সাক্ষাৎকার

অনুবাদককে গভীরে গিয়ে ভাব হৃদয়ঙ্গম করতে হয়: কে এম আব্দুল মোমিন

কে এম আব্দুল মোমিন কবি, লেখক, গবেষক ও অনুবাদক। রাজশাহী সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ইউনিভার্সিটির অবসরপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার এই সাহিত্যিক বিশেষত প্রবন্ধ এবং অনুবাদের জন্য সমাদৃত। তার রচিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে, ভাষা বিষয়ক গ্রন্থ ‘এবিসি ইন রাইমস’, ‘দ্য রেডিয়্যান্ট ওয়ে টু ইংলিশ’, ‘ছড়ায় ছন্দে বর্ণমালা’, কাব্যগ্রন্থ ‘মায়ের চোখে জল’, প্রবন্ধগ্রন্থ ‘গোল্ডেন ফ্লিস’, অনুবাদগ্রন্থ ‘গ্রিক মিথলজি ও কিং আর্থার’ ইত্যাদি। তিনি প্রবন্ধ, গ্রন্থ, থিসিস ইংরেজিতে অনুবাদ ও সম্পাদনা করে থাকেন। সম্প্রতি তিনি প্রবন্ধ এবং অনুবাদ কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ফ্রেন্ডস অব হিউম্যানিটি অ্যাওয়ার্ড-২০২২ অর্জন করেন। তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কবি স্বরলিপি  

স্বরলিপি: অনুবাদক হিসেবে আপনার আনন্দ কিসে, অনুবাদ সম্পন্ন করতে পারায়, নাকি ভিন্ন একটি দেশের মানুষ, তাদের জীবনবোধ ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জানার মধ্য?

কে এম আব্দুল মোমিন: যেন তেন প্রকারে সম্পন্ন করায় কোনো কাজেই আমি আনন্দ পাই না। যা করি সুন্দরভাবে সম্পন্ন করার চেষ্টা করি। জন কিটস এর ‘A thing of beauty is a joy forever.’ বিখ্যাত উক্তিটি সব কাজের ক্ষেত্রেই আমাকে প্রেরণা যোগায়। আপনি ঠিকই বলেছেন- বিদেশি সাহিত্যের অনুবাদের মাধ্যমে তাদের জীবনবোধ ও সংস্কৃতি বাঙালি পাঠকদের পরিচিত করা একটি অন্যতম উদ্দেশ্য থাকে। অনুবাদের ক্ষেত্রে সোর্স ল্যাঙ্গুয়েজ বলতে- যে ভাষা থেকে অনুবাদ করা হয় এবং টার্গেট ল্যাঙ্গুয়েজ বলতে- যে ভাষায় অনুবাদ করা হয় বুঝায়। অনুবাদের সময় উভয় ভাষা ও সংশ্লিষ্ট পাঠকদের জীবনবোধ ও সংস্কৃতি সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা থাকলে বিষয়টি সুন্দরভাবে সম্পন্ন করা যেতে পারে। তখনই তা কেবল একজন অনুবাদকের আনন্দের বিষয় হতে পারে। আমার ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম নয়। বলে রাখা ভালো আমার সোর্স ল্যাঙ্গুয়েজ ইংলিশ এবং টার্গেট ল্যাঙ্গুয়েজ বাংলা।  

স্বরলিপি: অনুবাদক হয়ে ওঠার প্রস্তুতিকাল সম্পর্কে জানতে চাই।

কে এম আব্দুল মোমিন: বাবা প্রায়ই বলতেন, বিশ্বের জ্ঞানভাণ্ডার যদি মন্থন করতে চাও ইংরেজি শিক্ষার বিকল্প নেই। কারণ ইংরেজরা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রাচীন ও আধুনিক বিভিন্ন ভাষায় রচিত অসংখ্য মূল্যবান গ্রন্থ ইংরেজিতে অনুবাদ করে তাদের জ্ঞানভাণ্ডার সমৃদ্ধ করেছে। অপরদিকে সক্রেটিস, প্লেটো, অ্যারিস্টোটল, হোমার, যিশুর মতো পণ্ডিত, দার্শনিক, কবি, ধর্মগুরু জ্ঞানের আলো বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিয়েছে। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় Heroes of Bengal, নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় Andrew Lang এর The Arabian Nights এবং Vincent Smith এর Oxford History of India অতিরিক্ত পাঠ্য হিসেবে তিনি আমাকে পড়িয়েছিলেন। এসএসসি পাশের পূর্বে নজিবর রহমান সাহিত্যরত্নের ‘আনোয়ারা’, মীর মোশাররফ হোসেনের ‘বিষাদ-সিন্ধু’, মাইকেল মধুসূদনের ‘মেঘনাদ বধ কাব্য’, সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজীর ‘অনলপ্রবাহ’, ‘রায়নন্দিনী’, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘আনন্দমঠ’, এমন অনেক বই পড়েছি। ফলে বাংলা ও ইংরেজি ভাষা সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা লাভের সুযোগ ঘটেছে। পারিবারিক গ্রন্থাগার থাকায় এটি আমার জন্য সহজ ও সম্ভব হয়েছে। উচ্চ মাধ্যমিকে অধ্যয়ন করার সময় নিউ গভর্নমেন্ট ডিগ্রি কলেজে আমি একা উচ্চতর ইংরেজি নিয়ে পড়াশোনা করি। সপ্তাহে ছয়দিন ছয়জন শিক্ষক আমাকে পড়াতেন। শেক্সপিয়রের ‘জুলিয়াস সিজার’ তখন আমার পাঠ্য ছিল। নাটকটি আমার মনকে দারুণভাবে নাড়া দেয়। শেক্সপিয়রের সব নাটক পড়ার আগ্রহ জাগে। কলেজ গ্রন্থাগার থেকে তার কমপ্লিট ওয়ার্কস নিয়ে আমি ১১টি নাটক পড়ে শেষ করি। এছাড়া, কলেজের পাশে ছিল বাংলাদেশ কাউন্সিল লাইব্রেরি। সেখানে আমি অনেক বই পড়েছি। যেমন আব্দুল কাদির সম্পাদিত কাজী নজরুল ইসলামের রচনাবলী, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর রচনাবলী, দ্বীনবন্ধু মিত্রের রচনাবলী, বাংলাসাহিত্যের ইতিহাস ইত্যাদি পড়েছি উচ্চ মাধ্যমিক পাশের পূর্বেই। বন্ধুদের অনেকেই কাজী আনোয়ার হোসেন, রোমেনা আফাজ পড়ত। কিন্তু সেসব বই আমাকে কখনও আকর্ষণ করেনি। 

বাবার অনুপ্রেরণা ছাড়াও মধুসূদন পড়তে গিয়ে ইংরেজি শিক্ষার প্রতি প্রবল আগ্রহ সৃষ্টি হয়। বিশেষত বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ভিত্তি স্থাপনে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও মধুসূদন দত্তের অবদান অপরিসীম। ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে দখল থাকার কারণেই তাদের পক্ষে এ অবদান রাখা সম্ভব হয়েছে। আমার সাধ জাগে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য অধ্যয়ন করে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করব এবং বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ গ্রন্থসমূহ ইংরেজিতে অনুবাদ করে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরব। সেই লক্ষ্যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে পড়াশোনা করেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে সিলেবাসের বইপত্র ছাড়াও এর বাইরে অনেক বই পড়েছি। বন্ধুরা যখন নোট পড়ত, আমি পড়তাম মূল বই। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত কোনো পরীক্ষাতেই নোট তৈরি বা সংগ্রহ বা মুখস্ত করে লিখিনি। ফলে ঈর্ষণীয় ফল অর্জন করতে পারিনি। অনেক প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে টিকে থাকতে হয়েছে। কর্মজীবনেও যে চাকরি জুটেছে সেখানে মেধা বিকাশের সুযোগ ছিল না। বরং ছাত্রজীবনের আশা-আকাঙ্খার অপমৃত্যু ঘটেছে।

স্বরলিপি: অনুবাদ সাহিত্যে ভাষা এবং ভাবের ভারসাম্য রক্ষা করা কঠিন বলে মনে করা হয়। আপনি কীভাবে এই দুইয়ের ভারসাম্য রক্ষা করেন? 

কে এম আব্দুল মোমিন: অনুবাদকের জন্য ভাষা ও ভাবের ভারসাম্য রক্ষা করা সত্যিই একটি বড় চ্যালেঞ্জ। আসলে ভাষা তো ভাবকে ধারণ করে। সুতরাং অনুবাদককে ভাষার গভীরে প্রবেশ করে ভাবকে হৃদয়ঙ্গম করতে হয়। প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট রেফারেন্স বইয়ের সাহায্য নিতে হয়। সোর্স ল্যাঙ্গুয়েজের ভাব উপলব্ধি করলেও অনেক সময় টার্গেট ল্যাঙ্গুয়েজের অনুরূপ ভাব প্রকাশক শব্দ, বাগধারা, প্রবাদ, প্রবচন উপযুক্ত সাংস্কৃতিক পরিবেশে প্রয়োগের প্রয়োজন পড়ে। এছাড়া, মূল বইয়ের পরিবেশ, ঘটনা, চরিত্র ও মেজাজ বুঝে অনুবাদের ভাষা ও ভাবের ভারসাম্য রক্ষা করার চেষ্টা করি। 

এ ছাড়া আমি মনে করি, লেখক এবং লেখা দুই-ই বোঝা জরুরি। অ্যারিস্টোটল স্থান, কাল ও কর্মের ঐক্যের কথা বলেছেন। আসলে, কোন স্থানে কোন সময়ে কোন কাজ কে বা কারা কেন ও কীভাবে করে বা করেছে বা করবে বিস্তারিত জানতে হলে লেখককে বাদ দিয়ে লেখার বিচার পূর্ণাঙ্গতা লাভ করে না। সৃষ্টির মাঝেই স্রষ্টা লুকিয়ে থাকে। তা সচেতন ভাবেই হোক বা অবচেতন ভাবেই হোক। লেখককে যেহেতু কোনও সমাজে নির্দিষ্ট কালের গণ্ডীতে প্রচলিত ভাষায় লিখতে হয়, সঙ্গত কারণেই তার ভাষায় সমসাময়িক মিথের ব্যবহার, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, সংগ্রাম ও ইতিহাসের প্রভাব অনেক ক্ষেত্রে অনিবার্য হয়ে পড়ে। সেটাই স্বাভাবিক। সুতরাং সঠিক মূল্যায়নের জন্য লেখক ও লেখা উভয়কেই জানা ও বোঝা একান্ত জরুরি।

স্বরলিপি: অনুবাদ কি পরিপূর্ণ সাহিত্য? 

কে এম আব্দুল মোমিন: জাক দেরিদা বলেন, ‘অনুবাদ আসলে সাহিত্যকর্মের অন্যজীবন দেয়- এক নতুন মৌলিক অস্তিত্ব সৃষ্টি করে অপরাপর ভাষায়।’ এই চলমান জগতে কোথায় কখন কীভাবে কী দেখলাম তা পাঠকদের জন্য সর্বজনীন করে দেখানোই হচ্ছে সাহিত্য। সাহিত্যের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখার মধ্যে অনুবাদও একটি সাহিত্যকর্ম। সোর্স ল্যাঙ্গুয়েজের একটি কর্ম সম্পর্কে রচনাশৈলী ও বৈশিষ্ট্য ঠিক রেখে যখন নিজের উপলব্ধি টার্গেট ল্যাঙ্গুয়েজের পাঠকদের জন্য সর্বজনীনভাবে উপস্থাপন করা হয় তখন তা সাহিত্যকর্ম হিসেবে বিবেচিত হয়। তবে প্রকৃত সার্থকতা নির্ভর করে কতটা সফলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে তার উপর। মূলের সৌন্দর্য় যতখানি অনুবাদে উপস্থাপন করা সম্ভব হবে অনুবাদও ততখানি সফল হবে। এই কাজটি অনুবাদককে যত্ন ও বিশ্বস্ততার সাথে করতে হয়। পাঠকগণ যেন মূলের স্বাদ যতটা সম্ভব আস্বাদন করে তৃপ্ত হতে পারেন।

এ প্রসঙ্গে এডিথ গ্রসম্যান ‘ওয়ার্ডস উইদাউট বর্ডার’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে বলেন, অধিকাংশ অনুবাদক নিজেদের মৌলিক লেখক রূপে মনে করতে চান, কারণ তারা অনুবাদের সময় সোর্স ল্যাঙ্গুয়েজে রচিত সাহিত্যকর্মের অন্তর্নিহিত আবেগানুভূতি, শৈল্পিকতা ও নান্দনিকতাকে যথার্থভাবে উপলব্ধি করে টার্গেট ল্যাঙ্গুয়েজে উপস্থাপনের প্রয়াস পান। একে একজন সফল অনুবাদকের সর্বোচ্চ ও তীব্র আকাঙ্খা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এদিক থেকে বিবেচনা করা হলে বলা যেতে পারে সব ভালো ও সফল অনুবাদকই লেখক।

অনুবাদ আমাদের দেশে সাহিত্যের মর্যাদা পেতে শুরু করে বিগত শতাব্দীর আশির দশক থেকে এবং শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি পায় নব্বই দশকে। যদিও ১৯৫৫ সালে বাংলা অ্যাকাডেমি প্রতিষ্ঠার সময় থেকে অনুবাদ কার্যক্রম চালিয়ে আসছে; তা চাহিদার তুলনায় নিতান্তই অপ্রতুল। তবে পথিকৃত বলা যেতে পারে।      

স্বরলিপি: অনুবাদ সাহিত্য প্রকাশের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বলুন। বাংলাদেশে অনুবাদ সাহিত্যের বেশ ভালো বাজার আছে। আপনার কী মনে হয়?

কে এম আব্দুল মোমিন: এইচএসসিতে অধ্যয়নকালে কলেজ ম্যাগাজিনে আমার Helps To Read কবিতার অনুবাদ প্রথম প্রকাশিত হয়। এরপর কিছু ইংলিশ কবিতার অনুবাদ করলেও প্রকাশ করা হয়নি। কর্মজীবনে এসে Greek Mythology অনুবাদ করি। রাজশাহী থেকে মাসিক লোকপত্রে ধারাবাহিকভাবে তা প্রকাশিত হয়। তারপর বেশ কিছু মৌলিক প্রবন্ধ ও অনুদিত গল্প নিয়ে ‘গোল্ডেন ফ্লিস’ নামে একটি বই লিখি। বইটি প্রকাশ করে জলছবি বাতায়ন।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে পড়েছিলাম স্যার থোমাস জেমস নলেজের ‘কিং আর্থার অ্যান্ড হিজ রাউন্ড টেবল’। বইটি আমাকে মুগ্ধ করে। অনুবাদের সিদ্ধান্ত নেই। দীর্ঘদিন চেষ্টা করেও কোনও কপি সংগ্রহ করতে পারিনি। অবসর জীবনে এসে অনলাইন থেকে কপি সংগ্রহ করে অনুবাদ করি। স্বীকার করতেই হয় বাংলাদেশে অনুবাদ সাহিত্যের বেশ ভালো বাজার আছে। এক্ষেত্রে উপযোগী গ্রন্থ নির্বাচন এবং দক্ষতা ও বিশ্বস্ততার সাথে অনুবাদকে সাহিত্য মর্য়াদায় উন্নীত করা জরুরি। নাহলে পাঠকপ্রিয়তা পাবে না। বরং নিম্নমানের অনুবাদকর্ম প্রকাশ করা হলে অনুবাদ সম্পর্কে পাঠকমহলে নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হবে। 

স্বরলিপি: আমাদের সাহিত্যকর্ম ভিন্ন ভাষায় অনুবাদ হচ্ছে না বললেই চলে, এমনটা কেন হচ্ছে বলে মনে হয়?

কে এম আব্দুল মোমিন: কথাটি যথার্থ। প্রথমত দক্ষ অনুবাদকের অভাব। দ্বিতীয়ত পাঠক স্বল্পতা। তৃতীয়ত আমাদের দেশে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভের উদ্দেশ্য থাকে চাকরি করা। জীবন-জীবিকার তাগিদে কেউ সাহিত্যকে প্রধান পেশা হিসেবে বেছে নেয় না। কারণ দিনরাত লেখালেখি করে যে সম্মানী পাওয়া যায় তা দিয়ে মর্য়াদাপূর্ণ জীবনযাপন তো দূরের কথা পেট চলে না। তাছাড়া, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সঙ্গে চাকরির সমন্বয় ঘটে না। সাহিত্যে ডিগ্রি নিয়ে ব্যাংকের অফিসার বা কোম্পানির সেলসম্যান হিসেবে চাকরি করতে হয়। অচিরেই সাহিত্যচর্চার সলিল সমাধি ঘটে। বাংলা অ্যাকাডেমির মতো স্বতন্ত্র অনুবাদ অ্যাকাডেমি থাকলে এবং উপযুক্ত সম্মানী দিয়ে দক্ষ ও মেধাবীদের আকৃষ্ট করা সম্ভব হলে এক্ষেত্রে এই সংকটের সৃষ্টি হতো না। বরং বাংলা সাহিত্যের ব্যাপ্তি সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ত। এরপরেও কিছু মেধাবী অনুবাদক এগিয়ে এসেছেন। কিছুটা আশার আলো দেখা যাচ্ছে।      

স্বরলিপি: দৃশ্যকল্প তৈরিতে অনুবাদক কীভাবে স্বাধীনতা তৈরি করেন, আদৌ কি তার দরকার পড়ে?

কে এম আব্দুল মোমিন: দৃশ্যকল্প সাহিত্যের অন্যতম অলঙ্কার। অনির্বচনীয় আনন্দের উৎস। উপমার সাহায্যে উপলব্ধি দৃশ্যমান হয়। দৃশ্যকল্পের যথার্থ অনুবাদ পাঠককে আকৃষ্ট করে। সুতরাং দৃশ্যকল্পের অনুবাদ করার দরকার নেই আমি বলব না। বরং বাঙালি পাঠকের নিকট পরিচিত হলে আমি সরাসরি অনুবাদ করি। অপরিচিত হলে অনুরূপ বিকল্প তৈরি করার চেষ্টা করি যেন গুঢ়ার্থ বা অন্তর্নিহিত অর্থ বুঝতে সুবিধা হয়। এক্ষেত্রে আক্ষরিক অনুবাদ প্রযোজ্য নয়। নান্দনিক অনুবাদ করতে হলে অনুবাদকের এটুকু স্বাধীনতা অপরিহার্য়।  

স্বরলিপি: আপনার অনুবাদের বিষয় সাধারণত ইংরেজি সাহিত্য ও সাহিত্য বিষয়ক প্রবন্ধ। যেমন ‘ইংল্যান্ডের রাজা আলফ্রেডের ডেনিশ দমন’ এবং ‘মহারাজ ফ্রেডরিক: সঙ্গীত, সমর ও শাসনের সমন্বয়ক’ এই যে বিষয় নির্বাচন, এক্ষেত্রে আপনার পাঠ্যভ্যাস এবং কীভাবে প্রভাব ফেলেছে?

কে এম আব্দুল মোমিন: বাঙালি, বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশের নিকট আমি আজন্ম ঋণী। আমার চিন্তা-চেতনা এদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি কেন্দ্রিক। বাইরের কোনও ঘটনা বা চরিত্রে দেশপ্রেম, মানবপ্রেম বা সমাজ-সংস্কৃতির জন্য অবদানের সন্ধান পেলে আমাকে আকৃষ্ট করে। আমি চাই তাদের সাথে আমাদের দেশের মানুষ পরিচিত হলে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হবে, মানুষকে ভালবাসতে প্রেরণা পাবে, নিজের স্বার্থ ত্যাগ করতে শিখবে। কিং আলফ্রেড বা মহারাজ ফ্রেডরিক গভীরভাবে নিজেদের দেশকে ভালোবেসেছেন এবং নিজেদের স্বার্থ তো দূরের কথা প্রাণের ঝুঁকি নিতে কার্পণ্য করেননি। 

সীমাহীন ত্যাগ-তিতিক্ষায় অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশ যে সোনার দেশ হিসেবে গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান আমাদের উপহার দিয়ে গেছেন তা যেন আমরা সমস্ত দ্বিধা-বিদ্বেষ ভুলে বিশ্বের বুকে মর্যাদাশীল জাতি হিসেবে গড়ে তুলতে পারি। আমাদের সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি সব কিছু যেন সকলের নিকট ঈর্ষণীয় আদর্শ হতে পারে। একই উদ্দেশ্যে আমি স্যার থোমাস জেমস নলেজের ‘কিং আর্থার’ বইটি অনুবাদ করেছি। এটি আমার বহুল প্রশংসিত সাহিত্যকর্ম। এছাড়া, ইংলিশ সাহিত্য নিয়ে যেহেতু পড়াশোনা, সঙ্গত কারণে ইংলিশ সাহিত্য ও সাহিত্য বিষয়ক বিষয়বস্তু বাংলায় অনুবাদ করে থাকি।