মতামত

সব খেলার সেরা বাঙালির ফুটবল

রাত পোহালেই ফিফা বিশ্বকাপের আসর। বলাবাহুল্য প্রতিবারের মতো এবারও  আমাদের দেশ জেগে উঠেছে। জেগে ওঠা এবং প্রাণিত হয়ে ওঠার ভেতর তফাৎ আছে। যে সব দেশের মানুষ ফুটবল বোঝেন বা খেলার নিয়ম মানেন কিংবা বলা উচিৎ খেলাকে খেলা হিসেবে নেন, তাদের সমর্থনে আবেগ আছে কিন্তু এমন বেগ নেই। যে বেগ নিয়ম মানে না কিংবা সীমা মানে না, তা কখনো সহজ বা সুসহ-আবেগ হতে পারে না।

আমাদের দেশের সবকিছুই বেপরোয়া। যখন আমরা রাজনীতি করি তখন যেমন দুই দলে বিভক্ত, যখন ক্রিকেট খেলা হয় তখন যেমন ভারত-পাকিস্তান দুই দলে বিভক্ত, ফুটবলেও ব্যতিক্রম নেই। আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিল এই দুই শিবিরে বিভক্ত সমর্থন এখন এতটাই বেপরোয়া যে মানুষের প্রাণ পর্যন্ত অনিরাপদ! শুনলে বা জানলে অবাক হবেন খোদ ঐ দুই দেশের মানুষও এমন উন্মাদনায় ভোগেন না।

অস্ট্রেলিয়া একটি বহুজাতিক সমাজের দেশ। পরীক্ষকের চাকরি করি ফলে রোজ ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে দেখা হবে এটাই নিয়ম। যারা নাগরিকত্ব পাননি তাদের পাসপোর্ট ছাড়া আর কোনো আইডি গ্রহণ করা হয় না বলে নব্বই শতাংশ ছাত্রছাত্রী আসে পাসপোর্ট নিয়ে। সে সূত্রে সহজেই জানা সম্ভব কে কোন দেশের। তুলনামূলকভাবে আর্জেন্টিনার চাইতে ব্রাজিল থেকে আসা ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যা অধিক। তাদের সাথে স্বাভাবিকভাবেই কথা মানেই ফুটবল খেলার গল্প। তাদের বেশীর ভাগই বিশ্বকাপে নিজ দেশকে সমর্থন ছাড়া আর কখনো খেলা নিয়ে ভাবে না। কৌতূহল উদ্দীপক ব্যাপার হচ্ছে তারা মেসিকে নিয়ে বিতর্ক করে না। নেইমার ও মেসিকে তারা সমান পাল্লায় রাখে। অন্যদিকে আর্জেন্টিনার ওরা মনে করে ফুটবল মানে ম্যারাডোনা আর পেলে। 

যাদের নিজেদের দেশ খেলে তারা এমন মনোভাব পোষণ করলেও আমরা করি না। কেন করি না? কারণ আমরা মূলত খেলার রস বা আনন্দ নিতে জানি না। তারচেয়ে কলহ বা সংঘর্ষই আমাদের প্রিয়! এ লেখা যখন লিখছি তখনো মাঝেমধ্যেই খবর পাচ্ছি নানা অঘটনের।

কিশোর-কিশোরী তারুণ্যে যখন বুদ্ধি ও চিন্তা অপরিণত থাকে তখন তাদের দ্বারা যে কোনো কিছু, যে কোনো কাজ সম্ভব। ওদের মারমুখি করা থেকে নিবৃত্ত করা এবং সমর্থন ও উন্মাদনা যে এক না সে বিষয় বোঝানোর উপায় দুটো। প্রথমত তাদের বাড়িঘর ও বন্ধুদের আড্ডায় খেলাকে খেলা হিসেবে নেয়ার কথা  বলা। শেষত বিশ্বকাপের মজার ঘটনাগুলো বারবার করে তুলে ধরা।

মরুর দেশ কাতারে এবার যে বিশ্বকাপ তার চরিত্রে কি কোনো পরিবর্তন এসেছে? এবার কি ঘটতে যাচ্ছে তেমন কিছু? মজা বলতে হাসি আনন্দের কথা বলছি আমরা। মনে রাখতে হবে এর সঙ্গেই থাকে বিষাদ আর দুঃখ। এরা হাত ধরাধরি করে চলে। তেমন কয়েকটি ঘটনা তুলে ধরছি আপনাদের জন্য: প্রথম বিশ্বকাপে ফিফার নিজস্ব কোনো বল ছিল না। দলগুলোর বল দিয়ে খেলা হতো। সেবার ফাইনালে বল নিয়ে দ্বন্দ্ব লেগে যায় দুই ফাইনালিস্ট উরুগুয়ে ও আর্জেন্টিনার মধ্যে। দুই দলই চায় নিজেদের বল নিয়ে খেলতে। শেষে সিদ্ধান্ত হয় প্রথমার্ধে আর্জেন্টিনার বল দিয়ে খেলা হবে আর দ্বিতীয়ার্ধে উরুগুয়ের।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ফিফার ইতালিয়ান ভাইস প্রেসিডেন্ট অত্তোরিনো বারসি বিশ্বকাপ ট্রফি নিজের বেডরুমের বিছানার নিচে লুকিয়ে রাখেন। তার ভয় ছিল নাৎসি বাহিনী ট্রফিটি চুরি করতে পারে!

১৯৯০ সালে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পায় সংযুক্ত আরব আমিরাত। দলের খেলোয়াড়দের প্রতিজ্ঞা করা হয় যদি কেউ গোল করতে পারে, তাহলে তাকে দেওয়া হবে একটি রোল রয়েস গাড়ি। অনভিজ্ঞ দলটির ভালো করার সুযোগ ছিল খুবই কম। তবে গ্রুপ পর্ব থেকে বাদ পরার আগে তারা ২টি গোল দিতে সমর্থ হয়। আর প্রতিজ্ঞা অনুযায়ী শেখ মোহাম্মদের কাছ থেকে দুই গোলদাতা ইসমাইল মোবারক ও থানি জুমা একটি করে রোল রয়েস গাড়ি উপহার পান।

কোনো মতে হার এড়াতে পারলেই চ্যাম্পিয়ন। আগের সব ম্যাচেই ব্রাজিল পায় বড় বড় জয়। তাই এ ম্যাচে নিয়ে বিশাল আগ্রহ ছিল ব্রাজিলিয়ানদের। ১৯৫০ বিশ্বকাপের ফাইনাল রাউন্ডের শেষ ম্যাচে উরুগুয়ে ও ব্রাজিলের লড়াই দেখতে রিও’র মারাকানা স্টেডিয়ামে দর্শক উপস্থিত হয়েছিল ১ লক্ষ ৯৯ হাজার ৯৮৪ জন। যা এখনও বিশ্বকাপের ইতিহাসে সর্বোচ্চ দর্শক উপস্থিতির রেকর্ড। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ম্যাচটি হারে ব্রাজিল। আর সে ম্যাচে হারের বেদনা সহ্য করতে না পেরে বেশ কিছু ব্রাজিলিয়ান ভক্ত মারাকানার ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেন।

আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের গল্পটি জানুন। এখন তারা যে অবস্থানে সেখান থেকে বিশ্বকাপ খেলাটা দিবা স্বপ্নের মতো। আগামী কুড়ি বছরেও তাদের ভাগ্যে মূলপর্বে খেলার কোনো সম্ভাবনা দেখি না। কিন্তু কি জানেন এই ভারতই ভাগ্যক্রমে সুযোগ পেয়ে গিয়েছিল মূলপর্বে খেলার। কেন তারা পারেনি খেলতে? বাছাই পর্ব থেকে বাকি দলগুলো নাম প্রত্যাহার করে নেওয়ায় কোনো ম্যাচ না খেলেই ১৯৫০ সালে ব্রাজিল বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পেয়ে যায় ভারত। সে সময় খালি পায়ে খেলে অভ্যস্ত দলটি বিশ্বকাপেও খালি পায়ে খেলার দাবি করে। কিন্তু ফিফা সে অনুমতি দেয়নি। পরে বাধ্য হয়ে নাম প্রত্যাহার করে নেয় ভারত।

আমাদের দেশের সমর্থকদের উন্মাদনা অর্থনৈতিক সাধ-সাধ্যকেও বুড়ো আঙুল দেখিয়ে চলে। কোথাও রিকশা রাঙিয়ে দেয়া হয়েছে নীল সাদায়। কোথাও দেখলাম ব্রাজিলের অতিকায় এক পতাকা। নৌকা, ঘর এমনকি পুরো পাড়া-মহল্লা এভাবে অন্য দেশের পতাকার রঙে সাজানোতে যে গৌরব নেই এটাও ভুলতে বসেছে জাতি। অথচ বাংলাদেশ যখন ক্রিকেট খেলে বা খেলার কোনো মূলপর্বে জায়গা পায় তখন কিন্তু এমন উন্মাদনা দেখা যায় না।

কথায় বলে পাগলও নাকি নিজের ভালো বোঝে। আমরা কি তবে পাগলের চাইতেও খারাপ জায়গায় চলে গেছি? বাংলাদেশের পতাকাটি অনিন্দ্যসুন্দর। অথচ তার উড্ডয়ন সীমাবদ্ধ। কেন জানি মনে হয় এসবই এক ধরনের মানসিক চাপ অথবা এসকেপিজম। পরেরটা বলতে বুঝি পলায়নপরতা। কখন মানুষ আপন বাস্তবতা বা পরিচিত পরিবেশ থেকে পালায়? যখন তা তার জন্য সুখকর না অথচ সে তা এড়াতেও পারছে না। নানা ঝামেলা সমস্যা অচলায়তনে বাঁধা পড়ে আছে দেশ। যে ফুটবল নিয়ে এত কথা এত আবেগ, সেই ফুটবল খেলার জন্য একটা প্রশস্ত মাঠ দরকার। সেটাও নাই দেশে। ফলে যারা খেলতে চায় তারা পারে না। দেশের ফুটবল জগত এখন নামসর্বস্ব। এর সাথে টাকা পয়সার সম্পর্ক যতটা জনগণ বা সমর্থকের সম্পর্ক ততোটাই কম। নিজ দেশে ফুটবলের সম্ভাবনা যখন নেই, তখন মানুষ কি করবে? হয়তো তাই তার পলায়নপরতার বড় জায়গা হয়ে ওঠে এমন সব উত্তেজনা। তারা নিজেরাও জানে এসবের কোনো মানে নেই। যাদের জন্য এমন করা তারা হয়তো এদের চেনে না। নামও শোনে নি কেউ কেউ। তবু সব ছাপিয়ে এমন আনন্দ বেদনার নাম আসলে কী?

একে একতরফা পাগলামি বলতে পারবো না। তা হলে কোটি মানুষকে অপমান করা হবে। অন্তত এর ভেতরে বুঁদ হয়ে থাকা জাতি কিছুদিন রাজনীতিসহ কিছু বিষয়ের ভাঁড়ামি আর কলহ থেকে দূরে থাকতে পারবে। তাদের ঝগড়া মান-অভিমান ঘরে ঘরে খুঁনসুটি আর আনন্দ বেদনার কাব্য যদি সুসহ-খাতে প্রবাহিত হতে পারে তাহলে ভয়ের কিছু নেই। কিন্তু অর্থনৈতিক মন্দার সময় মিতব্যয় আর সংযম যেন ভুলে না যাই আমরা।

ফুটবলের জয় হোক। জয় হোক ফুটবলপ্রেমী বাঙালির। তাই হয়তো মান্না দে গেয়েছেন: ‘সব খেলার সেরা বাঙালির ফুটবল...’

সিডনি