। (গ্রুপ-এফ) বেলজিয়াম, কানাডা, মরক্কো ও ক্রোয়েশিয়া। (গ্রুপ-জি) ব্রাজিল, সার্বিয়া, সুইজারল্যান্ড ও ক্যামেরুন। সবশেষ (গ্রুপ-এইচ) এর চারটি দল হচ্ছে- পর্তুগাল, ঘানা, উরুগুয়ে এবং দক্ষিণ কোরিয়া।