শিল্প ও সাহিত্য

নোবেলজয়ী আনি এরনোর উপন্যাস: ৭ম পর্ব

যে বুড়ি আমার গর্ভপাত করেছে সে আমাকে আমার নামটাও জিজ্ঞেস করেনি। আমি তাকে একটা মিথ্যা নাম দিতাম। স্কুল মনে রাখা সহজ। মনে হয় সেটা নিষ্পাপ, মামুলি। ‘আমরা ওকে একটা প্রাইভেট স্কুলে পাঠাবো, ওরা অনেক কাজ করে, সেখানকার শিশুরা ভালো হয়ে ওঠে।’ ফাঁকা ঊরুর কসম, এ যেন মাখন লাগানো। প্রাইভেট স্কুলেই একটা ভালো শিক্ষা পাওয়া যায়। মনেট ততোদিনে স্থানীয় স্কুলে যাচ্ছিল, আমার মা ক্রেতাদের কৈফিয়ত দিচ্ছিল, ‘এমন না যে আমরা খুব নাক উঁচু, তবে প্রাইভেট স্কুলটা নিকবর্তী, ওকে আনা-নেয়া করা সহজ হবে আর আমরা খুব ব্যস্ত।’ 

আমি কাঁদিনি, আমি যখন ওখানে পড়া শুরু করি আমি না-খোশ ছিলাম না, এটাই মোদ্দা কথা। বাবা-মায়ের অভাব অনুভব করা, ওটা ছিলো কৌতুকের মতো, আমি তো জানতাম তারা পালিয়ে যাচ্ছে না, আমার জন্য ওদের পর্যাপ্ত সময় নেই। দেড়টার সময়, বাবা বাইকে উঠবে। আমার স্বাধীনতা হারানো, যেমন ওরা বলেছিল, তুমি যা চাও তা না-করা, দাঁড়াও, বসো, গাও, এর কোনটাই আমাকে মোটেও বিরক্ত করেনি। বরং উল্টোটাই। পড়ুয়া, ওরা আমাকে বলতো। আমি শিক্ষকরা যা কিছু বলতো তা করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করতাম, কাঠি গণনা, লাঠিগুলো, শব্দসমূহ, আমি বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে চাইতাম না। আমি কখনোই পালিয়ে যাওয়ার কথা ভাবিনি, এমনকি ঘণ্টা বাজার পর আঙিনাতে সময় নষ্ট করতাম না। যারা এমন করতো আমি চাইতাম তাদের শাস্তি হোক। কখনোই স্কুল পালানোর কথা ভাবিনি। সেটা ছিলো খানিকটা অদ্ভূত, অবর্ণনীয়, আমি একেবারে দিশেহারা হয়ে গিয়েছিলাম। 

এটা আমাদের দোকান, আমার বাবা মা, আমার বাড়ির ছোট্ট বন্ধুদের থেকে একেবারে আলাদা। কখনো কখনো আমি ভাবতাম আমি চেনা কিছু পেয়ে গেছি, যেমন মালী কাকা যখন সে যেতো ক্লাশরুমের জানালার পাশ দিয়ে ওভারল আর ময়লা জ্যাকেট পরে, কিংবা ক্যাফেটেরিয়ার নিকট হ্যারিংয়ের ঘ্রাণ, এদিকে সেদিকে দুয়েকটা শব্দ, কিন্তু এটা সব সময় ঘটতো না। এটা সত্যি মনে হতো না, এটা ছিল স্কুলের মালী, স্কুলে হেরিং। এমনকি ভাষাটাও এক নয়। টিচার আস্তে ধীরে কথা বলে, সে দীর্ঘ শব্দ ব্যবহার করে, তার কখনোই কোনো তাড়া নেই, সে কথা বলতে আনন্দ পায়, আমার মায়ের থেকে খুব আলাদা। 

‘তোমার ওভার কোট ওই হুকে ঝুলিয়ে দাও!’ যখন আমি খেলা থেকে আসতাম আমার মা চেঁচিয়ে বলতো, ‘তোমার স্যুয়েটার মেঝেতে ফেলে দিও না, কে ওটা তুলবে বলে তুমি ভাবছো? তোমার মোজা উপরে ওঠাও!’  আলাদা দুনিয়া। কথাটা সত্য নয়, তবে সব কিছু একভাবে ফিরে আসে না। বাড়িতে আমরা ওভারকোট কিংবা পোশাক পরিচ্ছেদের মতো শব্দ ব্যবহার করতাম না, কেবলমাত্র যখন আমরা ‘পরিচ্ছেদ’ নামের একটা দোকানে সবার জন্য কেনাকাটা করতে যেতাম, তবে সেটা তখনও নেহাত একটা নাম যেমন লেস্যু একটা নাম, আর আমরা তো যেতাম ফিটফাট হতে, একটা কোট কিংবা কাপড়চোপড় কিনতে। এটা বিদেশি ভাষার চেয়ে জঘন্য; যদি তুমি তুর্কি বা জার্মান ভাষা না-বোঝ, অন্তত তুমি জানো তুমি কোথায় দাঁড়িয়ে আছো, এদিকে আমি সব শিক্ষকরা যা বলে তার সবই বুঝি, কিন্তু আমি নিজের উপরে তা খাটানোর কথা ভাবতামও না; কিংবা আমার বাবা-মায়ের উপরেও, নইলে তো আমি বাড়িতেও এগুলো শুনতাম। আগাগোড়া আলাদা। একটা অস্বস্তি, একটা ধাক্কা খেয়েছি যতোবারই শিক্ষকরা মুখ খুলেছে।

আমি হয়তো দেখতাম আর শুনতাম, আর ওরা যা বলতো তা তুচ্ছ মনে হতো আর অসার, ঠান্ডা ও বিক্ষিপ্ত মনে হতো। সত্যিকারের শব্দ হলো তা যা আমি বাড়িতে শুনতাম, মাল, তোমার মুখরে খাওয়াও, ঢুকিয়ে দেও, বুইড়া খানকি, আমাদের একখান চুমা দেও আমার ছোট্ট কলিজা। সব কিছু সেখান থেকে অনুসারিত, চিৎকার, ভেংচি, বোতলের গড়িয়ে পড়া। শিক্ষক কথা বলতো আর কথা বলতো কিন্তু যে বিষয়ে সে কথা বলে যেতো তা বাস্তবে ছিল না, আমি দশ বছর আগেই জেনে গিয়েছিলাম ওরা কী বোঝাতে চায়, মেষ, সারমেয়রা পাহারা দেবে মেষের পালকে, এজর বাড়িকে পাহারা দেবে, বোকার মতো শব্দ আর গল্প, শিক্ষকদের ধাঁধা। যখন ক্লাসের মেয়েগুলো অক্ষরের উপর আঙুল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পড়তো প-আ পা, প ই পি, ওদের দেখে আমার হাসি পেতো। 

এইটাই কি স্কুল, চিহ্নের ভার বারবার বয়ে যাওয়া, বইয়ের পৃষ্ঠায় ওগুলো খোঁজা, আর দলবেঁধে উচ্চারণ করা? দোকানের জগত ছিল আরো অনিঃশেষ সত্যতায় ভরপুর! স্কুল ছিল ক্রমাগত বানিয়ে বলা, ভাব করা এটা মজার, ভাব করা এটা কৌতুককর, ভান করা যে সব ভালো। শিক্ষিকা স্বয়ং নাটক করে যেতেন, তিনি আমাদের গল্প পড়ে শোনাতেন বাড়াবাড়ি রকমের জোর দিয়ে, যখন বিশাল আর দুষ্টু নেকড়ের কথা বলতেন তখন নিজের চোখ খুব ঘুরাতেন। সবাই হাসতো, আমিও নিজেকে দলে যোগ দেয়াতাম। আমি কখনো কথা বলতে পারে এমন প্রাণীদের কথা শুনে আত্মহারা হতে পারিনি। আমি ভাবতাম সে ইয়ার্কি করছে, এইসব গল্প আমাদের পড়িয়ে। সে এমন করে লাফাচ্ছিল চারপাশে আমার মনে হয়েছিল সে হয়তো অর্ধ-বুদ্ধির মহিলা, একটা বড় হওয়া শিশু যাকে কেউ কখনো ঠিকভাবে কুকুর আর ভেড়ার গল্প পড়তে সাহায্য করেনি। 

আমার পাশে বসা মেয়েরা ভাব করছিলো যে তারা খুব আগ্রহ নিয়ে শুনছে, ঘুরে ঘুরে শুনছে দেখছে আর প্রত্যেক পাঁচ মিনিট পরপর হাসছে, তারা আবার শুনতে থাকে আর এইরকমই চলতে থাকে। আমি আমার পাশে বসা মেয়েটিকে অনুসরণ করি, আমি সবসময়ই অন্যদের মতো হতে চেয়েছি। এটা মেনে নিয়েছি যে ঠিক এখন অনুকরণ করার মতো কেউ নেই, কোনো আদর্শ ব্যক্তি নেই যাকে অনুকরণ করা যায়, সেটাই ছিলো সমস্ত ঝামেলার মূল। সবাই একই খেলা খেলে যাচ্ছিল। শিক্ষক হয়তো বলতো, ‘তোমাদের ওভারকোট পরে নাও, এখনই সময় হবে,’ আর আমরা হাত গুটিয়ে ঘণ্টা পড়ার অপেক্ষা করতাম। এর কোনো মানে ছিল না, আমরা খেলার মাঠে গিয়ে অপেক্ষা করতে পারতাম কিংবা অপেক্ষা না-করলেও পারতাম। আমরা টেবিলের তলা দিয়ে পায়ে খোঁচা দিতাম, ফিসফাস করতাম, ভাব করতাম বিরক্ত না-হওয়ার। যতোক্ষণ আমরা ঘণ্টা না-শুনতাম, আনমনে, প্রায়শই অদৃশ্য বস্তু টিংটিং করতো প্রতিটি কোণা থেকে, একটা দুর্বল শব্দ প্রায় শোনা যায় কি যায় না, একটা দোকানের ঘণ্টাধ্বণির চেয়ে জোরালো নয়। অথচ যখন আমাদের দোকানে ঘণ্টা বাজতো তার মানে দাঁড়াতো কোন ক্রেতা এসেছে, এর মানে ব্যবসা হবে, টাকা জমবে ক্যাশ বক্সে। স্কুলের ঘণ্টা ছিলো নেহাতই অবান্তর কল্পনা, অর্থহীন একটা ঢং ঢং। 

স্কুলে আমরা খেতে বা পান করতে পারতাম না আর টয়লেটে যেতে হলে পুরো একটা নাটক করতে হতো। তোমাকে শিক্ষকের টেবিল পর্যন্ত যেতে হবে তারপর জিজ্ঞেস করতে হবে, ‘দয়া করে আমাকে কি ক্ষমা করতে পারেন?’ আর না হলে বলতে হবে সরাসরি ‘আমি কি বাথরুমে যেতে পারি,’ অথচ সব সময় তোমার পেট ফেটে যাচ্ছে যাওয়ার জন্য। এমন তো ভাবতে হতো না সালোমি কিংবা লম্বা গ্লাস ভর্তি ডালিমের রস পেতে গিয়ে আর তুমি কাতর হয়ে আছো দু’পায়ের মাঝখানে হাত চেপে রেখে। ‘ফ্রান্সোয়িস নিজেকে ভিজিয়ে ফেলেছে!’ পিঁরেতে পেন্সিল ওঠানোর সময় সেটা দেখেছে। আহা আর উহু আতঙ্কিত অঙ্গভঙ্গি। শিক্ষক ফ্রান্সিসকোকে বেঞ্চের উপরে তোলে। একটা বড় কফি-রঙা দাগ সেখানে কিছুক্ষণের জন্য। কান্না, চিৎকার, শিক্ষক বগল দাবা করে ফ্রান্সোয়িসকে ওয়াশ বেসিনে নিয়ে যায়। মাথাটা প্রথম। সে তার রুমালে ফিচফিচ করতে থাকে ঘণ্টা পড়া পর্যন্ত। 

আমি শঙ্কিত হই যদি আমার ক্ষেত্রে এমনটা হয়, যখন আমি বাথরুমে যাওয়ার কথা বলার সাহস পাবো না... আটকে রাখবো বিরতি পর্যন্ত। তারপর আমরা কিচ্ছু নিয়েই ভাবি না, ডজন ডজন মেয়ে, ছোট আর বড়, সব ভিড় করেছে পাঁচটা টয়লেটে। প্রথমে যাওয়ার জন্য হুড়োহুড়ি করছে। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম ওরা হয়তো ফাজলামি করছে, ওরা সবাই তো একসাথে যেতে পারবে না। আমি বলেছিলাম, ‘আমি টয়লেটে যেতে চাই।’ আমি ধাক্কা দিয়েছিলাম। ওরা হেসেছিল। আমি ওদের পায়ের ফাঁক দিয়ে বেরুতে চেয়েছিলাম- আর একজন চেচিয়ে উঠলো, ‘ও একটা বেকুব না!’ আমার তলপেটে ব্যথা করে আর আমি আমাদের বাড়ির বাইরের আঙিনার টয়লেটের কথা ভাবি। তখন আমি বুঝতে পারি, ওরা সবাই অপেক্ষা করছিল, সবারই চাপ আছে আর আমি লাইনে গিয়ে দাঁড়াই। আমাদের পুরো বিরতিকালটা কি বাথরুমেই কাটবে?... তারা প্রায় দুই কুচকি কুকড়ে-মুকড়ে থাকে বিস্ফোরিত হওয়ার আগে। আমি অসুস্থ অনুভব করি, টয়লেটটা জল আর হিস্যুতে ভেসে গেছে, দেয়াগুলো ঢেকে গেছে বাদামী কাটাকুটিতে, সাদা কমোডটা যেন কুলকুচা করছে, চারি প্রান্তে শুকনো বিষ্ঠার দাগ। সিটে বসলে ঊরু জমে যায়, পা যেন একটা ময়লা ডোবায়, চারিদিকে মলমূত্রের গন্ধ, যেন একটা নোংরা লন্ড্রি। মেয়েরা দরজা ধাক্কাতে থাকে।

বাড়িতে যখন সূর্য উঁকি দিতো কাঠের দেয়ালের ফাঁক ফোকর দিয়ে, মাকড়শার জাল ঝিকমিক করতো, গুন্ধ পাওয়া যেতো পেরেকে ঝোলানো খবরের কাগজ আর তাজা উষ্ণ হিস্যুর। আমি আর টয়লেটে যেতে চাইতাম না।  

দুটো জগত। কোন জায়গা থেকে আমি তুলনা করতে শুরু করবো? এখনও নয়, প্রথম কয়েক বছরে নয়। একটা বিরাট ঠান্ডা আঙিনা লেবু গাছের সীমানায় ঘেরা, মাঝখানে একটা খিলানে দোলনা, এক বেয়ে ওঠার দড়ি। একজনের পর আরেকজন, একবার করে। আমি কখনোই এটাতে অভ্যস্ত হইনি। একটা মেয়ে আমাকে বিরক্ত হয়েই বললো, ‘তুমি প্যান্টি পরো নাই!’ সে নিশ্চয়ই নিচে দাঁড়িয়ে ছিলো যখন আমি দড়ি বেয়ে উপরে উঠেছি, দেখেছিলো আমার স্কার্ট। সব কিছুই দেখতে পারো তুমি। ব্ল্যাকবোর্ড, অংক, শব্দগুলো... দোকানের পিছনে ছোট্ট আঙিনা, বাক্স, ক্রেট, সেগুলোর ভেতর থেকে আসা নানা জিনিসের গন্ধ, হলুদ,  চেখে দেখার ভীষণ বোতলগুলো দেখা যেতো দোকানের জানালা থেকে। আমার বাবা মায়ের কণ্ঠ, এমনকি না-শুনেও তাদের কথা বোঝা যায়, স্থুল বাক্য, ছোট ছোট, ‘তুমি কি জানো, বুড়ো মার্টিন ড্যান্ডলিয়ন গাছের শেকড় খায়, খেতে হবে, আপনার পরে আমাকেও, যুদ্ধ সব যুদ্ধকে থামিয়ে দেয়, আমাকে দেখো যখন আমি তোমাকে দেখি...’ এইসব কথাই আমার ভেতরে আছে, উষ্ণ বিড়ালের ঘরঘরের মতো।

যখনই আমি আমার বাবার বাইক থেকে লাফ দিয়ে নামতাম আর ছুটে দোকানে যেতাম, আমি নানান জিনিসে ডুবে যেতাম, লোকজন, আরো একবার শব্দের জগতে। ধূসর টাইলসের মধ্য দিয়ে একটা দুধের রেখা, দুইচামচ টইটম্বুর করে ভরা, ম্যাদাম লেস্যু, কি উস্কানি, লা কানু, তার রুটি আর মাখনে সরিষা সস, তোমার চোখে জল এসে যাবে কিংবা বিশাল পুলিপিঠা, দরজার কাছে সূর্যের আলোতে পা প্রসারিত। এই নিনিস, তোমার ঢাকনা নামাও, ইঞ্জিন দেখাচ্ছো নাকি! পুরো ব্যাপারগুলো একটা দুনিয়া থেকে আরেকটা দুনিয়ায় চলে গেলো নিরবে কোন ভাবনার সুযোগ না দিয়েই। কোন কিছুতেই আর বিস্মিত হতে দিও না নিজেকে।

ঠিক এভাবে সব হয়নি, আমি দুটো জগতকে গুলিয়ে ফেলেছিলাম, বিশেষ করে শুরুতে, কতোদিন এভাবে চলেছিল? স্কুলের প্রথম কয়েকটা বছর, ক্রয়সেন্টের মতো ঝুলে পড়া ঠোঁটের মাস্টারনি, তারপর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বুড়ো মহিলা অবিন যে কিনা ডেস্কের তলায় উঁকি দিয়ে দেখতো আমরা হাত দিয়ে কী করছি...  আমি সব সময় দেরী করে আসতাম, পাঁচ মিনিট বা দশ মিনিট। মা আমাকে জাগাতে ভুলে যেতো, নাস্তা তখনো রেডি না, আমার মোজায় একটা ফুটো ঠিক করতে হবে, একটা বোতাম সেলাই করতে হবে, ‘তুমি এভাবে যেতে পারো না!’ আব্বা যতো জোরে পারে চালাতো, কিন্তু ক্লাস ততোক্ষণে শুরু হয়ে গেছে। আমি টোকা দিতাম, আমি ঢুকে যেতাম আর দ্রুত শিক্ষকের ডেস্ক পেরিয়ে যেতাম। ‘ডেনিস লেস্যু, বেরোও, অনুমতি নাও, তারপর আবার এসো!’ আমি নির্বিকার, আবার দ্রুত ঢুকে পেরিয়ে যাই তাকে। তার কণ্ঠ তীক্ষ্ম। ‘আবার, বেরোও, এইভাবে তুমি আসতে পারো না!’ আবার বাইরে, এইবার আমি শান্তভাবে প্রবেশ করি আর মেয়েরা হেসে ওঠে। আমি জানি না কতোবার সে আমাকে ভেতর বাহির করিয়েছে। আর আমি হাঁটতে থাকি, সে কি করছে সেটাকে অবজ্ঞা করেই তার ডেস্ক পার হয়ে যাই। অবশেষে সে ওঠে দাঁড়ায়, ঠোঁট চেপে থাকে। সে বলে, ‘আমরা কোন রেলস্টেশনে নেই। দেরী করে আসলে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তির কাছে একবার ক্ষমা চাইতে হবে। কী আর বলবো, তুমি তো দেরী করতেই থাকো।’ পুরো ক্লাস হাসিতে ভেঙে পড়ে। 

আমি ক্রুব্ধ, এই পুরো সার্কাসটা খামাখাই। আমি তো তখন জানতাম না আমার কী করা উচিত ছিল। ‘আমি জানতাম না, ম্যাডাম!’ ‘বেশ, তোমার জানা উচিত!’ আমার কি করে জানার কথা? বাড়িতে কেউ কখনো আমাকে বলেনি। তুমি যখন খুশি আসো আর যাও, আর কখনোই তো কেউ ক্যাফেতে বলেনি তুমি দেরী করে এসেছো। নিশ্চয়ই আমি তবে একটা রেলওয়ে স্টেশনেই থাকতাম। আমার বুকের মধ্যে কষ্ট হয়, আমি বুঝতে পারি না, স্কুল, এই অবাস্তব, অবান্তর খেলাটার মানে, এটা ক্রমেই আমার কাছে জটিল হয়ে ওঠে। টিচারের ডেস্কটা কঠিনতর হয়ে উঠছে, চুলাটা যেন ঝুলকালির গন্ধ পাচ্ছে, সবকিছুই যথার্থ উপস্থিতি দাবী করে, একটা মোটা দাগের সীমারেখা দিয়ে টানা। সে আবার বসে পড়ে, আমার দিকে আঙুল তুলে হাসে, ‘তুমি একটা জেদী মেয়ে, পিচ্চি মেয়ে, তুমি আমাকে অস্বীকার করেছো, হ্যাঁ আমাকে শুভ সকাল বলতে অস্বীকার করেছো!’ সে পাগল হয়ে যায়, আমি যাই বলি কোন কাজে আসে না, সে চিল্লাতে থাকে, একটার পর একটা অজুহাত বানাতে থাকে। তারপর থেকে প্রত্যেকবার দেরী হওয়ার একটা কারণ আমি তাকে দিতাম, একটা বোতাম, সময় মতো নাস্তা না-হওয়া, ভোরবেলার মালপত্র বিলি আর আমি তাকে শুভ সকাল বলতাম। সে গজগজ করতো। একদিন সে ফেটে উঠলো, ‘তুমি বলতে চাও সকালে তোমার মা তোমার বিছানা গোছায় প্রতিদিন?’ 

‘এটা নির্ভর করে, কখনোবা দুপুরে সে এটা করে, কখনো করেই না যদি সে সময় না-পায়।’ আমি মনে করার চেষ্টা করি। ‘তুমি কি আমাদের সঙ্গে ইয়ার্কি মারছো? তুমি কি সত্যিই মনে করো আমরা এ সব শুনতে আগ্রহী?’ আমার প্রতিবেশি আমাকে খাইয়ে দিয়েছে। তুমি প্রতিদিন বিছানা গোছাও সকালে, ওহ আচ্ছা, প্রতিদিন। ‘তুমি নিশ্চয়ই একটা আজব বাড়িতে বাস করো!’ অন্য মেয়েরা ঘুরে তাকায় আর নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে। হাসি, চিৎকার আর অকস্মাৎ এটা দুধের মতো টক হয়ে ওঠে, আমি নিজেকে দেখতে পাই, হুম আমি নিজেকে দেখতে পাই আর আমি বুঝি আমি অন্যদের মতো নই...

আমি এটা মানতে চাইতাম না, আমি কেন ওদের মতো হতে পারি না, আমার পেটের মধ্যে একটা অস্বস্তি, চোখ ভরে কান্না ফিরে আসে। কিছুই আর আগের মতো নেই। অপমান। আমি শিখেছি স্কুলে কেমন লাগে। হয়তো অন্য রকম থেকে থাকতে পারে, কিন্তু সেটা অবগত ছিলাম না। আমি সেই মুহূর্তেই অনুধাবন করেছিলাম এটা আমার বাড়ি থেকে আলাদা, জেনেছিলাম যে, টিচাররা আমার বাবা মায়ের মতো কথা বলে না, কিন্তু শুরুতে আমি স্বাভাবিক আচরণই করতাম, আমি কোন কিছুকে আলাদা করতে চাইনি। আমরা কোন রেলওয়ে স্টেশনে নেই ম্যাডাম লেস্যু! তুমি সেটা জানো না বুঝি... তোমাকে সেটা শিখতে হবে... (চলবে)

 

পড়ুন: নোবেলজয়ী আনি এরনোর উপন্যাস: ষষ্ঠ পর্ব